সর্বজয়া আচার্য নন্দ-র 'বেহাগ বিধুর গীতি' নিয়ে কলম ধরেছেন কবি আবীর ভট্টাচার্য
"বেহাগ বিধুর গীতি" কবিতার বইয়ের লেখিকা সর্বজয়া আচার্য নন্দ।
শুনেছিলাম লেখিকা বর্ষীয়ান, লেখার ধরনও তদনুরূপ। তবু কিছু কিছু মানুষ আছেন; জরা, অসুখ, বয়স অথবা অপরাপর প্রতিবন্ধকতাগুলি তাঁদের সৃষ্টিশীলতাকে কখনও সীমাবদ্ধ করতে পারে না। লেখিকার ষষ্ঠ প্রকাশিত কাব্যসঙ্কলনটি হাতে নিয়ে আমার সেই কথাই মনে পড়লো।
কবির সংক্ষিপ্ত পরিচয় জেনে নেওয়া ভালো।
সর্বজয়া আচার্য নন্দ ।
জন্ম -- ৬ই জানুয়ারি,১৯৪৭
শিক্ষা --স্নাতকোত্তর (বাংলা সাহিত্য), বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় । পেশা - স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা।
প্রকাশিত কবিতা সংকলন ও প্রকাশকাল :
১) ঝরা ফুলের সাজি (২০১৭)
২) রঙ্গমালিকা (২০১৮)
৩) সাঁঝের দীপমালা (২০১৯)
৪) অপরাজিতার অর্ঘ্য (২০২০)
৫) স্মৃতি কুসুমাঞ্জলি (২০২২)
৬) বেহাগ বিধুর গীতি (২০২৩)
সংকলনটি গঠনে পেপার ব্যাক। পৃষ্ঠাসংখ্যা ষাট, কবিতা সংখ্যা শতাধিক, অধিকাংশ কবিতাই প্রচলিত ছন্দে গাঁথা; ছয়, আট অথবা বারো লাইনের মধ্যে তাদের চলন। প্রচ্ছদে সূর্যাস্ত-গোধূলির ছবি, প্রচ্ছদশিল্পী বিবেকানন্দ ভোজ। প্রকাশক জ্বলদর্চি।
যদিও চিরাচরিত ধারণায় বিষাদের রঙ নীল, বেহাগ রাগটিও নিঃসঙ্গতার ধূসরতায় লীন, সেই দৃষ্টিপটে উজ্জ্বল রক্তিম আবহে একাকিনী শুভ্রবসনা এক গান্ধর্বীর সেতার হাতে বসে থাকা পশ্চাৎমুখী ছবি আঁকা প্রচ্ছদটি দেখে প্রথমেই তাই একটু চমকিত হই।
প্রথমেই বলি, পেপার ব্যাক হলেও কাগজের মান, বাঁধাই, ছাপার মান, বানান,অলঙ্করণ; সবকিছুই যথেষ্ট সুন্দর এবং মানোত্তীর্ণ। প্রতিবেদন, সৃষ্টি যেমন, অন্তর্দহন, স্মরণ-বরণ…- এই চারটি পর্বে ভাগ করে কবিতাগুলির শ্রেণীবিভাগও যথাযথ। বইটি হাতে নিয়েই বোঝা যায়, প্রকাশক এবং সম্পাদক যথেষ্ট যত্ন নিয়েই বইটির অঙ্গ সজ্জা রূপায়ণ করেছেন, যা অনেক বড়ো বড়ো প্রকাশনার ক্ষেত্রেও আজকাল দেখি না।
যাই হোক,শুরু করি,কাব্যসঙ্কলনটির আলোচনা।
উৎসর্গপত্রের ছোট্ট বারো লাইনের কবিতাটির প্রথম ছত্র থেকেই শুরু হয় প্রশান্তি,যখন কবির মনোভূমি সঞ্জাত কাব্যলতাটি আপন শ্যাম সৌন্দর্যে আমাদের মুগ্ধ করে, জীবনলতার অনিন্দ্য অবনতি এক করুণ মধুর সুরে বাজে কাব্য-প্রাণে,
"জীবনসাঁঝের বেদনার যত সুর
তাঁর প্রেরণায় আলোকের কণা হ'য়ে-
গোধূলিবেলায় আনন্দ দিয়ে যায়
দিনে আর রাতে হৃদয় রেখেছে ভ'রে।"
কবিহৃদয়ের এই সমর্পনধর্মী আনন্দ- উদ্ভাস ক্ষীণকায়া পুস্তিকাটিকে যেন মহীরুহ ছায়া দান করেছে। ভরসা পাই, শাশ্বত কাব্য অনুরাগ এখনও ভালো মানুষের সঙ্গ ছাড়েনি, তাই "উত্তরণ" কবিতায়,কবি যখন লেখেন, জীবনের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে থাকা জটিলতায় তিনি--
"মোহগ্রস্ত হয়ে আড়ষ্টের মতো
ডুবে যাই যেন এক গাঢ় কুয়াশায়"...
একটু দ্বিধায় পড়ে যাই। তবে তা ক্ষণস্থায়ী,অবশ্যই ঐ কবিতাটির শেষেই আবার কবি মনে ফিরে আসে কাম্য উত্তরণ,যা এই কাব্যসঙ্কলনটির প্রায় প্রতিটি কবিতাকেই এক অদ্ভুত উচ্চতা দিয়েছে।
তাই 'পরাজ্ঞানে মুক্তির আশ্বাস' নিয়ে 'আবেগ তরঙ্গ' ছুঁয়ে 'মর্ত্যের স্বর্গ' পর্যন্ত পৌছতে অসুবিধা হয় না তন্নিষ্ঠ পাঠকের।
তবে,এই আলোচনা চলাকালীন আরও একটি কথা না বললেই নয় যে, সঙ্কলনের কবিতাগুলির শিরোনাম নির্বাচন। যে কোন গল্প বা কবিতার ক্ষেত্রে শিরোনাম এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, কবি মুন্সিয়ানার সঙ্গে তা রক্ষা করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, "দাতা" কবিতায়,
'কোন এক ভাগ্যহীনা নারী
পেয়েছিল রাণীর মর্যাদা
রূপে নয়,গুণে নয়
বিলাসে বৈভবে নয়
নয় ত্যাগে,কর্তব্যে আচারে'…
নারীর ইত্যাকার বর্ণনা দিয়ে কাব্যপ্রবাহ এগোলেও কবিতার অথবা জীবনের শেষলগ্নে দাতাহীনা ভাগ্যহীনা নারী আশ্রয় চেয়েছেন,
"দানের মর্যাদা কিন্তু
অন্তরে সে রেখেছে গচ্ছিত''
কি অপূর্ব সংবেদনশীলতায় শেষ হয় পরিক্রমা, নামকরণের মাহাত্ম্যে আমরা তৃপ্ত হই।
তেমনই ছড়া আকারে লেখা কবিতা 'বিচারের দরবার'-কবিতাটি লঘুছন্দে লেখা হলেও তার রিমঝিম নূপুর-চলনটিতে আমাদের পাঠমুগ্ধতায় কম পড়ে না।
একই ছবি আঁকা হয় "আত্মিক মিলন" কবিতাটিতেও।
আবার, সেই একই কবি যখন লেখেন "হারানো ছবি" নামের কবিতাটি, ছেড়ে আসা সন্তানসম ছাত্রছাত্রীদের প্রতি এক দায়বদ্ধ শিক্ষকের আর্তি ও ভালোবাসা আমাদের মর্মে এসে পৌঁছয়,
"বিদায় বিধুর সেই দিনে
ওদের অশ্রু মনে পড়ে
দূরত্ব-ভয় দূরে ঠেলে
ওদের সে উষ্ণ আলিঙ্গন
কর্মজীবনের যত ব্যথা
ধুয়ে মুছে দিয়েছিল যারা-
তারা কে কোথায় তা জানিনা
ভুলিইনি সেই আবেদন…"
এই একই আশ্রয় মেলে প্রায় শেষের দিকে সঙ্কলিত 'মা গো' কবিতায়ও।
তবে এতোখানি মুগ্ধতার পরেও কিছু ব্যক্তিগত অভিযোগ রয়ে যায় যখন দেখি,বিদ্যাসাগর নামাঙ্কিত কবিতাটি স্হান পেয়েছে একেবারেই শেষে। হয়তো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভেবেই সর্বশেষে তার ঠিকানা নিরুপিত হয়েছে, তবুও,
''যেন মানবের রূপে আসা স্বর্গের কোনো দেবতারে
মর্ত্যের ঈশ্বর যেন গোলোকের ঈশ্বরের ভিন্ন এক ছায়া
ঠাকুরদাসের পুত্র-ভগবতী গর্ভে তুমি ধরেছিলে কায়া'...
এই সুন্দর ভক্তিরসে পূর্ণ কবিতাটি শেষে না দিয়ে প্রথমে দিলেও হয়তো পুস্তিকাটির গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়তো।
সবশেষে, চারিদিকে যেখানে চলছে যথেচ্ছ ধংস-মৃত্যু-অশান্তির হাহাকার, সেই একই সমাজের বাসিন্দা হয়েও লেখিকা তাঁর সারস্বত সাধনায় সত্য-শিব- সুন্দরের প্রতি তাঁর অন্তহীন আনুগত্য দেখিয়ে চলেছেন। এই সঙ্কলনের প্রতিটি কবিতা পড়তে পড়তেই পাঠক সেই নিষ্কলুস পবিত্রতার স্পর্শ পান, বারংবার পাঠের আগ্রহ জন্মায়, বলতে ইচ্ছে হয়, "মধুর তোমার শেষ যে না পাই…"। কবির অথবা তাঁর কাব্যগ্রন্থের সার্থকতা এখানেই।
একজন আলোচক এবং সহমর্মী পাঠক হিসেবে তাই বর্ষীয়ান কবির দীর্ঘ সুস্থ কাব্যিক ও শারীরিক কুশলতা কামনা করি, আশা রইলো এমন স্নিগ্ধ নান্দনিক কলমের অধিকতর ঋদ্ধতা। অন্তহীন শুভেচ্ছা।
0 Comments