জ্বলদর্চি

লেখা পোড়া /শুভশ্রী রায়

লেখা পোড়া
শুভশ্রী রায়


ছড়া লিখতে ভালোবাসি। এ দিকে আমার বেড়াল খুব ভালো লাগে। তবে কোনো পুষি বেড়াল নেই অথচ তাকে পেলে ভালো হ'ত। তাই মাঝেমাঝেই তাকে ছড়ায় নিয়ে আসি। আমার পুষি বেড়ালটা না অতিরিক্ত পাকা / ওর জন্যই অসম্ভব আমার নিজের মতো থাকা / এই যেমন পরশু দিন সকালে/ ভাবছি কোথাও যাব নাকি বিকেলে/ পুষি বলল, বাজার যাব, দাও ব্যাগ আর টাকা!
     এই রে যথারীতি আমি পুষি নিয়ে পড়লাম। আমাদের জীবনে একটু পুষি, একটু খুশি, একটু জেদী স্বভাব আর অনেকখানি অভাব ছাড়া আছেটা কী? প্রতি দিন কত ঘষা খেতে হয়। খালি পায়ে অদৃশ্য মরূভূমির ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। শরীর-মন পুড়ে যায়। তাই বলে মনকে পুড়িয়ে ফেলা চলবে না। এটা ঠিক যে জীবন আমাদের অনেক কিছুই দেয়নি। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সেটা মনে রাখলে বেঁচে থাকা অসহনীয় হয়ে উঠবে। তাই নিজের বেঁচে থাকার জন্যই মায়ার আশ্রয় নিতে হয়। কল্পনার হাত ধরতে হয়। হ্যাঁ, যথাসাধ্য গম্ভীর কবিতা লিখি বটে যদিও ক'জন সেই সব লেখাকে "কবিতা" মনে করেন জানি না। নিজের কবিতাকে বোদ্ধারা কী ভাবে নিচ্ছেন, কখনো কী কেউ আমাকে 'শক্তিশালী কবি' বলে মনে করবেন, মৃত্যুর পর আমার লেখা কেউ পড়বেন কী না... অত ভাবলে তো লেখাই হ'বে না। এই জন্মে জীবিত অবস্থায় কত জন আমার কবিতা পড়েন তারই ঠিক নেই তো মৃত্যুর পরে! 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
        আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমার কবিতার মধ্যে মোটেই শুধু চাঁদতারা আর কল্পনা ঘাঁটি গেড়ে থাকে না। থাকে জীবন ও কর্কশ বাস্তব সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গী। তবে আমি বা এ যুগের কোনো কবিই ব্যতিক্রম নই। কোন্ যুগেই বা কবিরা শুধু চাঁদ, তারা, ফুল আর সোনালী স্বপ্ন পূরণের কথা লিখেছেন? কোনো যুগেই নয়।
       বাঙালির সবচেয়ে পুরনো কবিতা চর্যাপদে আমরা লোক সমাজের দৈনন্দিন জীবনের ছবি পাই। চর্যাপদ বাঙালি জাতির প্রথম সাহিত্য নিদর্শন হিসেবে মান্যতা প্রাপ্ত এবং সেখানেই বাস্তবের স্পর্শ প্রকট। তাই বললে ভুল হ'বে না যে জন্মলগ্ন থেকেই বাংলা কবিতা বাস্তব অনুসারী।  "আচরণীয়" শব্দটি থেকে চর্যাপদ এসেছে। মূলত চর্যাগীতি নামেই এই পুঁথি পরিচিত। তার কারণ প্রাচীন যুগে কবিতা গানের মতো গাওয়া হ'ত, এমনি এমনি অর্থাৎ বিনা সুরে পঠিত হত না। কোথাও কোথাও এই রেওয়াজ এখনো অল্প একটু রয়ে গেছে। আজ থেকে অনেক অনেক শতক আগে দশম-একাদশ-দ্বাদশ শতকে চর্যাপদ রচিত হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। পদ রচয়িতারা ছিলেন বৌদ্ধ। তখন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের বিরাট প্রভাব ছিল।
          চর্যাপদের হেঁয়ালিপূর্ণ ভাষাকে "সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা" বলা হয়। এই সব পদে নদনদী, নৌ বাণিজ্য ও জলদস্যুদের হানা সম্পর্কেও অনেক কথা বলা হয়েছে। মোট কথা কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, লুইপাদ প্রমুখ চর্যাপদ রচয়িতারা গুহ্য সাধনার উপযোগী আলো- আঁধারি ভাষায় কাব্য রচনা করলেও বাস্তব জীবন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুধুই কল্পনা নিয়ে পড়ে থাকেননি। চর্যাপদে আমরা পাই, "টিলার ওপরে ঘরটি, সেখানে হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ গৃহে রোজ অতিথি আসেন। ঘরের আঙিনায় তেঁতুলগাছ অথচ সে গাছের ফলে গৃহস্বামীর অধিকার নেই।" আবার বাহন হিসেবে রথ, হাতি ও নৌকোর উল্লেখ রয়েছে।
      চর্যাপদ যে ভাষায় লেখা তা বাংলা ভাষার একদম পুরনো রূপ। সবে তখন আমাদের ভাষার উদ্ভব হয়েছে। এ ভাষাকে বাংলা বলা যাবে কী না তা নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছিল। বিস্তর বাদানুবাদের পরে পন্ডিতেরা সিদ্ধান্তে আসেন এগুলির ভাষাকে বাংলা বলেই স্বীকার করতে হবে। 
     প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবন চর্যাপদে ভালো রকম ফুটে উঠেছে। পদগুলো পড়লে দেখা যায়,  বিনোদন বলতেও অনেক কিছু ছিল সে সময়ে। চর্যায় নয়বল বা দাবা খেলার উল্লেখ আছে। আছে তাঁতী, শবর, মাহুত, ব্যাধ, শুঁরি, কাপালিক প্রভৃতি জাতি-গোষ্ঠীর উল্লেখ। 
     তারপরে মঙ্গলকাব্যের কথাও ধরুন না। ষোড়শ শতাব্দীতে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য লিখতে বসে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এক জায়গায় বলছেন, "শিশু কাঁদে ওদনের তরে" অর্থাৎ বাচ্চা ক্ষিদেয় কাঁদছে। যুগ প্রতিষ্ঠা হয় এই পংক্তিতে। "ফুল্লরার বারমাস্যা"ই বা কে ভুলতে পারে? নিজের সময়ের আসল ছবি এঁকেছেন মুকুন্দরাম। যুগ ও লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করে নিখু্ঁত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। বাস্তব-বর্জিত কাব্য লেখেননি। তাঁর কাব্যের এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে আধুনিক কবিদের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলা ভাষার শক্তিশালী কবিদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর সমাজসচেতনতা ও নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এত বেশি যে ঔপনাসিকদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পার্থক্য নেই বলেও বোদ্ধাদের ধারণা। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে আমার প্রণাম।
      ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে গেল। আসলে আমার জীবনে অনেক জায়গায় না পাওয়ার গর্ত আছে। সে সব গর্ত এ জন্মে পূরণ হওয়ার নয়। হৃদয় মাঝেমাঝে হাহাকার করে ওঠে বই কী! তখন ভাবি কী করে কষ্টটা একটু কমানো যায়। কষ্ট আর অপূর্ণ চাহিদাগুলোকে যতটা পারি কলমে আনতে চেষ্টা করি। কবিতা লিখি, ছড়া কী লিমেরিক লিখি। দিন-রাত আমাকে অনেকটা কেটে তারপরে নিজেরাই কেটে পড়ে। এভাবেই স্বভাবে, অভাবে, পুষি, খুশি, কবিতা, গদ্য, ভালোবাসা, অপূর্ণ আশা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা, স্বস্তি আর অসোয়াস্তির স্রোতে ভাসতে ভাসতেই এক দিন মরণ নামে সেই গভীর পরিণতিতে মিশে যাব। জীবনের সব স্রোত তো ওই মোহনা লক্ষ্য করেই প্রবাহিত হয়।

🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  : হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments