জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—জাভা (এশিয়া)/যাদুর জোরে দৈত্য দমন /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোক গল্প—জাভা (এশিয়া)
যাদুর জোরে দৈত্য দমন 
চিন্ময় দাশ 


গাঁয়ের একেবারে শেষ মাথায় একটা কুঁড়েঘর। এক বিধবা বউ থাকে সে বাড়িতে। ভারি দুঃখী বেচারী। ছেলেপুলে নাই সে মেয়ের। তাই মনমরা হয়ে থাকে সব সময়। 
একদিন গাঁয়ের মোড়ল এসে বলল—এক কাজ করো তুমি। 
--কী কাজ বলো, মোড়ল মশাই। 
-- বুতো ইজোর কথা জানো তো? সবুজ দৈত্য। ভারি উদার মনের দৈত্য। আমার কথা শোনো। একবার যাও তার কাছে। কিছু একটা নিশ্চয় করে দেবে সে। 
শুনে, ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল বউটার। দৈত্যের কাছে যাওয়া। কিন্তু, ডুবন্ত লোক খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে। যদি বাঁচা যায়। বউটারও এখন সেই অবস্থা। 
গুটি গুটি পায়ে একদিন দৈত্যের কাছে এসে হাজির হোল বউটি। কেঁদে পড়ল—কিছু চাই না আমি। আমাকে একটি সন্তান দাও কেবল। জ্বলে পুড়ে মরছি মনের দুঃখে। 
দৈত্য সত্যিই বেশ উদার মনের। সব শুনল। বলল—ঠিক আছে। মনের দুঃখ ঘুচে যাবে তোমার। তবে একটা কথা দিতে হবে। 
বউটি বলল—কী কথা, বলো আমাকে। আমি রাজি। 
দৈত্য বলল-- প্রথম সন্তানটি দিতে হবে আমাকে। তোমাকে আসতে হবে না। সময় হলে, আমি নিজে গিয়ে হাজির হবো তোমার কাছে। সেদিন কিন্তু না বললে চলবে না। 
কী আর করে? অগত্যা বউটি বলল—আমি রাজি। দাও তুমি ব্যবস্থা করে। 
মায়ের হাতে বড়সড় একটা শশা ধরিয়ে দিয়ে, দৈত্য বলল—এটা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। হাতেনাতেই ফল পেয়ে যাবে। পথের মধ্যে কোথাও রাখবে না কিন্তু। হিতে বিপরীত হবে তাতে।
অবাক ব্যাপার! বাড়ি ফিরে, দাওয়ায় শশাটা রেখেছে, অমনি একেবারে ভোজবাজি। ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল শশাটার ভিতর থেকে।
মায়ের তখন আনন্দ ধরে না। যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে হাতে। কী যে করবে বাচ্চাটাকে নিয়ে, ভেবে পায় না। বুকে আঁকড়ে ধরল মেয়েকে।
দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে বাচ্চাটা। মায়ের চোখের মণি সেই মেয়ে। মেয়েকে বড় করে তুলতে গিয়ে, দৈত্যের শর্ত ভুলেই গিয়েছে মা। শর্ত ভুলেছে বলেই, দ্বিতীয় কোন বাচ্চাও নাই তার ঘরে। আর একটা বচ্চা চেয়ে নেওয়ার কথা মনেই হয়নি মায়ের।
একদিন আকাশের বাজ ভেঙে পড়ল মায়ের মাথায়। দৈত্য খবর পাঠিয়েছে, কাল আসবে মেয়েকে নিয়ে যেতে। 
মা তো ভেবে কূল পায় না, কী করা যায়। এই মেয়েকে দৈত্যের হাতে তুলে দেবে, এমন সাধ্য নাই তার। দৈত্য আসবে শুনেই, বুক ফেটে যাচ্ছে মায়ের। 
সারা রাত দু’চোখের পাতা এক হোল না বউটির। 
সকালে উঠেই, মেয়েকে বলল—তৈরি হয়ে নে বাছা, পালাতে হবে তোকে ঘর ছেড়ে। নইলে দৈত্যটা ছিঁড়ে খাবে তোকে। 
যাবার বেলায় এক মুঠো যাদু-শশার বীজ, এক গোছা সূঁচ আর এক পুঁটলি নুন ধরিয়ে দিল মেয়ের হাতে—যত্ন করে সাথে রাখ এগুলো। দরকার মতো ব্যবহার করবি। সহজে ধরা দিবি না দৈত্যের হাতে। 
দৈত্যটাকে আসতে দেখে, পিছনের দরজা দিয়ে, বের করে দিল মেয়েকে। পথে নেমেই ছুটতে লাগল মেয়েটি। 
কিন্তু দৈত্যকে ফাঁকি দেওয়া কী আর চাট্টিখানি কথা? সে ঠিক টের পেয় গেছে। সেও ছুট লাগাল মেয়েটার পিছু পিছু। 
মেয়েটা ছুটছে। কিন্তু কতো আর জোর হবে একটা ছোট মেয়ের পায়ে। দৈত্যটা এক সময় একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছে। ধরে ফেলল বলে। ভয় পেয়ে গেল মেয়েটি। 
তখনই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। সহজে ধরা দেওয়া যাবে না। ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে তাহলে। মায়ের দেওয়া এক মুঠো বীজ ছিল যাদু-শশার। পিছন ঘুরে বীজগুলো মাটিতে ছড়িয়ে দিল মেয়েটি। চোখের পলক ফেলতে হোল না। সবুজ গাছ গজিয়ে উঠল বীজ থেকে। ফল ধরে গেল গাছে গাছে। 
আর কী যাদু! এক একটা মেয়ে বেরিয়ে এল প্রত্যেকটা শশা থেকে। সকলেই একেবারে হুবহু বিধবা মায়ের মেয়েটির মত দেখতে। 
দৈত্য পড়ে গেল ফাঁপরে। কোনটি আসল মেয়ে? কোন মেয়েটি যাদুর ফল? মাথা গুলিয়ে গেল বেচারার। 
ভুল করে বসল মেয়েটি। সে ভাবল, এই সুযোগ। আসল মেয়েকে খুঁজতে থাকুক দৈত্যটা। আমি পালাই এই সুযোগে। যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। দৌড়তে শুরু করে দিল মেয়ে। 
এটাই বোকামি হোল তার। চোখে পড়ে গেল দৈত্যের। আসল না হলে, পালাবে কেন? সে তাড়া শুরু করল মেয়ের পিছনে।
দৌড়তে দৌড়তে আবার যখন কাছাকাছি হয়ে পড়েছে দৈত্য, এবার মুঠো ভর্তি সূঁচ ছড়িয়ে দিল মেয়েটি। আবার সেই যাদুর খেলা। 
মেয়েটিকে আড়াল করে, একটা প্রাচীর গড়ে উঠল সূঁচের। ইয়া লম্বা, ইয়া মোটা আর সূচালো সূঁচ সব। তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।
দৈত্য পড়ে গেল ফাঁপরে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সূঁচের প্রাচীরের অন্য পারে। 
আবার ভুল করে বসল মেয়েটি। দৈত্য প্রাচীর টপকাতে পারবে না—এই এবে আবার দৌড় লাগাল। 
অমনি হোল কী, মেয়ে যত দূরে চলে যায়, সূঁচগুলোও তত ছোট হয়ে আসে। তা দেখে, দৈত্যর মনে ভারি পুলক। সে একটু অপেক্ষা করে রইল। 
যেই মেয়ে অনেক দূরে চলে গেল, সূঁচগুলোও হয়ে এলো অনেক ছোট। কোন অসুবিধাই হোল না, এক লাফে টপকে গেল দৈত্য।
মেয়ে ছুটছে প্রাণপণে। দৈত্যও ছুটছে প্রাণপণে। ছোট একটা মেয়ে কতো আর ছুটবে? দৈত্যর সাথে পাল্লা দেওয়া কি আর সহজ কথা না কি? আবার কাছাকাছি হয়ে এলো দৈত্য। 
মেয়েটি তখন এক ফাঁকা মাঠে এসে পড়েছে। লুকিয়ে পড়বে, তেমন আড়ালও নাই কোথাও। বেলাও হয়ে গেছে অনেক। সূজ্জিঠাকুর গনগন করে জ্বলছে মাথার ওপর। 
🍂

দৈত্যটা তখন একেবারে কাছেই। ধরে ফেলল বলে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। এতক্ষণের চেষ্টা, সব শেষ এবার!
শেষ সম্বল লবণ ছিল হাতে। দৈত্য হাত বাড়িয়ে দেবে এবার। মেয়েটা দৈত্যটার চার পাশে ঘুরতে লাগল পাক খেয়ে খেয়ে। দৈত্যকে ঘিরে গোল চক্কর কাটছে, আর হাতের লবণ ছড়িয়ে ফেলছে মাটিতে। দেখতে দেখতে লবণেরই একটা বড় বৃত্ত গড়ে উঠল দৈত্যকে ঘিরে।
সূজ্জিঠাকুর তো সব দেখছিলেন মাথার উপর থেকে। মেয়েটার জন্য ভারি মায়া হোল তাঁর। শেষ রক্ষা করলেন তিনি। রোদের গণগণে তাপে, সব লবণ গলে জল। চোখের নিমেষ না ফেলতে, লোনা জলের একটা হ্রদ গজিয়ে উঠল দৈত্যটাকে ঘিরে। কী গভীর, কী গভীর সেই হ্রদ। ঠিক একেবারে একটা সমুদ্দূরের মতো। কূল নাই, কিনারা নাই। থইথই জলে ভরা। 
দৈত্য তো আর সাঁতার জানে না। তার উপর ভারি চেহারা বেচারার। কতক্ষণ আঁকুপাঁকু করল। জল খেল খাবি খেতে খেতে। পেট ফুলে ঢোল হোল। তার পর? তার পর আর কী? হাঁসফাঁস করতে করতে, অগাধ জলে ডুবেই গেল বেচারা।
এবার মুখ ফিরিয়ে, বাড়ির মুখে ফিরে চলল মেয়েটি। মা নিশ্চয় চোখের জলে ঘরদোর ভাসিয়ে ফেলেছে এতক্ষণে!

Post a Comment

0 Comments