বেহাগ বিধুর গীতি নিয়ে আলোচনা করলেন অনিন্দিতা শাসমল
কয়েকদিন আগে , প্রিয় সম্পাদক ও কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর ফোন-- আপনার জন্য একটি কাব্যগ্রন্থ পাঠিয়েছেন কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দ। ফোন রেখে দেওয়ার পর দেখলাম, হোয়াটসঅ্যাপে ছবি তুলেও পাঠিয়েছেন -- ঝকঝকে সুন্দর হাতের লেখা-- "মাননীয়া শ্রীমতী অনিন্দিতা শাসমল (শিক্ষিকা ও কবি ) মহোদয়ার করকমলে --
সর্বজয়া আচার্য নন্দ।
২৬-০৪-২০২৩ "
মনটা খুশিতে ভরে গেল ছবি দেখে। কারণ গত বছর অক্টোবর মাসে শ্রদ্ধেয়া কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দের কাব্যগ্রন্থ "স্মৃতি কুসুমাঞ্জলি "র আলোচনা করেছিলাম জ্বলদর্চির পাতায়।সেই আলোচনা পড়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন , সম্পাদক ঋত্বিকের কাছে আমার ফোন নং চেয়ে। একদিন ছুটির সকালে , হাতে সময় নিয়ে তাঁকে ফোন করি। অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই তাঁর। ছোটো ফোনটি ধরলেন তাঁর মেয়ে । মায়ের হাতে ফোন দেওয়ার পর, প্রায় আধঘন্টা ধরে কী অপরিসীম আবেগে ভেসে চললেন কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দ ,তাঁর কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে আমার সামান্য লেখার কারণে শুধু ! শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছিলাম সদ্য স্বামীহারা বেদনার্ত এক কবির কাছে। মেদিনীপুর এলে আমার সঙ্গে দেখা করবেন , এই ইচ্ছে প্রকাশ করে সেদিন ফোন রেখেছিলেন। তারপর নানা ব্যস্ততায় যখন প্রায় ভুলতে বসেছিলাম তাঁর কথা ,ঠিক তখনই তাঁর হাতের লেখায় পাঠানো উপহার,তাঁর কাব্যগ্রন্থ " বেহাগ বিধুর গীতি" আমার জন্য অপেক্ষা করছে জেনেই , বৃষ্টিভেজা এক বিকেলে গেলাম জ্বলদর্চির দপ্তরে। হাতে পেয়ে বারবার দেখলাম, খুব যত্ন করে লেখা শব্দগুলো। এই কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকের অনুরোধে তাঁর কাব্যগ্রন্থের সম্বন্ধে লিখতে বসেছি আজ। জ্বলদর্চি থেকে প্রকাশিত কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দের কাব্যগ্রন্থ -- বেহাগ বিধুর গীতি (ষষ্ঠ কবিতা সংকলন)।প্রকাশকাল--শুভ অক্ষয় তৃতীয়া , ১৪৩০।
মনে পড়ে গেল,গতবছর ১৪২৯ সালের অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আগের কাব্যগ্রন্থটি। প্রতি বছর বাঙালির কাছে এমন একটি শুভদিনে কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ , সবার প্রিয় জ্বলদর্চি দপ্তর থেকে -- এটা জেনে আবারও শ্রদ্ধা জানালাম কবি ও প্রকাশক দুজনকেই।
🍂এবার আসি কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে ।বইয়ের নামটি পড়েই মনে হল-- হৃদয়মথিত যে বেদনারা হয়তো বা বেহাগের সুরে বেজে চলেছে কবির জীবনপ্রবাহে,কবিতার পরতে পরতে তারই প্রকাশ থাকবে নিশ্চয়ই। বই খুলে উৎসর্গ পত্রের লেখাটিতে এসে চোখ আটকে গেল । পাঠক ছাড়া কোনো লেখাই যে পূর্ণতা পায়না , তার প্রকাশ কী সুন্দর ভাবে লিখেছেন কয়েকটি লাইনে !
"অন্তরে যাঁদের দান- প্রেরণা- উৎসাহ--
অক্ষম হৃদয়ে দেয় সৃষ্টির আগ্রহ---
...........
হয়তো ভরেনা সব পাঠক হৃদয়
তবু এ যে চিরন্তন সৃষ্টির আশ্রয়।
সেই আশ্রয় যেন দিব্য সুখ স্বর্গ..
তাঁদের চরণে রাখি এই দীন অর্ঘ্য।"
পাতা উল্টেই কাব্যগ্রন্থের সূচিপত্রটি দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোকে চারটি পর্বে ভাগ করে সাজানো হয়েছে।প্রথম পর্বের (০৭ থেকে ৬৫ পৃষ্ঠা) নাম ।।একান্ত আপন।। ,দ্বিতীয় পর্বের (৬৭ থেকে ৮৩ পৃষ্ঠা ) নাম ।।প্রতিবেদন।।, তৃতীয় পর্বের নাম (৮৫ থেকে ৯৭ পৃষ্ঠা) ।।সৃষ্টি যেমন।। এবং শেষ পর্বের নাম (১০৮ থেকে ১১৯ পৃষ্ঠা) ।।স্মরণ বরণ ।।
চারটি পর্বের শুরুতেই , চার লাইন করে কবিতা লিখে ওই পর্বের কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দেওয়াতে ,পাঠক পাঠিকার কবিতাগুলো পড়ার আগ্রহ বেড়েছে। প্রথম পর্বের "খবর" কবিতায় কবি লিখছেন --
" রাত্রি নামে ধীরে --
মুখ ঢাকে চঞ্চলতা
ক্লান্তির ঘোমটায় !
নিস্তব্ধতা আসে --
তোলপাড় চিন্তাগুলো
নিদ্রাকে তাড়ায় ! "
স্মৃতির সরণী বেয়ে লেখা একটি মধুর কবিতা -- "হারানো ছবি" --
"কৈশোরের কলকন্ঠ মাঝে
কেটে গেছে কর্ম জীবন--
তারুণ্যের গণ্ডী স্পর্শ ক'রে
প্রৌঢ়ত্বের অবসানে থামে।"
এইরকম 'স্মৃতিকথা', 'চাঁদের গ্রামে','অস্তিত্ব','পরম সখা','স্বর্গচ্যুত'-- এইসব কবিতায় গভীর অনুভবের অতলে ডুব দিয়েছেন কবি।বাকি তিনটি পর্বের কবিতাগুলিও বেহাগ বিধুর গীতিকবিতা হয়ে হৃদয়ে দোলা দিয়ে গেল । 'কিছু নেই' কবিতায় তিনি লিখছেন --
"আমি গান গাই--তায় সুর নেই
আমি কথা কই -- তায় প্রাণ নেই
আমি হেসে যাই -- তায় খুশি নেই
আমি চ'লে যাই-- তায় ছন্দ নেই"
শেষের "স্মরণ বরণ" পর্বের কবিতাগুলোতে কবির প্রগাঢ় দেশপ্রেম ও জীবনবোধের প্রকাশ ঘটেছে।
তিনি লিখছেন --
"ভারত সূর্য! কোথা' আছো তুমি বীর !
অমর যোদ্ধা! চির উন্নত শির !"
আবার শ্রীমধুসূদন কবিতায় লিখছেন --
"হরিপাদপদ্ম স্পর্শে
মৃত্তিকার কণায় কণায় --
সিঞ্চিত হ'ল বিশ্বে দেবী প্রেম ভাব--
সেই ভাবে ভক্ত হয় নির্মল-নিষ্পাপ--"
বর্ষীয়ান শ্রদ্ধেয়া কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দের কাব্যিক চেতনা ও বোধ, আমাকে বারবার শ্রদ্ধায় অবনত করে তাঁর প্রতি। তিনি খুব ভালো থাকুন, সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে আরও আরও সৃষ্টির মধ্যে ডুবে থাকুন -- এই প্রার্থনা করি। সুন্দর প্রচ্ছদ ও অত্যন্ত ভালো মানের মুদ্রণসহ এমন সুন্দর একটি কাব্যগ্রন্থ হাতে পেয়ে আমার যেমন ভালো লেগেছে , তেমন সকলের ভালো লাগবে আশা রাখছি। অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই জ্বলদর্চির সম্পাদক, প্রকাশক ও কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীকে -- স্রষ্টার সৃষ্টিকে পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেবার কাজে , নিরন্তর নিজেকে নিয়োজিত করে রাখার জন্য। জ্বলদর্চির উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।
কাব্যগ্রন্থ -- বেহাগ বিধুর গীতি
কবি -- সর্বজয়া আচার্য নন্দ
প্রকাশক--ঋত্বিক ত্রিপাঠী, সম্পাদক, জ্বলদর্চি
0 Comments