দেশান্তরী -১৭ /হিল্লোল রায়
কথার ভিতরে কথা, খুঁজে ফিরি হেথা হোথা
ইনকাম ট্যাক্স ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য কাগজপত্র বিশেষ করে স্পনসারশিপ সার্টিফিকেট ইত্যাদি নিয়ে আবার গেলাম এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে। মিঃ বর্ধন দেখলেন সব কাগজপত্র।
-এভরিথিং.... ওকে!
মিঃ বর্ধনকে বিদায় জানিয়ে গেলাম সি এম পিও গার্সটিন প্লেস অফিসে। বড়মামা, রণেন ব্যানার্জ্জী-র সংগে দেখা হল। আমরা তিনজনে বসে তখন প্লেনের টাইম টেবল তৈরী করছি। দেখলাম রণেন ব্যানার্জ্জীর উৎসাহ আমার থেকে কোনো অংশেই কম নয়। উনি নিজেই বসে ছক তৈরী করে ফেললেন।
বড়মামার কাজের চাপ থাকায় রবীন্দ্র সরণী কলকাতা-১ অফিসে চলে গেলেন। আমি ও রণেন ব্যানার্জ্জী দুজনে বসে টাইম টেবল করে নিলাম। তারপর মিঃ ব্যানার্জ্জীর সংগে চলে এলাম এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে। ওখান থেকেই মেজ মামাকে telex করার ব্যবস্থা করা হল।
আবার একা ফিরে গেলাম সি এম পিও র অফিসে। বড়মামার সংগে বিস্তারিত আলোচনা করলাম বিকাল সাড়ে পাঁচট নাগাদ। সঞ্চয়কে ওর অফিসে টেলিফোনে পেলাম না... আর্গোসিতে খবর দেওয়ার জন্য যে, আজ রাত্রে পাইকপাড়া থাকব। বড়মামার সংগে পাইকপাড়ায় চলে এলাম রাত ৮-৩০টায়। ভীষণ ক্লান্ত আজ সারাদিনের ছোটাছুটির পর।
এরপর মার্চ ১৩, ১৯৭৫ হাবড়া থেকে পাইকপাড়ায় এলাম। বিদেশে আসবার আগে যে জিনিষ সংগী হবে তাদের ভার লাঘব করার জন্য কিছু অংশ এদিন পাইকপাড়ায় নিয়ে এলাম। দুপুরে বিশ্রাম! ঘুম থেকে উঠলাম বিকাল সাড়ে চারটেয়। আমার ছোটমামা তুষারের সংগে সন্ধ্যাবেলা বেরিয়ে পড়লাম জুতো কিনতে। কলেজস্ট্রীট 'বাটা' থেকে “ambassador” জুতো কিনে নিলাম ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা (৮৪.৯৫+ট্যাক্স ৭ টাকা)। তারপর চা-টা খেয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে পাইকপাড়া ফিরে এলাম রাত ৮-৩০। খাওয়া -দাওয়া, গল্প-গুজব করে রাতটা বেশ কেটে গেল।
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ১৯৭৫ সকাল ৬-৩৫ এ ঘুম থেকে উঠতেই কর্মব্যস্ততা শুরু হল। আমার অফিসে আজ দর্শন দেব ঠিক করেছি কিন্তু বাড়ী থেকে বেরিয়ে শ্যামবাজারে আসতেই দেখি, সমস্ত যানবাহন বন্ধ। রাজনৈ্তিক দলাদলির পরিণাম। হাজার-হাজার লোক রাস্তায় আটকা পড়ে গিয়েছেন। কোনরকমে ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষার পর শ্যামবাজার থেকে ৪নং ট্রামে চেপে ডালহৌসী চলে এলাম ঠিক ১-৩০টায়। এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে মিঃ বর্ধনের সংগে দেখা করলাম। মিঃ বর্ধন বল্লেন, PTA Section (Prepaid Ticket Advice) এ মিঃ পি এ সীতাপতি কিংবা এস. বিশ্বাসের কাছে খোঁজ নিতে আমার “telex” এর খবরাখবর নেওয়ার জন্য। জবাব পেলাম, ওঁরা এখনও কোন উত্তর পায় নি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ২-১৫ নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়ার অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পায়ে হেঁটে সি এম পিও -র অফিস। বড়মামার দেখা পেলাম বিকাল ৪-১৫ নাগাদ। সমস্ত ব্যাপার খুলে বল্লাম বড়মামার কাছেই। তারপর বেরিয়ে পড়লাম।
শিয়ালদা থেকে ট্রেণ ধরে বাড়ি ফিরতে ৫-৪৫। বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম। শনিবার মার্চ ১৬, ১৯৭৫ আর্গোসি থেকে ৯-২৪ এর ট্রেণ চেপে গতানুগতিক পদ্ধতিতে আমার অফিস চলে এলাম ১১-৪৫ নাগাদ। অফিসে কোনই কাজ নেই। কোন রকমে সময় কাটিয়ে ৩-৫০ এ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
অফিসের মাইনে আজও হল না। অথচ মাসের অর্ধেক হয়ে গেল। মনটা খুবই খারাপ লাগছে। ফেব্রুয়ারী মাসের মাইনে এখনও দেয় নি। হাবড়া ফিরলাম ৫-৫০। বিশ্রাম করে চা খেয়ে “ইউনিক টেলর্স” এ আমার প্যান্ট ডেলিভারী নিতে গেলাম। ওখান থেকে প্যান্ট নিয়ে আর্গোসিতে ফিরে এলাম ৮-৫০ নাগাদ। তারপর গল্পগুজব -খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম।
আমেরিকা পাড়ি দেবার দিন ক্রমশই এগিয়ে আসছে। তাই সবার সংগে দেখা সাক্ষাৎ করতে হবে মনে মনে স্থির করে রেখেছি। রবিবার মার্চ ১৬, ১৯৭৫ আর্গোসিতে ঘুম থেকে উঠলাম সকাল ৬টায়। চা-খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সংগে দেখা করতে সকাল ৭-১৫ নাগাদ।
স্কুলের বন্ধু দু-একজনের সাথে দেখা হল পথে। কবিরাজ ভারতচন্দ্র দত্ত(অরবিন্দ রোড, হা্বড়া) , বিনয় মজুমদার , সন্তোষ ঘোষ (বিদ্যাসাগর রোড) , সুকুমার চট্ট্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সবার সংগে গল্প করলাম। সবার চোখেই জল।
আমার আমেরিকা আসবার ব্যাপারে দেখলাম মা-দাদু-দিদিমা ছাড়াও আমার বন্ধুদের চোখেও জল।
-আবার কবে দেখা হবে তোমার সঙ্গে জানি না। ততদিন আমি বেঁচে থাকব কি না কে জানে? বললেন কবিরাজ ভারত চন্দ্র দত্তের স্ত্রী অর্থাৎ আমার বন্ধু শেখর দত্তের ঠাকুরমা।
-তুমি বড় হও, অনেক বড় হও, জীবনে সুখী হও, সুপ্রতিষ্ঠিত হও। আশীর্বাদ করলেন শেখরদার মা।
ওঁদের বাড়িতে সবার মাঝে আমি দাঁড়িয়ে, আমিও কাঁদছি, ওঁরাও কাঁদছেন। শেখরদার ছোট বোন রমার চোখ অশ্রুসজল; ওনাদের বাড়ী থেকে আমি চলে আসবার আগে হঠাৎ আড়াল পেয়ে এক টুকরো কাগজ হাতে গুঁজে দিল, আমি প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু রমা কাগজ টুকরোটা দিয়েই চোখ মুছতে মুছতে ভেতরে চলে গেল। আমার সংগে কিন্তু কোনদিনই কথা হয় নি রমার সাথে। মা -ঠাকুরমা-র জন্য হয়ত সে মুখে কিছু বলতে পারল না। আমিও হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম মাথা নীচু করে। এরকম একটা ঘটনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাই মনটা বেশ ভারী হয়ে উঠল হঠাৎ।
শেখরদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এবার গেলাম আমার স্কুলের বন্ধু নারায়ন মজুমদারের বাড়ীতে। ওঁর দাদা বিনয় মজুমদার বাড়িতেই ছিলেন। নারায়নের মা-বৌ্দি আমার চলে আসার কথা শুনেই কাঁদতে শুরু করেছেন।
-তুমি না এলেই ভালো ছিল, তোমাকে আমরা প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি। তুমি কতদূর দেশে চলে যাবে; কত বছর তোমাকে দেখব না। গিয়ে চিঠিপত্র দিও। আমদের ভুলে যেও না। -বল্লেন নারায়নের বৌ্দি। ওঁর মা কথাই বলতে পারছিলেন না। পরে আমার মায়ের কাছে জেনেছিলাম ওরা নাকি ঠিক করে রকেহেছিলেন ওদের ছোট মেয়ের(সুদেষ্ণার জন্য)। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই সুদেষ্ণা আমার মাকে নাকি বলেছিল যে, মিন্টুদাকে(আমার ডাক নাম) আমার খুব ভাল্লাগে। মায়ের ও ওকে ভাল লাগত কিন্তু তখন আমাদের আর্থিক অবস্থার জন্য মা কিছু মুখে বলেন নি কাউকে। নারায়নের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এবার যাব ঠিক করেছি শ্রীযুক্ত সন্তোষ ঘোষের বাড়িতে সঞ্চয়ের কাছে ।
বিদ্যাসাগর রোডে সঞ্চয়ের বাড়ী। ওঁর মা কে প্রণাম করতেই......
-থাক, থাক বাবা। বেঁচে থাকো, বড় হও, জীবনে উন্নতি করো। তুমি চলে গেলে সঞ্চয়ের অবস্থা তো খুব খারাপ হয়ে যাবে। ও তোমার উপর ভরসা করে। আর তুমি আজ কতদূরে চলে যাচ্ছো। মনে রেখো আমাদের কথা। ধরা গলায় বললেন সঞ্চয়ের মা। উনিও খুব দুঃখ পেয়েছেন, আমার চলে আসার সংবাদে। বেশ বিমর্ষ মনে হচ্ছিল চোখ-মুখ দেখে।
এরপর গেলাম সুকুমার চট্ট্যোপাধ্যায়ের বাড়ীতে। সুকুদার সংগে অনেক গল্প হল, সবার সংগেই গল্প করলাম। সবাই দুঃখিত আমার দীর্ঘ অদর্শনের কথা ভেবে।
দেখা সাক্ষাৎ শেষ করে আর্গোসিতে ফিরে এলাম ১২-৩০। স্নান-খাওয়া সেরে বিশ্রাম বিকাল ৪টে পর্যন্ত। বিকেল ৫টা নাগাদ আমার বি ই কলেজের বাক্সখানা(Pandoras Box ) খুললাম। সে কী বিরাট অভিজ্ঞতা । আজ ও আমার মনে হলে নিজে নিজেই হাসি আমার কান্ড কারখানা ভেবে। একটু ছোট করে শোনাই …...
আমি তখন বি ই কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র । থাকি ৭ নং হোস্টেলের রুম নং ৩১১ -এয় ।
আমার রুমের অসিত মাইতির মাথায় ভূত চাপলো কি?
-বুঝলি? একটা মেয়ে পেন ফ্রেন্ড চাই আমার ভালো রেজাল্ট করার জন্য।
আমরা ৬ বন্ধু উদ্গ্রীব। কোথায় পাবো ওর পেনফ্রেন্ড? পেয়ে গেলাম পাশের ঘরের অমিত মুখার্জ্জীকে।।আমাদের চেয়ে আরেক ধাপ উঁচুতে সে ছিল। আমাদের বল্লঃ
-নো চিন্তা, ডু ফূর্তি। আমার কাছে সলিউশন আছে।
সবাই চিৎকার করে উঠল...-তাড়াতাড়ি বস!
-আমার কাকার বাড়ী ৪নং শ্রীরামচন্দ্র ঢ্যাং লেন, হাওড়া। সেখানে একটি ভাড়াটিয়ার মেয়ে আছে নাম তার মিতা সোনি, খালি উশখুশ করে প্রেমের জন্য। অসিতের পক্ষে এই মেয়েই উপযুক্ত।
-চলো কাম মে লেগে পড়ো। আমি হ্যায় পাশে তোমাদের।
অসিত কে মিতা সোনির নাম বলতেই কেমন যেন স্বপ্নালু হয়ে উঠল। এবার তাকে চিঠি লেখার পালা।
বলা হল অসিতকে চিঠি লেখার জন্য। সে তো রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চিন্তা ভাবনা করে চিঠি লিখে আমাদের আড়ালে চুপি চুপি অমিতের হাতে দিল মিতার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য...অমিত এর হাত ঘুরে সেই চিঠি গিয়ে পৌঁছালো হিল্লোল রায়ের হাতে, কারণ সেই একমাত্র যে কোন হাতের লেখাকে অনুলেখন হিসেবে নাম করে ফেলেছে কলেজে।
হিল্লোল রায় তো ঘেমে টেমে একসা। যাই হোক সবার জোরাজুরিতে রাজি হতেই হল...।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে তার কাজ হল মশারীর মধ্যে বসে মিতা সোনি হওয়া...লেখা শেষে সবার সেই মিতা সোনির চিঠি পড়া হয়ে গেলেই গ্রীণ ট্রাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে চিঠি গিয়ে পৌঁছালো অসিতের হাতে রবিবার রাত ১২টায়।
অসিতের চোখ তখন প্রেমে ঢুলুঢুলু। এভাবে চলল অসিত আর মিতা সোনির প্রেম পর্ব।
আজ ভাবতে খারাপ লাগে সাধু অসিত চিঠির ভাবধারা পড়ে আনন্দে আমাদের বাইরে খাওয়াতো। আমরা সবাই আমাদের ফাইনাল ইয়ারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু অসিত আর মিতা সোনির চুটিয়ে প্রেমের কাহিনি বিয়ের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তারপর জানি না সত্যি অসিত তার মিতা সোনিকে খুঁজে পেয়েছিল কিনা। আমরা সবাই নিজেদের ভবিষ্যতের পথে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আজ ভাবতে খারাপ লাগছে এসব লেখা চিঠি পড়ার পর...
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি(মিতা সোনি)চিঠি লেখার পান্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেললাম। আজ থাকলে হয়ত হুবহু কী লিখেছিলাম লিখতে পারতাম। আর দেরী না করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সার্টিফিকেটস, মার্কশীট ইত্যাদি বার করে গুছিয়ে নিলাম।
সন্ধ্যা ৬টায় সঞ্চয় এলো আর্গোসিতে। লোড শেডিং এ চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আমি ও সঞ্চয় বেরুলাম সান্ধ্যভ্রমণে ৭-৩০ টায়। ফিরলাম রাত ৯-৩০। খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে গেলাম ১০-৩০। রাতের বিশ্রাম।
সোমবার ১৭ই মার্চ, ১৯৭৫ আর্গোসি থেকে ৮-৩৬ এর হাবড়া লোক্যালে বেরুলাম। এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে গিয়ে টেলেক্স সংক্রান্ত ব্যাপারে খোঁজ নিলাম। ওঁনারা এখনও নিরুত্তর । গেলাম সি.এম.পি.ও অফিসে।
আজো জ্বলে সেই প্রদীপ “শিখা” মোর প্রবাসী হিয়া মাঝে
বড়মামা তখন ১৮ এ, রবীন্দ্র সরণীর অফিসে। গার্সটিন প্লেস অফিস থেকে ওখানে টেলিফোন করলাম বড়মামাকে। জিনিষপত্র কিনবার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে হবে এ খবরটা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বড়মামাকে টেলিফোন করা।
সি এম পি ও অফিসে অন্যান্য সবার সংগে কিছুক্ষণ গল্প করে ফোন করলাম সেন্ট্রাল একসাইজ ইন্সপেক্টর শ্রীযুক্ত পরিমল মুখার্জ্জীকে (প্রদীপ মুখার্জ্জীর বাবা) এবং সঞ্চয় ঘোষকে। সি এম পিও থেকে বেরিয়ে এলাম বেলা দেড়টায়। ট্রামে চেপে শিয়ালদা। ওখানে থেকে ২-২০ র ট্রেণ ধরলাম। কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ট্রেণ ছাড়লো ৩-১৫।
ঠিক করেছি চাঁদপাড়ায় গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসব আজ অর্থাৎ মার্চ ১৭, ১৯৭৫ সোমবার।
প্রদীপদার সংগে আমার বন্ধুত্বটা একটু গভীরতম সামাজিক সম্পর্কের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। চাঁদপাড়ায় প্রদীপদার বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছালাম বিকেল পাঁচটার কাছাকাছি। বাড়ীতে কেউ নেই। প্রদীপদার ছোট বোন শিপ্রা্র সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প করলাম।
-দিদির (শিখার) ভীষণ মন খারাপ আপনি চলে যাচ্ছেন বলে।
-দিদি কোথায়? জিজ্ঞাসা করলাম।
-আবার কবে আসবেন? দিদিকে আদৌ মনে রাখবেন কিনা, আর একটা কথা বলে রাখি ও আপনাকে খুব ভালবাসে (মিন্টুদা) দিদি আপনার চলে যাবার খবর শোনার পর থেকেই কিন্তু খাওয়া -দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ওকে প্লিজ ভুলবেন না। আর কি বলব-ও কিন্তু আপনাকে খুউব ভালবাসে। সেটা আমি যতটা জানি আর বোধহয় কেউ এতখানি জানে না, যদিও বাড়ীর সবাই জানে কিন্তু কারুর কিছু করার আর কি আছে? বলুন মিন্টুদা? আপনি সাবধানে যাবেন। আমাদের চিঠির জবাব দেবেন? বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল শিপ্রা।
আমি সান্ত্বনা দেব কি? আমারও মনটা হু হু করছিল তখন কিন্তু আমার আবেগ চেপে রেখে শিপ্রাকে সান্ত্বনা দিলাম,
-নিশ্চয়ই চিঠি দেব এবং তোমাদের চিঠির উত্তর দেব। দুঃখ কোর না। তোমার দিদির সাথে কি একটুও দেখা হবে না যাবার আগে?
-না-ই ধরে রাখুন। খুব ভেঙ্গে পড়েছে। তাও আমি বোঝাবো ওকে, আপনাদের দেখা করার ব্যবস্থা আমি আর দাদারা মিলে করার চেষ্টা করব।
যদিও আমার একটু দুর্বলতা ছিল শিখার প্রতি এবং আমাদের বাড়ির সবাই সেটা জানত। মা এর খুবই পছন্দ ছিল আমার এই পছন্দের শিখাকে। কিন্তু তখন আর্থিক অবস্থার বিপাকে মা আর ভরসা রাখতে পারেন নি।
আমি বলেছিলাম মা -কে যে, শিখাকে বিয়ে করে তোমার কাছে রেখে যাই। তারপর আমি নিজের পায়ে একটু দাঁড়িয়ে নিয়ে যাব সাথে করে। শিখা শুধু সুন্দরী ছিল তা নয় তার ছিল একটা খুব সুন্দর মন। বড়লোকের মেয়েদের যে দেমাক থাকে সেটা ওর মধ্যে আমি দেখতে পাই নি কোনদিনই। যদিও বেশী মেলামেশা করার সুযোগ পাই নি, তবু যে টুকু পেয়েছি সেটুকুই আমার মনে গেঁথে গেছিল কারণ আমার মতন সাধারণ ছেলেকে কেন এত নিজের করে ভেবেছিল এবং তার সেই ভাবনা সে নিজের মধ্যে না রেখে বাড়ির সবার কাছে প্রকাশ করেছিল।
শিপ্রা আমাকে কিছুদূর এগিয়ে দিল। আমিও চাঁদপাড়ার/ মাটিতে শেষ পা রেখে তখনকার মত ফিরে এলাম। মন খুব খারাপ লাগছিল এত কেন নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ি ফিরলাম ভাঙ্গা মন নিয়ে ৭-৩০।
বাড়ী ফিরে খুব অস্বস্তি লাগছিল। শিখার সংগে দেখা করতে পারলাম না ভেবে মনটায় কেমন যেন একটা মোচড় দিতে শুরু করল, কিছুক্ষণের জন্য আমেরিকা যাওয়াটাকে বিষাক্ত লাগছিল। রাতে খাবার না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম আজ একটু তাড়াতাড়ি, মা একটু আঁচ করলেও মুখে আর কিছু বলেন নি... না বলতে সাহস পান নি।
বিছানায় শুয়ে ভাবতে শুরু করলামঃ আমেরিকা থেকে কত বছর পরে দেশে ফিরব কে জানে? ততদিনে শিখাও হয়ত বদলে যাবে সম্পূর্ণভাবে। মনের ব্যথা কিছুতেই কমাতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন কিছুই করণীয় নেই, তখন দুঃখ পেয়ে কী লাভ? মন শক্ত করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে শিখাকে মর্যাদার সাথে নিয়ে যাব এই সিদ্ধান্তে মনটাকে শক্ত করলাম। স্থির লক্ষ্যে আমাকে এগুতেই হবে। রাতটা কোনরকমে কেটে গেল।
মংগলবার, মার্চ ১৮, ১৯৭৫ হাবড়া থেকে ৭-১২ ট্রেণ ধরে পাইকপাড়ায় বড়মামার বাসায় চলে এলাম সংগে জিনিষপত্র নিয়ে। সকাল ৯-১৫ নাগাদ পৌঁছালাম পাইকপাড়ায়। কি কি জিনিষ কিনেছি এবং আর কি কি লাগবে-তাই নিয়ে বড়মামার সংগে আলোচনা করে লিস্ট তৈরী করে ফেললাম। ছোটমামা তুষার একটা দুশো টাকার চেক দিল ওটাকে ক্যাশ করার জন্য। আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্ক, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট, কলকাতা -১ এ যেতে হবে। প্রায় ১০-৩০ এ পাইকপাড়া থেকে বেরিয়ে উক্ত ব্যাঙ্কে গিয়ে ক্যাশ করলাম ১১-৩০ নাগাদ।
ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে আয়কর ভবনে ওখানে সবার সংগে দেখা করলাম ১১-৩০ নাগাদ। কিন্তু শান্তিমামার দেখা পেলাম না। আয়কর ভবন থেকে ১-৩০ নাগাদ বেরিয়ে পায়ে হেঁটে সঞ্চয়ের অফিসে।
সবার সংগে হৈ চৈ, গল্পগুজব, চা খাওয়া। প্রায় ২-৩০ নাগাদ ওখান থেকে বেরিয়ে এসপ্ল্যানেডে এসে একাই জিনিষপত্র কেনা শুরু করলাম। মার্কেটিং শেষ করতে বিকাল চারটে। গেলাম এয়ার ইন্ডিয়া অফিস।
ক্রমশঃ
0 Comments