জ্বলদর্চি

আমার রবীন্দ্রনাথ // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ১৯
আমার রবীন্দ্রনাথ // ঈশিতা ভাদুড়ী


'আকাশ ভরা সূর্য তারা' - ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের একুশে বৈশাখ সকালবেলায় গানটি বাজছিল, চারদিন পরেই পঁচিশে বৈশাখ। সেই গান শুনতে শুনতে আমার মা আমাকে জন্ম দেন সকাল আটটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমার জন্মপূর্ব থেকে পরিচয়।
একটু বড় হলাম কি না হলাম, শুনতে থাকলাম - 'মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে / মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/ তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে / দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে/ আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে/ টগবগিয়ে তোমার পাশে, পাশে।' সেই যে শিশুমনে কল্পনার জগৎ খুলে গেল, তারপর সেই 'বিষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদেয় এল বাণ'... 
এরপর স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রকবিতা। ক্লাস সেভেনে স্কুলে ফাংশনে নৃতিনাট্য হল, ‘খর বায়ু বয় বেগে / চারিদিক ছায় মেঘে / ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো’, তালে তালে চন্দনা নাচল। ক্লাস টেনে স্কুলের অনুষ্ঠানে কাজলী আবৃত্তি করল – ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবু্‌জ / চুনি উঠল রাঙা হয়ে। / আমি চোখ মেললুম আকাশে, / জ্বলে উঠল আলো / পুবে পশ্চিমে...’ – অন্তর কেঁপে উঠল সেই কবিতায়। 
সকালবেলায় হারমোনিয়ম বাজিয়ে বোনেরা গাইত ‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে...’ অথবা, ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল-পারা / আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরা তন্দ্রাহারা / আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি / আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা…’
কখনও রেডিওতে গান হচ্ছে 'এ মণিহার আমায় নাহি সাজে', কখনও রেকর্ড প্লেয়ারে বাজছে 'প্রাঙ্গণে মোর' অথবা 'মন মোর মেঘেরও সঙ্গী' অথবা 'পুরনো সেই দিনের কথা'। ব্যস রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে আর বার হতে পারলাম না। প্রতিক্ষণ রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে, দুহাতে জাপটে। 
রবীন্দ্রগানে কথা ও সুরে যে জড়াজড়ি সে তো হৃদয়ের অন্তস্তলে গিয়ে নাড়া দেয়। প্রাত্যহিক প্রতিটি বিষয়ের ওপর রবীন্দ্রনাথ কবিতা আর গান লিখে গেছেন। তিনি প্রতিপদে রয়েছেন। না লিখে পারিনি - মেঘলা আকাশ একলা দুপুর / বেজে ওঠে অবাক / তোমার সুরে / এ কোন লাবণ্যে / বৃষ্টিদিনে পাগল হাওয়া / ভেসে বেড়াই ভেসেই বেড়াই / তোমার সঙ্গে গানে গানে / রুদ্র আকাশ স্তব্ধ বিরহে / ব্যকুল এ প্রাণ / তোমার সঙ্গে কবি / তোমার সঙ্গে / স্পন্দিত এ হৃদয়ে রাত্রিদিন / ছন্দে ছন্দে তুমি / এ কোন বিস্ময়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কোনও গদ্য লেখার দুঃসাহস আমার নেই। তাছাড়া আমার আগে বহু বিদগ্ধ মানুষ তাঁকে নিয়ে অনেক মূল্যবান গদ্য লিখেছেন। আমি বড়জোর আমার অনুভবের প্রকাশ করতে পারি, আমার সঙ্গে তাঁর যে অন্তরের যোগ, যে তিনি রয়েছেন প্রতিপদে, সেই তাঁকে নিয়ে আমি কবিতা লিখতে পারি বড়জোর। লিখতে পারি ‘রবীন্দ্রনাথ প্রতিপদে’, যেখানে লিখি – ঘাসফুল ভিজে যায় অশ্রুপাতে যখন / অথবা পূর্ণিমা রাতে যখন খসে পড়ে নক্ষত্র / তুমিই তো তখন দাঁড়াও হাতে আলো অমোঘ নদী আর জুঁইফুলে / বৃষ্টি তখন হলুদ বনে / কৃষ্ণচূড়া রাতে তখন / বসন্ত ঝুঁকে পড়ে / ক্ষুব্ধ জলে অথবা বিষ-রাতে / হীরেকুচি দুপুরে কোনও / কমা সেমিকোলোন আর যতিচিহ্ণে / তুমিই তো রবীন্দ্রনাথ প্রতিপদে।
কলেজে পড়তাম যখন দীয়া কী অপূর্ব গান করত  'সখি ভাবনা কাহারে বলে', একের পর এক কত রবীন্দ্রগান শোনাত, বনানী ঘোষের কাছে শিখেছিল গান, তারপর সুবিনয় সেন। সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ এমনভাবে হৃদয়ে প্রবেশ করল, যে, আমিও দু-চার লাইন লেখার প্রয়াস করলাম - উদাস আকাশ, মেঘলা বিকেল / হেঁটে যাও দীপ্ত উন্নত গ্রীবা / খোলা চুল দেখি তোমায় জ্যোত্‍স্নারাতে .../ ওরা বলে কালো তোমায় / আমি দেখি তোমার কাজল কালো চোখ .../ ঝিরঝির শ্রাবণে হৃদয় এমনই ভেজে / মধ্যগগনে রোদ্দুর খাঁ খাঁ / এভাবেই নেচে ওঠে প্রাণ / এভাবেই জলছবি / রামধনু আকাশে / অনুভবে বসন্ত এমনই .../ ওরা বলে কালো তোমায় / আমি দেখি তোমার কাজল কালো চোখ / এক আকাশ জ্যোত্‍স্নায় / তুমি কালো পরী, তুমি কৃষ্ণকলি আমার।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার শতবর্ষের ব্যবধান, অথচ রবীন্দ্রনাথ সুখে দু:খে বৃষ্টিতে ঝড়ে আমার আঙুল ধরে ধরে হাঁটছেন। রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন ১২৬৮ বঙ্গাব্দের (ইং ১৮৬১ সাল) পঁচিশে বৈশাখ, আর আমি ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের (ইং ১৯৬১ সাল) একুশে বৈশাখ। আমাদের এই জন্মের ব্যবধান নিয়ে লিখেছিলাম ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ - শতবর্ষের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছি / আমি ও রবীন্দ্রনাথ।/ সেই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বয়ে গেছে / যে বর্ণলিপি, যে অক্ষরবৃত্ত, / যে ঘন কুয়াশা, যে জমাট দুঃখ, / যে সবুজ ভ্যালি, যে ঘন খাদ, / সেইখানে পড়ে আছে হীরেকুচিও, / আর, কিছু মায়া। / এ কোনো শতবর্ষের সংজ্ঞা নয়, / বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ছড়ানো কস্তুরী। / সেই দীর্ঘতম সময়ের আড়ালে / উড়ে গেছে যে পালকখানি, / কেঁপে উঠেছে যে কদমফুল, / ইতিউতি যে চাঁদের আলো, / সেইখানে দাঁড়িয়ে আছি / আমি ও রবীন্দ্রনাথ।
🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 30, 2023

    এত সুন্দর করে যিনি রবীন্দ্রনাথ লিখতে পারেন, মৃত্যু তার কাছে কিছু না, মোমবাতির কাঁপা কাঁপা শিখায় সামান্য ফুঁ।

    ReplyDelete