বাগদি চরিত (পঞ্চদশ পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
—-জান ত মাস্টার,ভগী খুড়ার মুখে আরেকটু গল্প শুনেছিলম। ইন্দের সভায় একজন নত্তকি ছিল। তার নাকি হঠাৎ তিনটি ছ্যানা হয়। লজ্জা লুকাতে ছেনা গুলানকে লুকি রাখে। কাকেও তেতুলের খলায়,কাকেও লুহার পাত্তে। সেই থিকে নাকি তেতুলা বাগদি হইচে। কিন্তু তমার কথা শুনে ত অবাক হই যাইঠি, গো মাস্টার। মোদের জাতের জম্ম বিত্তান্তের এত ফ্যাঁচাং!
—- অবাক হউঠু কারণ ইসব জানতুনু। এখন জানলু ত। মোদের জাতের একটা লিখিত ইতিহাস আছে।
—-আর মোদের পদবী লিয়ে কী যেন বল্লে? মল্ল রাজাদের পদবী থিকে মোদের পদবী মাল? থাইলে ত মোদের গায়ে রাজার রক্ত বয়ঠে!
বলেই লোখা ফিকফিক করে হাসতে থাকে।
—- রাজার রক্ত! হেবি শক! জানু মল্ল মানে কী? কুস্তিগির! ওই জন্ন তোদের পাড়ার লোকেরা হুক কথায় লাঠি তাড়া নিয়ে কঁকি যায়। গায়ে বল নাই, রাগে থরথর। যত্ত আনাড়ি গুলান!
—-থাইলে তমাদের পদবী ত বড়দোলই,তার কী মানে আছে বল দিখি শুনি!
—- সব পদবীর সঙে কিছু না কিছু ইতিহাসের সূত্র লেগে আছে। মোদের পদবীতেও আছে। আগে সৈন্য সামন্ত লেঠালদের একজন মেন লোক থাকত। তাকে বোলত সেনাপতি বা দলপতি। সেই দলপতি থিকে এসছে দোলই। আর দলপতিদের মধ্যে যে বড় সেই হল বড় দলপতি। তা থিকে বড়দোলই।
—-যাই বল,কার সঙে না মিলু তমার সঙে হেবি মিলে গেছে। খগেন বড়দোলই। খগেন বড়দলপতি। মোদের জাতের যে দল,তার মেন লোক তুমি। মোদের ঢোলে তমাকে সবাই মেনেগুনে চলে। কত কিছু জান তুমি। সকলকে সৎ পরামর্শ ছাড়া কিছু দাও নি। থাইলে কী বলঠ?
—-কী কথা বলতে চাউ বল?
—--থাইলে মেটাসরায় বিয়া কল্লে কিছু হবে নি ত? মোর জাতের মেইয়া ছাড়া কাকেও ভিটায় তুলবো নি,ইটাই মোর জেদ।
—-ক্যানে রে? জাত লিয়ে কী ধুয়ে খাবি?
—-সেটা বোলিনি মাস্টার। আসলে জাতের ছেনা ছাড়া মোদের জাতের মেইছেনাদের কে বিয়া করবে বল? বামুন মাহিষ্যরা ত আর সেঙা করবেনি। পেম ভালবাসা যেদি করে ত হল। তাউ ছেনা মানলেও ঘরের লোকজনরা মানবেনি কুনু দিন। মোদের জাতের ঝিউড়ি মোদের ঘরেই থাকু। তাবাদে আম গাছের ছাল জাম গাছের সঙে কুনু দিন মিশবেনি মাসটার। মোদের গায়ে ছোট জাতের দাগ লাগি দিছে জম্ম থিকে। মানুষের নাক তুলা স্বভাব মল্লেও যাবে নি।
ময়না মেটাসরার ঝিউড়ি। ভগী খুড়ার সাথে একবারই দেখতে যায় লোখা। দেখেই মনে ধরে যায় ময়নাকে। প্যাঁকাল মাছের মতো চিকন গায়ের রঙ। চোখে মুখে কত যেন মায়া মাখানো। একবার চোখাচোখি হতেই লোখার বুকটা ছ্যাঁক করে উঠে। সেই যে ঘোষেদের ঘরে জন খাটতে গিয়ে কারেন্টে একবার শক লেগেছিল,ঠিক তেমন পারা। ভগী খুড়াকে সেকথা বলে নি। সব কথা কী বলা যায়! সারা রাস্তাটা চুপচাপ সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফিরে আসে। ভগী খুড়া বসেছিল পেছনের ক্যারিয়ারে। একমনে প্যাডেল করতে দেখে খুড়া একবার জিগ্যেস করে,
—কিরে লখি ক্যামন দেখলু, বল? পছন্দ হইচে তোর মেইছ্যানাটাকে?
—-ভালই ত। খারাব ত কিছু বুজতে পাল্লম্ নি।
—-থাইলে কথা এগায়ঠি।
আর কোন উত্তর করেনি লোখা। ঘরে ফিরতে ফিরতে সাঁঝ নামে। ছাই রঙের ঘোলাটে সন্ধ্যা চারদিকে ছেয়ে যায়। গাঁয়ের ঝুপড়ি মাটির ঘর গুলো থেকে ইলেকট্রিক আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসে। সব ঘরে তখনো কারেন্ট পৌঁছায় না। তাদের ঘর আলো করে রাখে লম্ফ লন্ঠনের আলো। ঝিটাবেড়ার ঘরে,হগলা আর তালপাতার ঘেরা কুঁড়ায় কারেন্টের কেটকেটে আলো বেমানান মনে হয়। কিন্তু দিনকাল এগোচ্ছে। লন্ঠন লম্ফের দিন শেষ। মানুষ সভ্য হচ্ছে। গ্রাম দিনে দিনে বাবুয়ানি চাল ধরছে। মেঠো রাস্তায় মোরাম ছিল। এখন ঢালাই হচ্ছে। ট্যাপ কলে টাইমের জল আসে। মাঠে ঘাটে বাঁশ বনে নদী পাড়ে যাওয়া কমছে। বাহ্য বসে হাত মাটি করার বদলে সাবান দেয় অনেকে। ভগী খুড়া এসব নিয়ে কত রসিকতা করে,
—--চিরদিন গেল মোর খড়ের জালে/ আজ হইচে বেরষা কালে। বুইলু লখি। সব্য হইঠি সবাই। সুদু গেরামের সব্যতাকে ধরে রাখতে পারিঠি নি। বাইর পারা চিকানচাকন, ভিতর পারা ফাঁপা!
লোখা খুড়ার মুখের উপর কথা বলে না। এখনো যে সব শেষ হয়ে যায়নি লোখা তা দৃঢ় মনে বিশ্বাস করে। গাঁয়ে ঢুকেই লোখার কানে আসে শাঁখের শব্দ,ঘন্টা, ঝাঁঝের আওয়াজ। সবার ঘরের উঠানো এখনো তুলসীর থান আছে। সারা বছর তুলসীদেবী জল পায়। সকালে ঝড়া ঝাঁট পড়ে,সন্ধ্যায় প্রদীপ। পূর্ণিমা তিথিতে হয় হরিনাম, হরিলুট। মন প্রাণ শুদ্ধ হয়ে যায়। গাঁয়ের সন্ধ্যা ধূপ ধূনার গন্ধে ম ম করা। লোখা বড় বয়স অব্দি দেখেছে বিকেল হলে তার মা চুলে তেল দিত। সিঁথি কেটে সিঁদুর পরত। খোঁপা বাঁধত। বাখুলের এয়ো জা- জাউলিরা একসাথে বসত। তার মা নারকেল তেলকে বলত ডাবতেল। খুড়তুতো দাদুর নাম নারায়ণ ছিল। গ্রামে বড়দের নাম ধরতে মানা ছিল। পায়ে আলতা পরত। লন্ঠন লম্ফ মুছে,প্রদীপ ধুয়ে সন্ধ্যা দিত। অনেক ক্ষণ অব্দি নিঃশ্বাস ধরে রেখে শাঁখ বাজাত। এখনো গ্রামে সেই চল আছে।
সাইকেলটা রেখেই বাঁশিটা নিয়ে হাঁটা দেয় আখড়ার দিকে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠে একটা নরম মুখ। টলটলে দুটো চোখ। চিকন রঙ। কাজললতার কালির মতো কুচকুচে চুলের খোঁপা। কথা বলতে ইচ্ছা করছিল লোখার। লজ্জায় সেকথা খুড়াকে বলতে পারে নি। মনে হয়েছিল ওই চোখ তার খুব চেনা। যেন আপন করে কাছে ডাকছে। আখড়ায় তখনো সকলে আসে নি। ক্যামন যেন একটা ছটপটানো ভাব ভেতরে ভেতরে অনুভব করে লোখা। সবাই জড়ো হওয়ার আগেই বাঁশিতে সুর তোলে। আহারে, আহারে কী প্রাণ মন ঢালা সুরের দ্যোতনা। লোখা যেন এই সুরের ধ্বনি শুনাতে চায় মেটাসরার ময়নাকে। সেদিন আখড়ায় সকলে লোখার আড়বাঁশি শুনে অবাক হয়ে যায়। বলে,
—আজ লখিকে কিষ্ট ঠাকুর ভর করেচে নিশ্চই।কী বাজালু রে লখি! পান মন জুড়ি গেল!
লোখা ভাবে সবদিন সে তো এমনি করেই বাজায়। আজ তবে কী এমন জাদু ঘটছে! মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই তার মধ্যে কইমাছের মতো খলবলানি শুরু হয়েছে।
রাতে ঘুম আসতে চাইছিল না কিছুতেই। বাপ মায়ের মুখ তার সামনে ভেসে ওঠে। পাড়ার কত ছেলে মেয়ের বিয়া দেখেছে সে। বিয়ার কত রীতিনীতি। আইবুড়ো ভাত খাওয়ানো,নান্দীমুখের শ্রাদ্ধ কতকিছু! তারপর বিয়ে করতে যাওয়ার আগে মাকে প্রণাম করে বলতে শুনেছে,--মা তমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি। লোখা কাকে বলবে সেই কথা। তার বিয়েতে কোনকিছু রীতি রেয়াজ হবে না। ওই ধরাচটকা বিয়া যাকে বলে। গরীব বাগদি ঘরে জন্মেছে সে,তার উপরে মা বাপ নেই তার। তার বিয়া মানে দুচারটা মন্ত্র,সিঁদুর লেপা আর মালাবদল। ঘোষ বাড়ির ছেলে মেয়েদের বিয়েতে সে কী জাঁকজমক। এখন তাদের জাতের বিয়েতেও কম লবরচবর হয় না। কথায় বলে ট্যাঁকের জোর থাকলে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করা যায়। লোখার জীবনে তেমন বাহাল্লি দেখানোের জোর নাই। ময়নার বাপেরও কোমরের জোর নাই। ভারী মিলেছে। বাগদি ঘরে কলাপাতায় চাল ঢেলে ছাওলাতলা সাজাতেও জমি বন্ধক দিতে হয় অনেক কনের বাপকে। কত মেইছেনার বিয়েই হয়নি তাদের জাতের। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে কবে। কালো কুচ্ছিৎ বাগদি মেইছেনার বর হতে বাগদি ছেনাও দশ হাত পিছিয়ে যায়। তাই সমন্ধ এলো কী কনের ঘরে গতিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। মেয়ের বিয়ের বয়স না হলেও ক্ষতি নেই। হচ্ছেও তাই। কেউ যদি একটু বাড়াবিস্তর করেছে তো পাড়ায় ফিসফিসানি শুরু,অম্নি খাঁদির বিয়া হয়নি তার আবার চিদবাজনা খুঁজেঠে।
লোখার বিয়ায় কোন বাজনা বাজেনি। মাইকে বাজেনি সানাই। গায়ে হলুদের গান। বাখুলে সুপারি ভাঙানি হয়নি। বৌভাতের পঙ্গত বসেনি। ময়নার বাপের ঘরেও লোখার জন্য বর আসন সাজায় নি। একটা মারুতি ভ্যানে ভগীখুড়া, খগেন মাস্টার আর দুচারজন গিয়ে ময়নাকে ঘরে নিয়ে আসে লোখা। আরতি বৌদি ময়নাকে বরণ করে ঘরে তুলে। আর দাদা বৌদিদের ডাকলেও, কোন দাদা বৌদি তার আসে না। পাড়ার বিশ তিরিশ জনের একটা প্রীতিভোজ হয়। ময়নার বাপের ঘর থেকেও তেমন কেউ আসে না। দুচারটা দান বাসন,লেপ বালিশ মাদুর আর একটা রঙিন ট্যাঙ্ক। লোখাকে একটা সাইকেল দেয়। যৌতুক বলতে এইটুকু। ময়নার কানে, নাকে ছিঁটেফোঁটা সোনা। তারপর সবই এমিটেশানের গয়না। লোখাও তাকে কিছু দিতে পারেনি। ফুলশয্যার রাতে ময়নাকে একটা তিনধাতুর বালা দিয়েছিল পরিয়ে। আর নরম মুখটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
—কিছুই নাই রে আমার বুজলু। তবে খেটেলুটে তোর ভাত কাপড়ের অভাব রাখবোনি কুনুদিন। আর তুই যেদি শুনতে চাউ, তবে তোখে বাঁশি শুনাব। শুনবি?
নতুন বউ ময়না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। জানলা দরজা বন্ধ করে দ্যায় লোখা। বাখুলে কে কী ভাববে! নতুন বউকে ফুলশয্যার রাতে বাঁশি শোনানোর গল্পের ভিতর ঠাটা মস্করা থাকে। ময়নাকে হাসির পাত্র হতে দিতে চায় না সে সকলের কাছে। নিজেকেও না। বাঁশিতে সুর বাঁধে লোখা। একটার পর একটা গানের সুর। বিভোর হয়ে শুনতে থাকে ময়না। তার মনে ভাসে গাঁয়ের কিষ্টযাত্রায় কিষ্ট ঠাকুরের বাঁশি যেমন শুনেছে তেমন পারা মনপ্রান জুড়ানো সুর। লোখার এইটুকুই সম্বল। তার ভিতরের আরেকটা মানুষ আছে। তাকে যদি না ভালবাসে তবে তো সে মরেই যাবে। ভয় ছিল তার। ভাবনার অন্ত ছিল না মনে। ঢোলের মা মুখ তুলেছে। ময়না তার ভিতরের মানুষটাকে বোধহয় চিনতে পেরেছে । তার ওইটুকুতেই সুখ।ময়নাকে নিয়ে তার সুখের জীবন শুরু হয়। দুঃখ শুধু দাদা নিশিকান্তের একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে। তার বিয়ে নিয়ে কোন কিছু জানায় নি তাতে কষ্ট পায় নি লোখা। নতুন বৌদিকে বাপের ভিটায় না তুলে বোম্বে রেখেছে, তাতেও তার বলার জায়গা নেই। অভিযোগ একটাই তার দাদা কেন নিজের জাতের মেইছেনাকে বউ করে আনল না। তার জাতের একটা মেইছ্যানা ত সুখে থাকত। একটা কন্যাদায়ে জর্জরিত বাপের কষ্ট ত লাঘব হত। এই অভিমান ভরা বেদনা টুকুই তার মনে পাথর হয়ে চেপে থাকে। কাউকে বলতে পারে না সেইকথা। এমনকি খগেন মাস্টারকেও না। তার পেছনেও একটা কাহিনী আছে। গ্রামে কেউ কেউ জানে। লোখা জানে সবটাই।
নিশিকান্ত নতুন বউকে প্রথম নিয়ে আসে ঢোলের কালিপূজার সময়। ঢোলের মা ফলহারিনী ভীষণ জাগ্রতা। গোটা ঢোল এমন কি আশেপাশের গ্রাম,বহু দূরদূরান্তের মানুষ ফলহারিনী মার কাছে মানত করে। হত্যে দেয়। মা তাদতের মনোবাঞ্ছা পূরণ করে।
0 Comments