জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো -১০ /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো -১০ 
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

রূপকথার স্বপ্নময়  জগৎ আন্টিলোপ ক্যানিয়নের গিরি কন্দরে শৈল্পিক আলোছায়ার বর্ণময় সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে মন ছুটেছে নতুনের পরিক্রমায়।  বিশাল পৃথিবীর এই পান্থশালায় কত যে রহস্য ,কত যে অসীম বিস্ময় ! ছড়িয়ে আছে সর্বত্র তার অল্প কিছু হদিস ও এই এক জীবনে  পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও মানুষ অবিরত ছুটছে বিশ্ব জগৎ ঘুরে দেখার নেশায় --অজানার সন্ধানে। আন্টিলোপের গুহায় সূর্যকিরণের জাদুস্পর্শে সোনার কাঠি, রুপোর কাঠির জগতে বিচরণ করে এক অপার্থিব  স্বর্গলোকের সংস্পর্শে এসে অসীমের আনন্দ ধারায় বিভোর হয়েছিলাম। এবারে আবার  পাড়ি দিলাম পেজ থেকে প্রায়  311 মাইল দূরের ইউটাহের মোয়াব শহরে আরো কোনো অজানা বিশ্বের বিস্ময়ের দ্বার প্রান্তে।  বিশাল ক্যানিয়ন ল্যান্ডসের পার্কের পাশের ফাঁকা রাস্তা ধরে ধুধু মাঠ প্রান্তর পাহাড়ের সারি পার হয়ে চলেছি।গাড়ির চাকা ও ঘুরছে দুরন্ত গতি তে।     

ঘড়িতে এখন সোয়া দুটো, অতনুর অনুমান মোয়াবে পৌঁছতে 5hr 5min, লাগবে  মানে রাত ৭ টা বাজবে। হাইওয়ের মনুমেন্ট ভ্যালির পাশ দিয়ে   I-7০ W  এবং  US-89 S ধরে  মোয়াবের দিকে গাড়ি ছুটছে। সঙ্গে চলেছে সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে সুবিশাল সেই গিরি কান্তার মরু পর্বতের শ্রেণী। উদাসী প্রকৃতির   নিয়মে মেঘরোদ্দুরের চিরন্তন আলো ছায়ার খেলার সাথে সবুজ ধূসর পাথরের সারি পেরিয়ে রুক্ষ দিগন্ত বিস্তৃত পর্বত মালার সাথে তালেতাল রেখে  চলেছি। আদি অন্তহীন অচলায়তনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়ে অনন্ত কালের অপেক্ষায় প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে খাড়া পাহাড়ের সারি।  মনে হলো পৌরাণিক চরিত্রের পাষাণী নারী অহল‍্যা -- যুগযুগ ধরে  আজো চেয়ে আছে প্রতীক্ষায়  নিষ্পলক চোখে । তার সারা শরীর  ময় সাদা ধূসর ছাই রঙা পাথর  স্তরে স্তরে সাজানো । কোথাও দেখেছি  শতাব্দী প্রাচীন বিশাল আয়তনের বহু পুরোনো বৃক্ষ রাজির জটলা  বা ঘন সবুজ ঘাসের কার্পেটের ঢাল। আর এখন শুধু  বর্ণময় রক্তাভ  বেলেপাথুরে পাহাড়ের সাম্রাজ্য।   
এখানে শীতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সাথে কুয়াশা আজ নেই । সারা দিনের বেড়ানোর সঙ্গী রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। গতকাল পেজে রাতের কনকনে ঠান্ডায়  স্যাঁত-স্যাঁতে ঝিরঝির বৃষ্টির অনিমেষ ঝরে পরার ঘ্যান ঘ্যানানি তে একটু উষ্ণতার জন‍্য মন ব্যাকুল হয়েছিল। যত দূর দেখা যায় জনহীন ওয়ান ওয়ে তে শুধু অল্প কয়েকটা প্রাইভেট কার ঝড়ের গতিতে হুশ হাশ বেরিয়ে যায়। যদি ও পথ জুড়ে চলছে শব্দ হীন ধোঁয়া বিহীন দৈত্যের আকারের বিশালট্রাক গুলো। ইউ হল গুলোর ও ব্যস্ততার শেষ নেই ,মাল বোঝাই করে হুঁশিয়ার হয়ে ছুটছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বিরাট ভীমাকৃতি  যন্ত্রদানব ট্রাক গুলোর নিঃশব্দ চলায় বাতাসে ডিজেল পোড়ার গন্ধ ,কালো ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা বা শ্বাস রোধ হয়ে  আসে না । বরং দেখছি  মাখন মসৃণ রাস্তায় শয়ে শয়ে চকচকে সব গাড়ির দল নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে প্রতি মিনিটে ছুটে চলেছে।  বাতাসে এত টুকু ও পল্যুশন ছড়ানো  দেখিনি এতো হাজার হাজার মাইল পথ পরিক্রমায়।   
চুপচাপ সময় কাটে না । প্যারাসিটামলে অতনু জ্বর কে কন্ট্রোলে এনে সাময়িক স্বস্তিতে ঘুরে বেড়িয়ে নিলে ও এখন বেশ দূর্বল। এবারে ফ্রন্ট সীটে ব্রতীনের পাশে ইয়ম ;হাতে ক্যামেরা সুযোগ পেলেই শাটার টিপে প্রকৃতির ফটো তুলছে । ওর প্রিয় মাউথর্গান লাল কোটের পকেটে। হঠাৎ যেন ওর মনে পরে বলে ; এই  এখন  কোথায় যাচ্ছি রে ? ব্রতীন বলে, এতোক্ষণে তোর খেয়াল হলো ?  গুগুল নেট দেখ। ,এই রাস্তা টা সোজা যাচ্ছে মোয়াবের উত্তর দিকে, পূর্ব ইউটাহ তে। কলোরাডো নদী সংলগ্ন মোয়াব ,ইউটাহ থেকে মাইল চারেক উত্তরে আর্চেস ন্যাশানাল পার্কে।  

পারভীন বলে ,  তাহলে Friends , Let's go  Arches  national park ?  আমরা চলেছি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশানাল পার্কের উত্তর পূর্বে কলোরাডো নদীর তীরে । এই পার্বত্য মনোমুগ্ধ কর অঞ্চল টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাল বেলে পাথরের মরুভুমি। কলোরাডো মালভূমির উত্তর প্রান্তে চার থেকে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে রয়েছে ।  অপরূপ এই পাথুরে উদ্যান আর্চেস ন্যাশানাল পার্কটি ৩১০.৩১কিলোমিটার বিস্তৃত।  বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘনত্বের পাথরের  খিলানে এবং অতুলনীয়  শোভায় সমৃদ্ধ ময় অনন্য ভূতাত্ত্বিক সম্পদে পূর্ণ ইউটাহ তথা মার্কিন সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য এই পার্কটি।  ব্রতীন ঘাড় ঘুরিয়ে এক ঝলক পিছনে তাকিয়ে   বলে, absolutely correct  you are .. । .                                                                        
ট্যাকোমার  জানলার পাশের কোণটিতে  কপালে হাত রেখে অতনু ঘুমিয়েছে।  আমাদের মধ্যে খুব মৃদুলয়ে আদি আমেরিকান দের ইতিবৃত্ত নিয়ে আলাপ  চলছিল। পারভীনের  দ্বিগুন উৎসাহ ,বেশ সপ্রতিভ হয়ে গত রাতের  মাম্মিস কেয়ারের ম্যাডাম  লুডো র কাছ থেকে শোনা গল্প শেয়ার করে বলে  , আমার কথা তোমার ভ্রমণ ডায়েরিতে নিশ্চয়ই লিখবে ? অতনু চোখ বুজেই মন্তব্য করে ,কেন ! স্পেশালি তোর কথা কেন লিখবে? তুই কবের থেকে আদিবাসী আমেরিকান হলি ? আমরা তো সে  খবর কিছুই জানি না? আমি হেসে ফেলে বলি ,অতনু জাগলো কখন ? বেশ তো ঘুমোচ্ছিলো। ব্রতীন গাড়ির  মধ্যে Rearview mirror  এ তাকিয়ে হেসে বলে ,ও ঘুমোয় না --বেশীটা ই মটকা মেরে পরে থাকে। জেগে জেগে পাশের লোকের মন বোঝে।''  গাড়িতে অনেক ক্ষণ পর হাসির ঢেউ উঠলো।  
🍂

 পারভীনের  মেজাজ গরম বলে ,-- অতনু চুপ করে শোন ,তোর ইতিহাসের জিরো জ্ঞান একটু হলে ও বাড়বে। এবার দেখি সে  বাধ্য ছেলের মত মুচিকি হেসে ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল চাপা দিয়েছে। আমরা তখন গভীর মনোযোগ দিয়েছি কৌতূহলী গল্পে  ।  এই  আমেরিকা মহাদেশটি অভিবাসীদের দেশ। এবং আদিম অধিবাসীরাই আসল আমেরিকান।  এরা সম্ভবত এশীয় বংশোদ্ভূত।  প্রায় দশ হাজার বছর আগে শেষ বরফ যুগ থেকে মানুষ এই গিরিখাদের অঞ্চল গুলোয় দখল নিয়েছিল। নেটিভ আমেরিকান দের ছোট পরিবারের সাথে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে যার মধ্যে একটি ছিল আধা যাযাবর বাস্কেটমেকার পূর্বপুরুষ ,পুয়েবুলান নাভাহো। প্রায় ৭০০বছর আগে পর্যন্ত ফ্রেমেন্ট মানুষ এবং তাদের পূর্ব পুরুষ পুয়েবলোনরা এই সমগ্র ক্যানিয়নে বাস করত। আদিবাসী  নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একাধিক বার সে প্রমাণ সামনে এসেছে। 

যদিও  নেটিভ আমেরিকান দের জনসংখ্যা ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের পর থেকে তাদের অমানবিক অত্যাচারে মহামারী ও যুদ্ধ বিগ্রহের প্রকোপে ব্যাপক হারে এদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে । এছাড়া ও  নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা অন্তর্দ্বন্দ্ব এই জাতির ক্ষয় হওয়ার একটি অন্যতম কারণ।  জায়গা দখল ও ক্ষমতার লড়াই লেগে থাকায়  যুদ্ধ প্রিয় এরা এমনই হিংস্র ও প্রতিহিংসা পরায়ণ ছিল যে নারী ,পুরুষ নির্বিশেষে একে অপরের শিরচ্ছেদ করে পথে টানিয়ে রাখতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা বোধ করতো না। এমন কি এই খুনো খুনীতে শিশুদের ও রেহাই দিতো না।  

 এক  আমেরিকান ভূতত্ত্ব বিদদের লেখায়  পড়েছিলাম , এই পৃথিবীর বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছরের কাছে।  এই সুদীর্ঘ সময়ের তত্ত্ব  গুলো পৃথিবীর ভূগর্ভস্থিত বিশাল গিরিখাদ গুলো তে সজ্জিত কয়েক কোটি বছরের পাথরের প্লেটের স্তরে অন্তর্নিহিত রয়েছে । ভূতল গর্ভে  কত যে জীবনের অস্তিত্ব প্রাচীন তর রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে তার হিসাব নেই।                                                                                                                         পারভীন একটু থেমে বলে আদিবাসীদের সমাজ নিয়ে রিসার্চের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে এই বিশাল বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ রাশি। সেসময়ে স্থানীয় মানুষ দের নিবাস স্থল এবং সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা গ্র্যান্ডক্যানিয়ন গুলো যেখানে এদের পূর্ব পুরুষের বাসস্থান ছিল সেখানে মাটির সাথে মিশে থাকা জীবাশ্ম ব্যবহৃত তৈজসপত্র ইত্যাদি গুলো বহু প্রমাণ বহন করে। যুগযুগান্তর ধরে চলছে আদিবাসী আমেরিকান ও এই গিরিখাত নিয়ে গবেষণা। পৃথিবী সৃষ্টির  রহস্য উন্মেচনের জন্য আজ ও লাগাতার খোঁজ চলছে। এবং এই বিশ্বের সন্ধানী দের চোখে একদিন ঠিক প্রকাশিত হবে সৃষ্টির এক রোমাঞ্চকর তথ্য। রহস্যের দ্বার উদ্ঘাটিত হলে আরো নতুন কোনো  সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। তারই অনুসন্ধানে  ভূবিজ্ঞানীরা অহর্নিশি পরিশ্রম করে চলেছেন। 

  নানা  আলোচনায় কখন পথ শেষ হলো বুঝতে পারলাম না। মাঝখানে একবার গ্যাস স্টেশনে  তেল ভরানোর জন্য ব্রেক নেওয়া হলো যাকে কফি ব্রেক ও বলা যায় । রেস্ট রুমে গিয়ে একটু চোখে মুখে জল দেওয়ায় পথের ক্লান্তি কাটিয়ে বেশ ফ্রেস হলাম।  অতনু ব্রতীন তখন হাতপায়ের জড়তা কাটাতে ব্যস্ত। এখানে কিন্তু গাড়ির ডিজেল ,পেট্রল কে গ্যাস বলে। প্রত্যেকটি জায়গার গ্যাস স্টেশনে র  সংলগ্ন একটি শপিং সেন্টারে আছে যেখানে কফি, সিগারেট ,চুরুট ,স্নাক্সস কেক কুকিজ ,জল বা ঠান্ডা পানীয় ইত্যাদি পথ চলতি প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়। আমরা তিনজন একটা বেঞ্চে রিলাক্স মুডে কফির মগ হাতে বসলাম।  কোটপ্যান্ট পরা দুই  লম্বা ফর্সা দুধে আলতা ঢালা গায়ের রঙের সুন্দরী যুবতী বিদেশিনী কন্যার মাঝে নিত্যান্তই সর্ট হাইটের আমি শ্যাম বর্ণা ভারতীয় নারী শাড়ি পরিহিতা মাতৃ রূপিণী ষাটোর্দ্ধা এক বৃদ্ধা। আরো সব পথচারিদের কৌতূহলী দৃষ্টি আমার মেরুন কাঞ্জিভরমের জরিপাড় শাড়ির ,জরির আঁচলের  দিকে। ওরা দুজনেই এক গাল হেসে বলে how beautiful sari !you look like just a queen ....আমি তো হেসে কুল পাইনা। বলি  এই ভারতীয় ট্র্যাডিশনাল শাড়ি পোশাক  টি পড়লে ,  তোমাদের ও ঐ রানীর মতই দেখতে লাগবে। 

          গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হাইরোডে এলে আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো দু ধারেই আকাশ ছোঁয়া লাল পাহাড়ের সারি।মোয়াবে ইউটা আরিজোনা অঞ্চলের এই রক্তিম মৌন পাহাড় গুলো যেন লেলিহান আগুনের জ্বলন্ত শিখার মত। তার ধূসর রুক্ষ চেতনা গ্রাসী সৌন্দর্য নিবিড় ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখে মন কে ভাবনার কোন অতলে টেনে নিয়ে চলেছে। মেঘমুক্ত নীলাকাশ কে পাহাড়েরা  আড়াল করে আছে তাদের  বিশাল উঁচু মাথা দিয়ে ঢেকে। মোয়াবে তে এসে পৌঁছলাম। মরুভুমি এলাকা এখানে আবহাওয়া বেশ গরম।এখনো রোদ ঝলমল দিনের আলো যদিও সন্ধ্যে সাত টা অনেক ক্ষণ বেজে গিয়েছে।

 রাস্তার ওপর থেকেই আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সুন্দর সাজানো মোটেল টিকে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। সামনেই বিরাট লন পাশেই সুইমিং পুল আবার জাকুজি ও রয়েছে। তাতে দেখি  তিন চারটে বাচ্চা ছেলে মেয়ে সহ এক সাদা আমেরিকান পরিবার  গরম জলে শরীর ডুবিয়ে বসে আছে ।   সারা দিন কেমন করে পথে পথেই কাটলো, শুধু রাতটুকু  মাথা গোঁজার অবকাশে  চার দেওয়াল আর ছাদের তলে মোটেলে আশ্রয় নেওয়া ,রাত  কাটিয়ে ভোরের অপেক্ষায়  প্রহর গোনা  । 

সামনেই চাইনিজ রেস্তোরাঁয়  ডিনার সেরে এসে সাদা ধবধবে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই এক ঘুমে রাত শেষ। ব্রতীনের হাতে কফির মগ বলে ,জাগো মা, তোমার কফি রেডি। আমাদের তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরোতে হবে। সম্বিৎ ফিরে পেলাম ,কফি মেশিন থেকে ঘর ময় মো মো করছে ক্যাপাচিনো কফির গন্ধ। ব্রতীন আজ  কফি বানানোর দায়িত্ব নিয়েছে ,ওরা সবাই প্রায় তৈরী আমি বেশ লেট করলাম। ভোরের সূর্য তখন  লাল পাহাড়ের মাথায় জাঁকিয়ে বসেছে আর তার ঠিক নীচেই জুনিপার ও পাইনের ঘন অরণ্য ঘেরা পর্বত মালা। অপরূপ সুন্দর আর একটি দিনের সূচনা হলো।  

 সম্ভবত মিনিট ২০র মত লেগেছিল মোয়াব থেকে পাঁচ মাইল উত্তরে এই ন্যাশানাল পার্ক টিতে গাড়ি পার্ক করে মেইন গেট ধরে ভিজিটর্স সেন্টারে পৌঁছতে।  কলোরাডোর তীরে ক্যানিয়ন ল্যান্ড ন্যাশানাল পার্কের পূর্ব প্রান্তে  লাল টুকটুকে বেলে পাথড়ের জেনিথ,জানালা, বক্ররেখা ,ডেলিকেট আর্চ ,ফায়ারি ফার্নেস ,ডেভিলস গার্ডেন, ব্যালেন্সড রক ,কোর্ট হাউস টাওয়ার কত কিছু নাম দিয়ে সাজানো প্রাকৃতিক পাথুরে পার্ক। অনিন্দ্য সুন্দর অপরূপ আর্চেস ন্যাশানাল পার্কটি প্রকৃতির স্বয়ংক্রিয় স্থাপত্য শিল্প দেখতে ,মুগ্ধ দৃষ্টি তে পা ফেলে পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছি।সামনেই এলো  ডেভিলস্কেপ আর্চ ,ডেভিলস গার্ডেন । 

হাতে রয়েছে কাগজের সূচি পত্র। এর সর্বোচ্চ উচ্চতা এলিফ্যান্ট বাটে ৫,৬৫৩ ফুট উঁচুতে এবং সর্ব নিম্ন স্থান ৪০৮৫ফুটে , যেখানে  দর্শনার্থী কেন্দ্র টি রয়েছে ।কোথায় কোন রাস্তা ধরে এগোলে কি কি বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বিষয় গুলো সহজেই দেখবো তার বিবরণ । দ্বিপ্রহরের সূর্য কিরণ লাল পাহাড়ের মাথায় গায়ে সর্বাঙ্গে প্রতিফলিত হয়ে টকটকে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।  অনিন্দ্য সুন্দর তার রূপ যেন প্রজ্জলিত অগ্নিশিখা জ্বলছে সারা পার্ক এলাকা জুড়ে।  

 ভাবছি তিন শত মিলিয়ন বছর আগে অশান্ত পৃথিবীর মুহুর্মুহু  অগ্ন্যুৎপাতে আগ্নেয়গিরির গলিত তপ্ত লাভায় ,প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভূমিকম্পর ঘাত প্রতি ঘাতে সৃষ্টির কথা।  এই সব পাথুরে অঞ্চলে উন্মত্ত কলোরাডো নদীর নিরলস ভয়ঙ্কর জলধারার ধাক্কায় ,ভাঙনে যে লবনাক্ত পলি ও পাথরের গুঁড়ো তিলে তিলে জমা হয়ে  একসময়ে রক্তিম বর্ণের বেলে পাথরের এই কারুকার্য্য ময় পাহাড়ের সৃষ্টি হয়েছিল এবং প্রতিনিয়ত ঘর্ষণে যে  বিভিন্ন  অবয়ব  মূর্তির  সৃষ্টি করেছিল তা আজো তেমন ই রয়ে গিয়েছে । 
কোথাও যেন দেখছি  আকাশ স্পর্শী  অট্টলিকা ,দেওয়াল বা গম্বুজ। কখনো লাল পাথুরে হাতির মুখের আদল একসাথে জড়ো হয়ে আছে ,   ল্যান্ডস্কেপ আর্চ .,ডেভিলস গার্ড অঞ্চলে দেখতে পেলাম উত্তর আমেরিকার দীর্ঘতম বক্রাকৃতি আর্চ ৩০৬ফুট প্রসারিত। এখানে ইংরেজির  ইউ অক্ষর টি উল্টে আর্চের মত হয়ে আছে। স্কাইপিক্যাল আর্কিটেকচার একটি বিশাল শিলা খোলার আকারে দ্বিগুন হয়ে রয়েছে।  কোথাও তিন মানবী একত্রে থ্রী সিস্টার্স নাম নিয়েছে। এক পাহাড়ের ওপর লাল ইটের সাতটি গোলাকার পুতুলের মত দন্ডায়মান মূর্তি দেখে ইয়ম বলে এর নাম হবে সেভেন সিস্টার্স।   কোথাও দেখি দানবীর মত অবয়বের পাহাড় গুলো একের ঘাড়ে ভর করে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সটান আকাশ ছুঁয়ে আছে। কোথাও বা মন্দির ,রাজপ্রাসাদ বা দুর্গের ওপর দুর্গের সারি। কোথাও সপ্ত অশ্বে টানা রথ। সারাদিন ধরে ঘুরে দেখেও অনবদ্য এই প্রাকৃতিক সৃষ্টির দেখা শেষ হবে না। দুই হাজারের থেকেও বেশী প্রাকৃতিক বেলে পাথরের খিলান ক্ষয়ে বিভিন্ন অসাধারণ  দৃষ্টি নন্দন স্থাপত্যের  আকার নিয়েছে ।

বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকি অদ্ভুত এক অনুভূতি আমাদের সবার সারা শরীর মন জুড়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কত অজানা তথ্য কত কথা কণ্ঠ রোধ করে থাকে।  বেরোতে চায়,ভাষা খুঁজে পায় না, গুমরে মরে। জানিনা কোন  কবির ছন্দ গাঁথা , কোন চিত্রকরের তুলিতে আঁকা  ,কোন ভাস্কর শিল্পীর সুদক্ষ হাতের যাদুতে গড়ে ওঠা এ অনুপম কারুকার্য্য সম্ভার ?  আমার ভাবনাকে মাতিয়ে তুলেছে এই বিশ্ব স্রষ্টার সৃষ্টির অপার বিস্ময়। এই অনির্বচনীয় শিল্প সৃষ্টির ঐশ্বর্য্য যার কারিগর শুধুই প্রাকৃতিক খেয়ালে ,বালির স্রোত নিয়ে ভেসে আসা উত্তাল নদীর জোরালো ধাক্কা ,ভূ বিপর্যয় প্রলয় -সংঘাত। 

মনে হলো শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মা অনন্ত কাল ধরে সবার অলক্ষ্যে বসে অহোরাত্র নিরলস ছেনী হাতুড়ীর ঠোকা ঠুকিতে এই অতুলনীয় কারুকার্য্য মন্ডিত  কর্ম যজ্ঞের সৃষ্টি করে চলেছেন। অপার বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাই এমন সূক্ষ্ণ শিল্প ঐশ্বর্য্য! যার স্রষ্টা নির্বাক প্রকৃতি। সারাদিন ধরে ঘুরে দেখে ও এই প্রাকৃতিক সৃষ্টির দেখা শেষ হবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে অপরিসীম  বিস্ময়ের সাথে মানসিক শান্তি ও আনন্দ উপভোগ করে চলেছি ।বিভিন্ন ভঙ্গিমায় উঁচুউঁচু পাহাড় গুলো অপরূপ সৌন্দর্য্যের প্রতীক  হয়ে কেমন অবলীলায় যুগযুগান্তর  ধরে  নীল আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে লেপ্টে রয়েছে এক অবর্ণনীয় এক বাঙ্ময় সৃষ্টির প্রতীক হয়ে।                                                                                                ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments