কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-১১
সুমিত্রা মাহাত
কুয়াশায় ভিজে ভিজে , বজরংবলী,দেবী দুর্গা দর্শন করে, পাশের বৌদ্ধ মন্দিরে যাই। মন্দির টি ছোট খাটো। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি হনুমান মন্দিরে ওঠার প্রবেশ পথের পাশেই , সাইনবোর্ডে লেখা -' গাছে হাত দিলে পাঁচশো টাকা জরিমানা।' আমার মতো দুবৃত্তকারী র কথা মাথায় রেখেই কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা নিয়েছে , এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। একেবারে খাঁটি বাংলায় স্ট্যাম্প মারা। ডাল,পাতা,বীজ, মূল ইত্যাদি সটকানোর বহু ইতিহাস আমার আছে। কত ক্ষুদ্র জিনিস থেকে যে আমি গাছের বংশবিস্তার ঘটাতে সক্ষম , তা মানুষের কল্পনার অতীত। জেলখানা দেখলে চোরের যা অবস্থা হয়,আমারও তাই হল।
মন্দিরের বাইরে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ঘোরাফেরা করছেন , তাই মনে হল। আসলে ই বৌদ্ধ মন্দির কিনা বলতে পারছি না। মন্দির বন্ধ তাই ভেতরের কিছু দেখা যায় না। অবশ্য আমার উশুল হয়ে গেছে। মন্দির অভিমুখে যে রাস্তা , তার দুধারে যেন ফুলের মেলা বসে গেছে। হলুদ কসমস, ডায়ানথাস আরো পাঁচমেশালি কতো কি! একপাশে ফুলে ডগমগ একটা ফুসিয়া গাছ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ফিকে গোলাপী রং এর ডিজাইনার ফুল গুলো,মাটিতে পড়ে যাওয়া কোন জিনিস খুঁজতে ব্যস্ত। সপরিবারে বিভিন্ন পোজ দিয়ে পালা করে ছবি তুলি। ইতিমধ্যে আবার ঝির ঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে দশ ফুট মতো উঁচুতে উঠে মন্দির। সেখান থেকে নামতে নামতেই ভিজে যাই।
গাড়ি এবার বিখ্যাত ক্যাকটাস নার্সারি র উদ্দেশ্য রওনা দেয়। পাহাড়ি পিছল রাস্তায় গাড়ির সর্পিল গতি দেখে শিবের নাম জপ করতে থাকি। বলতে ভুলে গেছি , ডেলো পার্ক থেকে বেরোনোর সময় গেটের মুখে কয়েকটা ব্যাগ কিনেছি। নরম সুতোর হাতে বোনা ব্যাগ। একটা,মেয়ের মেকআপ বক্সের আকারে, বাকি গুলো একেবারেই ছোট, বাচ্চাদের খুচরো পয়সা রাখার জন্য। সামান্য কটা ব্যাগের পসরা সাজিয়ে দোকানদার সৎ পথে রোজগারের চেষ্টা করছে তা আর মন্দ কি ! পর্যটকের আধিক্যে কখনও কখনও কপাল খুলে যায়। আমাদের ব্রিলিয়্যান্ট ছেলেরা বাবার ধান জমিতে নামতে লজ্জিত হয়। এদিকে বিদেশে লোকের স্ট্রবেরী ক্ষেতে স্ট্রবেরী তুলে পকেটমানি সংগ্রহ করে। মানছি মজুরী অনেক বেশি। যাইহোক নিজস্ব উদ্যোগে এইরকম ছোটো খাটো প্রচেষ্টা কে আমি সবসময় সমর্থন করি। সম্ভব হলে কিছু কেনাকাটা করি। গাড়ি ইউ টার্ন নিয়ে পাইন ভিউ নার্সারি র সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। ড্রাইভার ফোন নম্বর নিয়ে নেন, বোধহয় আমাদের গতিবিধি দেখে বুঝতে পেরেছিলেন একবার ভেতরে গেলে আর বেরোতে চাইব না। এখানেও টিকিটের ব্যবস্থা। ভেতরে ঢুকে শুধু আশ্চর্য হয়েছি। সম্ভবত এশিয়ার সর্ববৃহৎ ক্যাকটাস নার্সারি এটি। সমগ্র বিশ্ব থেকে সংগ্রহ করতে করতে একেবারে ভান্ডার গড়ে উঠেছে। কত প্রজাতির ক্যাকটাস যে রয়েছে তা গুনে শেষ করা যায় না। মজার ব্যাপার হল এখন ব্লুমিং সিজ্ন। ক্যাকটাসের মাথায় হরেক রং এর ছোটো বড়ো ফুল সাজানো। আকারে আয়তনে ক্যাকটাস গুলো এমন বেড়ে উঠেছে যে এগুলোর বয়স নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। যথেষ্ট পুরনো। এখানে একটি মজার ঘটনা ঘটে। চার-পাঁচ জন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী মেয়েদের একটি দল আমাদের সঙ্গে নার্সারি তে ঢোকে। কলকাতা সংলগ্ন এলাকা থেকে এসেছে,নিজেরাই আলোচনা করছে। একজন তার মধ্যে পান্ডা। যেদিকেই যাই না কেন সদলবলে সামনে পড়ে হট্টগোল জুড়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় বাংলার মাঝে এমন চিবিয়ে চিবিয়ে কিছু ইংরেজি শব্দ আওড়ে চলেছে,কান পাতা দায়। বর্তমানে মানুষ বাংলার মাঝে ভারি ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে যথেষ্ট গর্ব ও স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এই ঢং আমিও কিছুটা আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি। সম্মুখে প্রবল ঢেউ, তাই নৌকার গতি রোধ করি। আমি ভাবুক মানুষ, ক্যাকটাস দেখে কাঁঠালের কল্পনায় মত্ত থাকব ,তা নয় , প্রত্যেক স্পিসিস এর বিজ্ঞানসম্মত বিবরণে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। জলের তোড় নেমে গেলে , শান্তিতে এই আশ্চর্য ক্যাকটাস নার্সারি পর্যবেক্ষণ করি।
🍂গেটে ঢুকেই বাম দিকে সারি দিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি গ্রীন হাউস বানানো। গ্রীন হাউসের জন্য সাদা মোটা পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে। এই আবহাওয়াতে এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন নেই । একটা , একটা করে সমস্ত গ্রীন হাউস ঘুরে দেখি। ক্যাকটাস এর বর্ণনা দিলে শেষ হবে না। কোনোটা বাঁদরের লেজের মতো তো কোনোটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠেছে। একটা গ্রীন হাউসে বড় বড় ঢাঁউস ক্যাকটাস, যেন সারি দিয়ে নানান সাইজের তবলা সাজানো রয়েছে। একটু অসাবধান বশত এদিক ওদিক না দেখলেই গায়ে কাঁটা আটকে যাচ্ছে। ছেলে বেশ মজা পাচ্ছে এতে। বছরের পর বছর ধরে , বিনা অনুশাসনে ইচ্ছে খুশি বেড়ে ক্যাকটাস গুলো এমন পর্যায়ে গেছে,পাশ দিয়ে পেরোনোর রাস্তা টুকুও নেই। তাড়াহুড়ো করলে নির্দ্বিধায় পিছু টানে। দেখা শেষ করে,ক্যাকটাসের ঝামেলা এড়িয়ে, বামদিক পরিদর্শনে যাই। এদিকে নীচ - উপর সর্বত্র সাকুল্যান্টে ভরা। মাটিতে রাখা রয়েছে,আবার কিছু কাঠের তাক বানিয়ে তাতেও রয়েছে। শীতল আবহাওয়ায় , টুসটুসে , নরম,জলভরা পাতাগুলো দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছে করছে। বিক্রি বাটাও চলছে। বড় টবে সব ম্যচিওর গাছ। ইচ্ছে হলেও বয়ে আনার উপায় নেই। পার্কের মাঝখানে গাছ দিয়ে বানানো একটি গোলাকার ঘর রয়েছে। সেখানে বরফ গোলা, কফি,মোমো বিক্রি হচ্ছে। গোল টেবিলে বসে গোলা ও মোমো চেখে দেখি।
শীতল আবহাওয়া গাছপালা ফুল ফল কে সতেজ ও তরতাজা রেখেছে। সামান্য বোগেনভেলিয়াও ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। কি উজ্জ্বল রং পাতা ও ফুলের। হঠাৎ ড্রাইভার ফোন করতেই টনক নড়ে। বেলা গড়িয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসি। উঠে গেছি বহুদূর। এবার গড়গড়িয়ে নামার পালা। নামার পথে এক জায়গাতে গাড়ি থামিয়ে হলুদ ধুতুরার ডালা ধরে টানাটানি শুরু করে দিই। পাশেই বসে থাকা দু-তিনজন মহিলা তো হেসে অস্থির! মনে মনে বলি-
কি বুঝবে মনের ব্যাথা,
ভাঙ্গা ডালাই বলবে কথা।
আর সময় নষ্ট করলে কপাল চাপড়াতে হবে। পরিবর্তনশীল আবহাওয়াতে ভীত হয়ে ই হোক অথবা দেওরের আস্তানায় ঢুঁ মারার আগ্রহেই হোক,আমার আর পাহাড়ের ওপরে থাকতে ভালো লাগছে না। পাহাড়ের এদিক ওদিক পাক খেয়ে ড্রাইভার দায়িত্ব নিয়ে সঠিক সময়ে বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দেয়। লাগেজ সব রুমে রয়েছে। প্রায় চারটা পনেরো মতো বাজে। চারজনে টানাটানি হয়ে রুমে যাই। দ্রুতগতিতে ফ্রেশ হয়ে,পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে নিই। বড় ব্যাগ টানা হ্যাঁচড়া করে হাঁপাতে হাঁপাতে বাসস্ট্যান্ডে হাজির হই। নিখুঁত টাইমিং এর জন্য আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়। শেষ বাস পাঁচটা বেজে দশ মিনিটে। এতে চড়ে আটটার সময় আমরা শিলিগুড়ি পোঁছাবো। আগুপিছু না ভেবে আমি টিকিট কাউন্টারে যাই। আশ্চর্যের বিষয়,বললে অবিশ্বাস্য মনে হবে,শেষ চারটে টিকিট আমাদের কপালে জোটে। শেষ বাসে শেষ চারটা টিকিট। তারপর যারা এল আর কেউ টিকিট পেল না। আর পাঁচ মিনিট দেরি করলে আমাদের ও একই অবস্থা হত। তাই আবারও ধন্যবাদ দিই যিনি আমাদের ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছিলেন , সেই গাড়ির ড্রাইভারকে। আসলে তাঁরা পরিস্থিতি জানেন।
মুশকিল একটা হল । মেয়ে কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় আমার পাশে বসতে চায়। আমাদের তিনটে টিকিট বাসের একদম পেছনের শেষ, একটা একেবারে সামনে। মেয়ে অসুস্থ থাকায় আমি,হাজব্যন্ড,মেয়ে পেছনের সীটে বসি। ছেলে একা সামনের সীটে। এটাই দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পাহাড়ি টালমাটাল রাস্তা,তাছাড়া সারাদিন পরিশ্রম হয়েছে,যদি ঘুমিয়ে পড়ে ! দুর্বোধ্য ভাষা , তাই সীট পরিবর্তনের বিষয়ে আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। একদম সঠিক সময়ে গাড়ি ছাড়ে। মনে মনে বিদায় জানাই কালিম্পং শহর,ডেলো পার্ক, হন্টেড হাউস,মেলা গ্রাউন্ড,পাইন ভিউ নার্সারি ও নির্ঝরিণী তিস্তাকে। মনে , মনে কবিতা ভাষা পায়-
অটুট
ঘন কুয়াশা , গভীর রহস্যে ভরা,
পলির পাহাড়,পাহাড়ি আলমোড়া,
শীতল বাতাসে রূপ লাবণ্যের ঢল,
ফুলেল বনানী,পাহাড়ি মায়ের কোল ;
মনাস্ট্রিতে সুরেলা মধুর ধ্বনি,
দূরের পাহাড়,অমোঘ হাতছানি,
ফুসিয়া,স্ট্রবেরী, লিলি,ধুতুরা,
নরম মেঘ, পাহাড়ি পসরা;
মন ভালো করা তিস্তার বাঁক,
মনের স্মৃতিতে অটুট থাক।।
0 Comments