জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে - ৭ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে - ৭

বিজন সাহা 

নিলোভা পুস্তিন 

নিলোভা-স্তলোবেনস্কায়া পুস্তিন বা সংক্ষেপে নিলোভা পুস্তিন – সেলিগের হ্রদের তীরে অবস্থিত রুশ অর্থোডক্স চার্চের ছেলেদের মনাস্তির। আমি এর আগে কয়েকবার মনাস্তির, ক্যাথেড্রাল, মন্দির বা টেম্পল, গির্জা বা চার্চ ইত্যাদি শব্দ উল্লেখ করেছি। মনে হয় সময় এসেছে এসব শব্দের কিছু ব্যাখ্যা দেবার। মনাস্তির বা মনাস্টেরি অনেকটা মঠ বা আশ্রম বা বিহারের মত যেখানে মঙ্ক বা সন্ন্যাসী  বসবাস করে। এদেশে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা আলাদা মনাস্তির – যেখানে ছেলে ও মেয়েরা বসবাস করে। সেখানেই কাটে তাদের জীবন। এটাই তাদের ঘর সংসার। ক্যাথেড্রাল হল শহর বা মনাস্তিরের প্রধান মন্দির বা টেম্পল। আর টেম্পল হল স্থাপনা যেখানে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের উপাসনা করে। ৎসেরকভ বা গির্জা বা চার্চ – এটার অর্থ অনেক বেশি বিস্তৃত। চার্চ বলতে শুধু কোন স্থাপনা বা বিল্ডিং বোঝায় না, এটা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা কমিউনিটিও বোঝায়। যেমন আমরা বলি রাশান অর্থোডক্স চার্চ। অস্তাশকভ থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে এই মনাস্তির স্তলবেন দ্বীপ ও সভেতলিৎসে উপদ্বীপে অবস্থিত। তবে গাড়ির রাস্তায় অস্তাশকভ থেকে নিলোভা পুস্তিনের দুরত্ব ২৫ কিলোমিটার। এক লিজেন্ড অনুযায়ী স্তলবেন দ্বীপের নাম এমন হয় তার পিলারের মত আকারের কারণে, অন্য লিজেন্ড অনুযায়ী এখানে এক সময় মূর্তি পুজারীরা দেবতাদের উদ্দেশ্যে হাড়িকাঠ বা যূপকাষ্ঠে পশু বলি দিত বলে দ্বীপ এই নাম পায়। 

নিলোভা পুস্তিনের নাম হয় মহাত্মা নিলের নামানুসারে যিনি পঞ্চদশ শতকে ভেলিকি নভগোরাদে বসবাস করতেন। ১৫২৮ সালে তিনি স্তলবেন দ্বীপে আসেন। এখানে তিনি ২৭ বছর বাস করেন আর ১৫৫৫ সালে মৃত্যুর আগে এখানে মনাস্তির গড়ার অনুরোধ জানান। ১৫৯৪ সালে এখানে মনাস্তির তৈরি করা হয়। এভাবেই শুরু হয় মনাস্তিরের ইতিহাস। বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই মনাস্তির খুবই জনপ্রিয় ছিল। ১৮২০ সালে জার আলেক্সানদর এখানে আসেন। ১৮৫৮ সালে মনাস্তিরের চারিদিকে পাথরের বাঁধ তৈরি করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এখানে প্রায় এক হাজার লোক বসবাস করত। এখানে এমনকি হাসপাতাল পর্যন্ত ছিল।

🍂

১৯১৯ সালে রাশান অর্থোডক্স চার্চের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, মহাত্মা নিলের দেহাবশেষ খোলা হয়। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত মনাস্তির এর দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে অবশ্য সে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এখানে ছিল অল্প বয়সী অপরাধীদের জন্য শ্রম শিবির। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এখানে পোল্যান্ডের যুদ্ধবন্দীদের রাখা হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এখানে ছিল আর্মি হাসপাতাল। ১৯৪৫ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আবারও গুলাগে পরিণত হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এখানে ছিল বৃদ্ধাশ্রম আর ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ট্যুরিস্ট স্পট। ১৯৯০ সালে মনাস্তির আবার রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর ১৯৯৫ সালে মহাত্মা নিলের দেহাবশেষ এখানে ফেরত দেওয়া হয়।

আমরা যখন নিলোভা পুস্তিরে পৌঁছুই তখন প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। যদিও অস্তাশকভ থেকে তরঝকের পথেই, তবুও একটু ভেতর দিকে যেতে হয়। বলব না যে দিলীপের খুব একটা আগ্রহ ছিল। তবে আমি আর দেমিদ ওকে বোঝালাম যে তভের গিয়ে আমরা আজ রাত কাটানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না, তাই এখানে এক দেড় ঘণ্টা সময় কাটালে তেমন কোন উনিশ বিশ হবে না। মনাস্তির একটা দ্বীপে অবস্থিত। সেলিগের হ্রদের তীর থেকে ছোট্ট একটা সেতু দিয়ে হেঁটে ওখানে যেতে হয়। তবে মনে হল তেমন কোন অতিথি এলে এই সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি নিয়েও যেতে পারে। ঢোকার পথেই একটা পাথরে লেখা ছেলেদের মনাস্তির “নিলোভা-স্তলোবেনস্কায়া পুস্তিন” ১৫৯৪ সালে স্থাপিত, ১৯৯১ সালে পুনরুজ্জীবিত। এর পরেই মহাত্মা নিলের স্ট্যাচু, পেছনে গির্জা। বিশাল জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই মনাস্তির। আসলে মনাস্তিরে শুধু উপাসনাই হয় না, সেখানে যারা থাকে তারা বিভিন্ন ধরণের দৈনন্দিন সাংসারিক কাজেও ব্যস্ত থাকে। ১৫৯৪ তৈরি গির্জা ছিল কাঠের, তবে সতের শতকের শেষের দিকে থেকে এটা বর্তমান রূপ পেতে শুরু করে। এমনকি এখনও পর্যন্ত এখানে বিভিন্ন রকমের নির্মাণ কাজ চলছে। তবে বর্তমানে গির্জার যে জৌলুষ দেখলাম তাতে বোঝা গেল উনি গরীবের ভগবান নন।

এখানে যে প্রধান গির্জা তার একদম উপরে অনেক ঘন্টা আছে, যেখান থেকে উপাসনার সময় ঘন্টা বাজানো হয়। সে এক অপূর্ব মিউজিক সুর লয় তাল ইত্যাদি সহ। সেখানে ওঠা যায়। আসলে আগে সেই সুযোগ ছিল না, এখন কয়েক শ’ রুবলের বিনিময়ে এটা করা যায়, ছবিও তোলা যায়। দিলীপ ও দেমিদ নীচে বসে রইল। আমি উঠলাম ১৯০ তা সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে। আমার কাছ থেকে কেন যেন পয়সা নিল না। সিঁড়ির ওখানে যে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, বললেন দরকার নেই আর যেন সাবধানে উঠি। ওনারা হয়তো বুঝে গেছিলেন যে ভগবান আমার বন্ধু, মানে একে অন্যকে ডিস্টার্ব করি না। আমাদের দেশে সন্যাসীরা সাধারণত গেরুয়া বসন পরে, এখানে তাদের পোশাকের রঙ সাধারণত কালো। তবে কোন কোন উৎসবে সাদা বা সবুজ পোশাকও পরেন। যাহোক সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে শুরু করলাম, মনে হচ্ছিল এই বুঝি দম বন্ধ হয় আর কি। তখন বুঝলাম স্বর্গে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক খড়কুটা পুড়াতে হয়। একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভয় লাগছিল, এক ভদ্রলোক তার ছেলেকে নিয়ে নামছিলেন, অনুরোধ করলাম একটু অপেক্ষা করতে। সেখান থেকে পুরা সেলিগের যেন হাতের মুঠোয়। অপূর্ব সুন্দর সেই দৃশ্য।

নীচে এসে দেখি দিলীপ বসে আছে। একটু দূরে বসে আছেন এক পাদ্রী। দিলীপের ইচ্ছে তার সাথে কথা বলা। আমি আসলে ওর দোভাষীর কাজও করেছি এই ট্রিপে। দিলীপ ওঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করল, আমি অনুবাদ করে দিলাম। তিনি এই মনাস্তিরের ইতিহাস বললেন, বললেন এখানে এই মনাস্তিরের উৎপত্তি ও বিবর্তনের ইতিহাস। আমি বললাম কয়েক বছর আগে আমার মেয়েদের এসব এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রম দেবার কথা। বললেন এখনও গ্রীষ্মে অনেকেই আসে কাজ করতে।

২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী মনাস্তিরে ৫০ জনের মত লোক থাকে যাদের মধ্যে প্রায় ২০ জন সন্ন্যাসী। তরঝক সহ বিভিন্ন জায়গায় মনাস্তিরের বেশ কিছু খামার বাড়ি আছে। এখানে মোমবাতি, দুগ্ধজাত পণ্য ও কাঠের কাজের কারখানা আছে, আছে গোয়াল ভরা গরু ও আস্তাবল ভরা ঘোড়া। আছে মৌমাছি। মনাস্তিরের দোকানে খাঁটি মধু বিক্রি হয়। এছাড়া এখানে আছে নিজস্ব জুয়েলারির কারখানা। এরা চার্চ আয়োজিত মস্কোর বিভিন্ন মেলায় নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে। তাছাড়া তীর্থযাত্রীদের জন্য এখানে আবাসিক হোটেল আছে।

  আসলে রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে, বেশ করে তভের রিজিয়নে বিভিন্ন জনপদে প্রচুর পরিত্যাক্ত চার্চ আমি দেখেছি। চার্চের উপস্থিতি প্রমাণ করে কোন এক সময় এসব এলাকার বর্ণাঢ্য ও ঐশ্বর্যময় ইতিহাসের কথা। দুবনার আশে পাশে বিভিন্ন জায়গায় ছবি তুলতে গিয়ে দেখেছি এসব। আসলে এক সময় ধর্মীয় স্থাপনাকে কেন্দ্রও করেই গড়ে উঠত জনপদ। বিপ্লবের আগে গির্জা শুধু উপাসনার জায়গা ছিল না, বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু ও অন্যান্য সামাজিক কাজের রেজিস্ট্রি এখানেই হত। সেদিক থেকে এসব গির্জা রাশিয়ার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। যদি সুযোগ থাকতো আমি নিঃসন্দেহে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় সেখানে কাটাতাম। কেননা এটা ছিল ভর দুপুর, মাথার উপর রাগী সূর্যটা আকাশ বাতাস সব কিছু ঝলসে দিচ্ছিল আলোয়। ফলে ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও ছবি তুলতে পারছিলাম না। তবে রাস্তা হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। যাত্রা যাতে স্মুথ হয় সেজন্যে তরঝকে নেমে একটু চা বিস্কুট খেতে হবে। তাই কোন উপায় নেই। শুরু হল তভেরের পথে যাত্রা।    

নিলোভা পুস্তিনের কিছু ছবি পাওয়া যাবে
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=241 

আর ভিডিও 

https://www.youtube.com/watch?v=uc1bBs1eALY

 শ্রদ্ধা ও স্মরণ 👇



Post a Comment

0 Comments