জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—সুমাত্রা (এশিয়া)/মা-বাবাকে অশ্রদ্ধা কোর না /চিন্ময় দাশ


দূরদেশের লোক গল্প—সুমাত্রা (এশিয়া)
মা-বাবাকে অশ্রদ্ধা কোর না

চিন্ময় দাশ

উত্তর সুমাত্রার পাদাঙ লাওয়াস এলাকা। এক বুড়ি মা থাকে তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। ভারি গরীব মানুষ তারা। মালিকের খামারে গতর খাটিয়ে পেট চলে তাদের। মা-ছেলে দুজনেই যেমন সৎ, তেমনি কর্মঠও। মালিকের ভারি পছন্দ দুজনকে। 
একদিন ছেলে একা এসেছে খামারবাড়িতে। মালিক ডেকে বলল—সম্পুরাগা, একটা কথা বলি তোমাকে। তুমি যেমন কর্মঠ, তেমনই সৎ। এখনও যথেষ্ট বলবানও তুমি। আমার এই খামারে পড়ে থেকে, জীবনে কী এমন উন্নতি করতে পারবে তুমি?
সম্পুরাগা বলল—আমাদের তো আর কোন উপায় নাই, মালিক। কী আর করব?
--কেন, ম্যাণ্ডেলিঙ এলাকার কতোজনই তো সোনা ছাঁকার কাজ করে। শোনা যায়, হাত ভরে পয়সা কামানো যায় তাতে। সে কাজে যাও না কেন? পুরোটা জীবন পড়ে আছে এখনও তোমার সামনে।
মালিকের কথা শুনে চমকে গেল সম্পুরাগা। চোখ দুটো চকচক করে উঠল তার। মনে ভারি আশাও জাগল। দুটো পয়সা বেশি উপার্জন করতে পারলে, মাকে সুখের মুখে দেখাতে পারবে সে। 
মালিককে বলল—ঠিক কথা। বাড়ি গিয়ে এখুনি মায়ের সাথে কথা বলছি আমি।
মালিক আশার আলো জ্বেলে দিয়েছে ছেলেটার মনে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সম্পুরাগা। সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি এসে, মালিকের কথাগুলো জানাল বুড়ি মাকে। 
ছেলেকে ছেড়ে দিতে হবে ভেবে, বুক মুচড়ে উঠল মায়ের। কিন্তু চোখে বা মুখে, তার সামান্য ছবিও ফুটতে দিল না বুড়িমানুষটি। ছেলেকে বলল—বাবা সম্পুরাগা, অভাব ছাড়া, তোমাকে আর কিছু দিতে পারেনি তোমার এই বুড়ি মা। আজ যদি সুখের সন্ধান পেয়েছ, আটকে থেকো না এখানে। বেরিয়ে পড়ো। মায়ের আশীর্বাদ রইলো তোমার মাথায়। দেখো, অবশ্যই সুখী হবে তুমি। 
ছেলে বলল—তোমার আশীর্বাদে সত্যিই যদি সুখের সন্ধান পাই, ফিরে আসবো এখানে। নিয়ে যাবো তোমাকে। 
--তাই হোক বাবা, ভগবান তাই করুন। আমিও পথ চেয়ে থাকব তোমার। মা বলল, চোখের জল মুছতে মুছতে। 
ম্যাণ্ডেলিঙ-এর পথ ধরে চলেছে সম্পুরাগা। অভাবী বুড়ি মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া, কোন সম্বল নাই তার সাথে। যেতে যেতে একটা গঞ্জ মতো জায়গা। এক রাজার বাস সেখানে। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
সুঠাম দেহী, সুন্দর দর্শন যুবক সম্পুরাগা। ভিন এলাকার এই যুবক পড়ে গেল রাজার লোকেদের চোখে। তারা সোজা নিয়ে গিয়ে হাজির করল দরবারে। 
ছেলেটা একটু ঘাবড়ে গেল। মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়েছিল । হঠাৎ এমন সঙ্কট কেন? দুরু-দুরু বুকে গিয়ে দাঁড়াল রাজার সামনে। 
সম্পুরাগা জানে না, কোনও বিপদের সামনে পড়েনি সে। বরং সৌভাগ্যের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়ে গেছে আজ। সোনা ছাঁকবার কষ্টের কাজ নয়। উলটে তার জন্য অনেক সুখের রসদ মুঠোয় নিয়ে বসে আছে রাজামশাই। 
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক পরিচয় নেওয়া হোল। রাজা আর মন্ত্রী শলা-পরামর্শ করল। সম্পুরাগাকে ব্যবসা-বাণিজ্য দেখভাল করবার দায়িত্ব দিল রাজা। 
সম্পুরাগা ছোট থেকেই যেমন কর্মঠ আর উদ্যমী, তেমনই নির্লোভ আর সৎ। কিছুদিন না যেতেই, রাজার নেকনজরে পড়ে গেল সম্পুরাগা। সততার মূল্য সকলেই দেয়। রাজাও দিল। ব্যবসার অংশীদারী দেওয়া হোল তাকে। আর দেওয়া হোল ব্যবসা চালানোর সম্পূর্ণ ক্ষমতাও।
বছর ঘুরতে পেল না। সম্পুরাগা নিজেও বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে উঠল। এখন রাজ্যের সকলেই পছন্দ করে তাকে। সকলের মুখে মুখে তার সুনাম।
রাজার ঘরেও আলোচনা হয় সম্পুরাগাকে নিয়ে। একটিই মেয়ে রাজার। সে একদিন বাবার গলা জড়িয়ে আবদার করল—বাবা। আমি সম্পুরাগাকে বিয়ে করব।
--কী বলছিস তুই, মা? রাজা পড়ল আকাশ থেকে। কোন রাজপরিচয় নাই এ ছেলের। তার হাতে মেয়ে দেব? 
শুনে, রানিমা ঝাঁজিয়ে উঠল—রাজ পরিচয় নিয়ে ধুয়ে খাবো না কি আমরা? খুবই ভালো ছেলে । সম্পুরাগার সাথে বিয়ে হবে আমার মেয়ের। দেরী করা চলবে না। ব্যবস্থা করো তুমি। 
সব মায়েদের মন যেমন হয় আর কি? রাজামশাই কী আর করে? রাজি হয়ে গেল। কিন্তু রাজার মেয়ের বিয়ে বলে কথা। জোগাড়-যন্তর আছে। সময় তো একটু লাগবেই। ঠিক হোল, এক চাঁদ (১৫ দিন, বা এক পক্ষকাল) পরে বসবে বিয়ের আসর।
লোক ছুটল চার দিকে। গাঁয়ে গাঁয়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হোল বিয়ের খবর। প্রজারা সবাই নেমন্তন্ন খাবে রাজার বাড়িতে।
রাজার পেয়াদা ঢেঁড়া পিটিয়ে গিয়েছে সম্পুরাগার নিজের গ্রামেও। খবর শুনে, তার বুড়ি মা পড়ে গেল দোটানায়। নাম তো সম্পুরাগা। কিন্তু সে কি তার নিজের ছেলেটি? তা কী করে হয়? ছেলে তো বলে গিয়েছিল, সুখের মুখ দেখলেই ফিরে আসবে। নিয়ে যাবে তার দুঃখিনী বুড়ি মাকে! 
তার নিজের ছেলেই যদি রাজার হবু জামাই হয়, তাহলে সে এলো না কেন? নিজের মাকে একটা খবরও দিল না কেন? না কি, একই নামের অন্য কেউ?
ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে গেল বুড়ি। শেষে ঠিক করল, রাজা তো নেমন্তন্ন করেইছে। যাওয়াই যাক একবার। নিজের চোখেই দেখা যাবে পুরো ব্যাপারটা।
বুড়ো মানুষ। সময় লাগবে অতটা পথ যেতে। ক’দিন আগেই বাড়ি থেকে বের হোল বুড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে একদিন বুড়ি সেই গঞ্জে এসে হাজির। সেখানে এসে তো তার চোখ গোল গোল। গোটা শহরটা সেজে উঠেছে উৎসবের জন্য। বিয়েবাড়ির এমন এলাহি আয়োজন! সে গরীব মানুষ, দেখবে কী করে? বিয়েবাড়ি এমন আড়ম্বরের হতে পারে, কারও মুখে কোন দিন শোনেওনি জীবনে।
বিয়েবাড়ির ভোজসভার দিন। হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে আসরে। ভেতরে হলঘরে অভিজাতদের জমায়েত। বুড়িও ঢুকে পড়ল সেখানে। 
আড়ালে থেকে বিধাতা পুরুষ যে হেসে উঠলেন, কেউ জানতেই পারল না। না জানল ছেঁড়াখোঁড়া পোষাক পরা এক বুড়িমানুষ। না জানল, ঝলমলে পোষাকে নতুন বউকে পাশে নিয়ে সিংহাসনে বসে থাকা, সম্পুরাগা নামে হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা এক যুবকও। 
মনের সন্দেহ দূর করতে হবে আগে। ভীড় ঠেলেঠুলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল বুড়ি। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। সাজগোজ করে, নিজের রাজকন্যা বউকে পাশে নিয়ে, সিংহাসনে যে সুদর্শন যুবকটি বসে আছে, সে তো সম্পুরাগাই। তার নিজের পেটের ছেলে সম্পুরাগা।
আনন্দে বুক ফেটে যাচ্ছে বুড়ির। এত বড়লোক হয়েছে তার ছেলে? এমন অগাধ সুখের সন্ধান পেয়েছে অভাগীর সন্তান? 
বুড়ি আর চুপ করে থাকতে পারল না। চেঁচিয়ে উঠল—সম্পুরাগা! দেখো বাবা, তোমার মাও এসেছে তোমার এই শুভ দিনে। ছেলের এমন আনন্দের দিনে, কোনও মা কি দূরে থাকতে পারে কখনও?
হলঘর ভরা শহরের অভিজাত লোকজন। গোটা জমায়েতটা স্তব্ধ হয়ে গেল কথাগুলো শুনে। উলুঝুলু পোষাকের বুড়িটির দিকে চেয়ে আছে সবাই। এমন একজন বুড়ি এই আসরে ঢুকলো কী করে?  
সম্পুরাগার পাশের আসনে বসে আছে রাজা আর রানি। রাজার মুখে কথা জোগালো না। একবার শুধু চেয়ে দেখল হবু জামাইয়ের দিকে। 
আনন্দে লাফিয়ে উঠল না সম্পুরাগা। নেমে এলো না মাকে হাত ধরে আসনের দিকে ডেকে নিয়ে যেতে। উলটে চিৎকার করে উঠল—কে তুমি? আমি চিনি না তো তোমাকে। আমার মা তো সেই কবেই মারা গিয়েছে। এমন বিয়ের আসরটাকে নোংরা করে দিলে তুমি? সাহস তো কম নয়? 
আর কিছু বলতে হোল না। সেপাইরা দৌড়ে এল ভেতরে। বুড়িকে টেনে হিঁচড়ে হলঘর থেকে টেনে নিয়ে চলল তারা। বুড়ি তখন চেঁচাচ্ছে—আমি তোমার মা, সম্পুরাগা। এই পেটে ধরেছিলাম আমি তোমাকে। নিজে না খেয়ে, আধ-পেটা খেয়ে বড় করেছি তোমাকে। তোমারই মা আমি, সম্পুরাগা। তোমারই মা। আজ সেই মাকে ভুলে গেলে? আমি যে তোমার পথ চেয়ে বসেছিলাম, বাবা। 
লোকজনের হইহল্লা। চেঁচামেচি। তার মধ্যে এক দুঃখিনী মায়ের বুক ফাটা কান্না চাপা পড়ে গেল।
বুড়িকে ভোজের আসর থেকে বের করে নিয়ে গেল সেপাইর দল। টানতে টানতে রাজবাড়ির চৌহদ্দি ছাড়াল। গঞ্জ ছাড়িয়ে নির্জন পথে এনে ফেলল বুড়িটাকে। ভোজসভার ত্রিসীমানার একেবারে বাইরে। 
 বুড়িকে ফেলে, দরবারে ফিরবার পথ ধরেছে সেপাইরা। খর বেগে বাতাস বইতে শুরু করল। খর বাতাস দেখতে না দেখতে ঝড় হয়ে উঠল। বৃষ্টি নামল মুষল্ধারে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল ঘন ঘন।
চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটল আরও একটা। হুহু করে গরম জলের স্রোত বয়ে এল কোথা থেকে। ভোজসভার মানুষজন পালাতে লাগল হুড়মুড়িয়ে। যে যেদিকে পারল, ছুটে পালাতে লাগল। 
ভদ্রজনদের আসর থেকে নিজের মাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ধাতস্থ হতে একটু বুঝি সময় লেগেছিল সম্পুরাগার। তার উপর, হঠাৎ আসরের ভিতরেই গরম জলের স্রোত ঢুকতে দেখে, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল বোধ করি। 
সিংহাসন ছেড়ে নামল যখন, এক বুক জল সেখানে। হুড়মুড়িয়ে সাঁতরাতে গিয়ে হাবুডুবু খেল প্রথমে। তারপর তলিয়ে গেল জলের তলায়। ‘মা’ বলে ডাকবার সময়টুকুও পেল না, সুখের মুখ দেখা ছেলেটা। 
রাজার বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। সেই মাঠে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছিল বিয়ের ভোজসভা জুড়ে। পুরোটাই তলিয়ে গেল জলের তলায়। দেখতে না দেখতে, গরম জলে থইথই, ছোটখাটো একটা হ্রদই গজিয়ে উঠল সেখানে। 
 
[ উত্তর সুমাত্রার ম্যাণ্ডেলিঙ এলাকায় প্রকৃতই আছে একটি উষ্ণ জলের হ্রদ। হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা, সেই বে-আক্কেলে ছেলের নামেই নাম হ্রদটির—সম্পুরাগা পুল। 
বর্তমানে ম্যাণ্ডেলিঙ এলাকার ‘সম্পুরাগা উষ্ণ কুণ্ড’ একটি পর্যটন ক্ষেত্র। দুনিয়ার সব দেশের পর্যটক সেখানে ভীড় জমায়। ফিরে যাওয়ার আগে, গাইডদের মুখ থেকে সম্পুরাগা নামে বেয়াক্কেলে সেই ছেলের কাহিনী শোনে পর্যটকের দল। 
গল্পটা রূপকথার। তবে, ‘বাবা মা-কে কখনও অশ্রদ্ধা কোর না’-- রূপকথার গল্পের এই নীতিকথাটিকে পৃথিবীর সব দেশে সকলেই গ্রহণ করেছে। 
আমরাও গ্রহণ করতে পারি। ]

Post a Comment

0 Comments