জ্বলদর্চি

দশ পুত্তলী /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭৯
দশ পুত্তলী

ভাস্করব্রত পতি

দশখানা পুতুল নিয়ে এই লৌকিক উৎসব উদযাপিত হয়। তাই বলা হয় 'দশ পুত্তলী' বা 'দশ পুত্তল' বা 'দশ পুতুল'। 
সংস্কৃত পুত্র > প্রাকৃত পুত্তুল্ল > বাংলা পুতুল / পুতলী
সংস্কৃত পুত্রক > প্রাকৃত পুত্তলয় > পুত্তল > পুত্তলী
পুতুলের অর্থ হল মূর্তি। 'পুত্তলী' হল পত্রবস্ত্রশিলামৃত্তিকাদি বিরচিত প্রতিমূর্তি। এখানে দশটি পুতুল সহকারে কামনা করার রেওয়াজ। তাই 'দশ পুত্তলী' নামকরণ। 'দাত্রিংশতপুত্তলিকা'তে পাই 'পুত্তলিকা ভণতি'। স্বয়ং বিদ্যাসাগর লিখেছেন, 'পুত্তলিকার চক্ষু আছে, দেখিতে পায়না'। আবার 'বাইশ কবি মনসা'তে আছে 'প্রাণের পুত্তলী যাদু আয় কোলে আয়'! 

চৈত্র সংক্রান্তিতে শুরু করে বৈশাখের সংক্রান্তি পর্যন্ত করতে হয় দশ পুত্তলী ব্রত বা উৎসব। একান্ত ঘরোয়া উৎসব এটি। কেবলমাত্র কুমারী মেয়েদেরই এটি পালনের বিধান। এজন্য উপকরণ হিসেবে দরকার পিটুলি গোলা, ফুল, তুলসী আর দূর্বা। প্রতি দিন সকাল থেকে এই উপচার করতে হয়। তবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই উপচার বিকেলে হয় বলে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্যনীয় যে, পাঁচ বছর বয়স থেকে নয় বছর পর্যন্ত করা উচিত। আর ব্রত উদযাপিত হবে নয় বৎসর বয়সে। 

এই উৎসবে প্রাথমিকভাবে মেঝেতে পিটুলি দিয়ে দশটা মনুষ্য পুতুল আঁকতে হয়। আর এক একটি মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রত্যেক পুতুলের ওপর ফুল আর দূর্বা দিতে হবে। মোট ৪ বছর পালন করলে তবেই যাবতীয় মনস্কামনা পূরণ হয় বলে বিশ্বাস। 

বৈশাখ মাস জুড়ে পালিত এই লৌকিক উৎসবে পিটুলি দিয়ে দশটি পুতুল আঁকার কথা আগেই বলা হয়েছে। এতে দশ রকমের কামনা করে মহিলারা। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশের বেশিও কামনার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। আসলে ইহলোক এবং পরলোকের সুখ সমৃদ্ধি কামনার জন্য মহিলাদের এই উৎসবে সম্পৃক্ত থাকার প্রচলন রয়েছে। 

পুতুলগুলিতে ফুল বা দূর্বা দেওয়ার সময় যে কামনা বাসনাগুলি মন্ত্র হিসেবে বলা হয়, তা হল --
"এবার পূজায় বর নেবো,
রামের মতো পতি পাবো।
এবার পূজায় বর নেবো,
সীতার মতো সতী হবো৷৷
এবার পূজায় বর নেবো,
লক্ষ্মণের মতো দেওর পাবো।
এবার পূজায় বর নেবো,
দশরথের মতো শ্বশুর পাবো॥
এবার পূজায় বর নেবো,
কৌশল্যার মতো শাশুড়ী পাবো।
এবার পূজায় বর নেবো,
কুন্তীর মতো পুত্রবতী হবো।৷
এবার পূজায় বর নেবো,
দ্রৌপদীর মতো রাঁধুনি হবো।
এবার পূজায় বর নেবো,
দুর্গার মতো শক্তি পাবো
এবার পূজায় বর নেবো,
পৃথিবীর মতো ভার সবো।
এবার পূজায় বর নেবো,
ষষ্ঠীর মতো জেঁওজ হবো"। 
কুমারী মহিলারা পাঁচ বছর বয়স থেকে শুরু করে তা আরও চার বছর ধরে করবে। তবেই মনস্কামনা পূরণ হবে। তখনই সকল চাওয়া পাওয়া মিটবে। এঁদের মুখে একটু অন্যভাবে যে মন্ত্র উচ্চারিত হয়, তা হল ---
"এবার ম’রে মানুষ হব, রামের মত পতি পাব৷
এবার ম'রে মানুষ হব, সীতার মত সতী হব৷৷
এবার ম'রে মানুষ হব, লক্ষ্মণের মত দেবর পাব।
এবার ম'রে মানুষ হব, দশরথের মত শ্বশুর পাব।।
এবার ম'রে মানুষ হব, কৌশল্যার মত শাশুড়ী পাব।
এবার ম'রে মানুষ হব, কুন্তীর মত পুত্রবতী হব।৷
এবার ম'রে মানুষ হব, দ্রৌপদীর মত রাঁধুনী হব।
এবার ম'রে মানুষ হব, দুর্গার মত সোহাগী হব৷৷
এবার ম'রে মানুষ হব, পৃথিবীর মত ভার সব।
এবার ম'রে মানুষ হব, ষষ্ঠীর মত জেওজ হব"৷৷ 

ড. শীলা বসাক উল্লেখ করেছেন পৃথক আর একটি ছড়া। এই ছড়ার কামনা বাসনা অনেকটাই একই রকম। কিন্তু তবুও যেন কিছুটা আলাদা। মন্ত্রটি এরকম ---
"এবার মরে মানুষ হব,
ব্রাহ্মণ কুলে জন্ম নেব।
এবার মরে মানুষ হব,
সীতার মতো সতী হব।
এবার মরে মানুষ হব,
রামের মতো পতি পাব।
এবার মরে মানুষ হব,
লক্ষ্মণের মতো দেবর পাব।
এবার মরে মানুষ হব,
দশরথের মতো শ্বশুর পাব।
এবার মরে মানুষ হব,
কৌশল্যার মতো শাশুড়ী পাব। 
এবার মরে মানুষ হব,
লব কুশের মতো পুত্ৰ পাব।
এবার মরে মানুষ হব,
দ্রৌপদীর মতো রাঁধুনী হব।।
এবার মরে মানুষ হব,
দুর্বার মতো লজ্জাশীলা হব।
এবার মরে মানুষ হব,
দুর্গার মতো সোহাগী হব।
এবার মরে মানুষ হব,
ষষ্ঠীর মতো জেওজ (অ-মৃত পুত্রা) হব৷
এবার মরে মানুষ হব,
গঙ্গার মতো শীতলা হব।
এবার মরে মানুষ হব,
পৃথিবীর মতো ভার সব"। 

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় পৃথক একটি মন্ত্রের সন্ধান দিয়েছেন এই 'দশ পুত্তলী' উপচারের। সেটি এরকম ---
"মরিয়ে মনুষ্য হব, ব্রাক্ষ্মণ কুলে জন্ম লব।
সীতার মতো সতী হব, রামের মতো পতি পাব।
লক্ষ্মণের মতো দেবর পাব, কৌশল্যার মতো শাশুড়ি পাব।
দশরথের মতো শ্বশুর পাব, দুর্গার মতো মা পাব।
শিবের মতো বাপ পাব, লক্ষ্মী সরস্বতী বোন পাব।
কার্তিক গণেশ ভাই পাব, কুন্তীর মতো ধীরা হব। দ্রৌপদীর মতো রাঁধুনি হব, কলা বউয়ের মতো লজ্জাবতী হব। 
বিউলির ডালের বর্ণ হব, দূর্বার মতো লতিয়ে যাব"। 

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বুক থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে এই অতি প্রাচীন লৌকিক উৎসবটি। একসময় পালিত হত প্রতি ঘরে ঘরে। কিন্তু দিন বদলের সাথে সাথে অন্যান্য সবকিছুর মতো এরকম অসংখ্য লৌকিক উৎসব মুছে গিয়েছে বাংলার সংস্কৃতি থেকে।
🍂

Post a Comment

0 Comments