জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব - ১/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব - ১

গৌতম বাড়ই 

গোড়ার কথা:-- এ কোন পৌরাণিক আখ্যান বা কাহিনী নয়। কিছু রক্ত- মাংসমাখা শরীর সর্বস্ব মানুষের কথা। এক বঙ্গীয়  সুন্দরী নারীর কথা। সে নারী আবার সামান্যা নয়, এক রাজকন্যাও বটে।  তিনি স্বাধীনচেতা, তিনি স্বেচ্ছাচারী, বড় অল্প পাওয়া গেলেও,  এক বড় ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে আছেন। তিনি এক প্রহেলিকা, তিনি এক রহস্যময়ী নারী। তাকে ঘিরে অনেক গল্পকথা, বিজয়গাথা। প্রাচীন যুগ পেরিয়ে, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে রাঢ়ের বিস্তীর্ণ ভূ- ভাগে দাঁড়িয়ে আছে  ঐতিহাসিক এক রূপক গল্পকথাও। সুসীমা হল সেই নারী যার দেহের সুষমায়, যার দেহের লাবণ্যে মুগ্ধ হয় দুনিয়ার পুরুষ জাতি। তার দেহের আলোতে ঢাকা পড়ে বুঝি সূর্যদেব স্বয়ং। তার লাস্য ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে ।

বিস্তীর্ণ জলরাশির  নদীটির কাছাকাছি সেই বঙ্গেশ্বরের 
রাজপ্রাসাদ, ছিলেন প্রবল প্রতাপ আর দোর্দণ্ড শক্তিশালী সেই বঙ্গরাজ। কাহিনীর শুরু আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে। কপিলাবস্তুর শাক্যরাজ গৌতম বুদ্ধের জন্মের পর আর যীশুখ্রীষ্টের জন্মের আগে। ষোড়শো জনপদের অন্যতম মগধ তখন শক্তিশালী রাজ্য। রাঢ়ের জনপদে গভীর জঙ্গল আর হিংস্র শ্বাপদদের হুঙ্কার‌। 

ইতিহাস কাউকে রেয়াত করে না। ইতিহাসের চাকা নাকি ঘোরে! ঘুরুক। চাকা অর্থাৎ চক্র বা সময়ের চক্র সে তো ঘুরবেই। আমাদের পৃথিবীও ঘুরছে কিনা। বঙ্গেশ্বর অন্তপুরে গিয়ে ক্ষেপে উঠলেন। রাজদরবারে রাজা  সময় মেপে সকালে আরোহণ করেছিলেন সিংহাসনে। সিংহাসন, সিংহ চিহ্নিত আসন বটে! পরবর্তীতে এই শব্দটি তাকে বিদ্রূপ করবে আর তাকে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিতও করবে। এখন সে যাক গে,  সময় দ্বিপ্রহর মানে দুপুরবেলা। রাজকন্যা সুসীমা তার সঙ্গীনী দাসীদের নিয়ে স্নানক্রিয়াতে বা একটু গুছিয়ে বলতে গেলে, স্নানবিহারে  গিয়েছেন গোলাপমহলে সেই সকালবেলায়, এখনও ফেরেননি। গোলাপমহল রাজমহল থেকে প্রায় দু-ক্রোশ পথ। বঙ্গেশ্বর নিজের আমোদ- প্রমোদের জন্য এক বিরাট জলাশয়ের মাঝে এ গোলাপমহল গড়ে তুলেছিলেন-----

শুভারম্ভ হল সেই কাহিনী, সঙ্গে হাইটেক- আই টি এনাবেলড- অতি-আধুনিকা বসন্তসেনার দিন-রাত যাপনের মধ্য দিয়েই।

সারাদিন এক অসহনীয় গরমে পুরো শরীরটা যেন ভেতর থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল। বসন্তসেনা এপাশ-ওপাশ করছিল ভেতর এবং বাইরের তপ্ততায়। তারপর কখন যে ক্রমে-ক্রমে  এক গভীর ঘুম প্রদেশে পাড়ি দিল নিজেই জানেনা। আর এরপরেই অদ্ভুতভাবে বসন্তসেনার ভিতরে আর এক সুসীমাময়ী বসন্তসেনা জেগে উঠবে প্রতিদিন নিয়ম করে। বসন্তসেনার ভালোই লাগে তার ভেতরের সেই কল্প- 
জাগরণকে। 
🍂

তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে একদল বণিক সমৃদ্ধশালী মহাজনপদ মগধরাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্রের দিকে যাচ্ছিলেন। যদিও, রেশমপথ ধরে  তাদের বেশিরভাগ বাণিজ্য ঘটে এই ভারত মহাদেশে। এবারে তারা সুদূর পূর্বের দ্বীপগুলো থেকে বাণিজ্য তরণী ভাসিয়ে এই দেশে এসেছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে কিছু গাধা ঘোড়া ভাড়া নিয়েছিলেন তাদের পণ্যবিক্রি করবেন বলে। সঙ্গে আছে রাঢ়ের মুটের দল । জিনিসপত্র চাপিয়েছে ভাড়া করা পশুদের ওপর। সমস্ত কিছু দেখাশোনা করছেন ঐ মুটের দলেরা। এমন কী বণিকদের থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করাও তারাই করেন।  আছে দস্যুদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবার জন্য ভাড়া করা লাঠিয়ালরা। এর আগেও তারা, মুটেরারদল, লাঠিয়াল আর অন্যান্য লোক-লস্করেরা এই বণিকদলের সহচর হয়ে প্রচুর উপঢৌকণ পেয়েছেন। এদের বাণিজ্য এইদেশে যতটা ভালো হবে , তারা জানে, ঠিক ততটাই বেশি পরিমাণে উপঢৌকন উপহার হিসেবে পাবে অর্থাৎ সেই পরিমাণ সম্পদ তাদের প্রাপ্তি হবে। এই বণিকদল সুদূর পশ্চিমের নয়, তাদের গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল সফেদ এবং গমেরদানার মতন রঙ। সাদায় মোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকানো নয়। উচ্চাকৃতি নয়, নাক খাঁদা বা বোঁচা। পুরুষ হলেও দাড়ি-গোঁফের বাড়বাড়ন্ত নেই। চোখের ওপর ভ্রু-দেশ নজরে পড়েই না। বাদ্যযন্ত্র সহযোগে এদেশের স্থানীয় ভাষাতে বিভিন্ন গানের মনোরঞ্জনের ব্যাবস্থাও করেছে ঐ পেশাদারী মুটেরার দল। গানের মর্মার্থ বড়ই চটুল। ইঙ্গিত আর শারীরিক তর্জমায় বণিকদলেরা ঐ গানে আনন্দ পেত খুব। এতে সাময়িক ফেলে আসা দেশ- সংসার আর পথের ক্লান্তি দূর করতেন তারা। দেশীয় মুটেরারদল এবং  সঙ্গের লোকজনও সব খাটো, বলিষ্ঠ,  তবে উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণের। তা বলে ঐ বণিকদলের সাথে এদের বিরোধ নেই কোনো । গান গাইছে আর লটবহর নিয়ে চলেছে প্রায় জনা পঞ্চাশেকের দল। তখন তাম্রলিপ্ত বন্দরের গরিমা সারা পৃথিবীতে। সেই তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে এদের পথচলা শুরু, রাত হবার আগেই রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে তারা। যেহেতু সাথে সম্পদে পরিপূর্ণ, দীর্ঘ পথে পাড়ি দিতে হলে সাবধান থাকতে হয়। দীর্ঘ বাণিজ্য অভিজ্ঞতায় দেশ-বিদেশের পথে পথে ভ্রমণ করে তারা জানে, প্রকৃতি আর পথ মুহূর্তে বদল হতে পারে। পথ শ্বাপদ- শঙ্কুল। দুর্জন দস্যুদল আর তস্করও অগুনতি আছে পথে।  তবে বসবাসের এলাকায় চাষাবাদ দেখে মনে হয় বড় উর্বর এ জমি। এদেশের লোকজন কৃষিকাজে পারদর্শী আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগ সম্পদশালী না হলেও, গরীব নয়, মাঝারি সম্পদের অধিকারী। এইভাবে দু-পক্ষকাল বা তারও বেশি সময় যাওয়ার পরে এই বণিকদলে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। অতীব সুন্দরী এক নারীর আগমন হল এই বণিকদের মাঝে। যাকে দেখলে চোখ সরে না। চোখ জিহ্বা রোম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সজাগ হয়ে ওঠে , এ পুরুষ মরুর দেশে হঠাৎ নারীর আবির্ভাবে। বণিক দেহ কবে কোথায় চায়নি নারীর সুখস্পর্শ? যে ভোগসামগ্রী ফেলে এসেছে ঘরে, দীর্ঘ পথের কর্মক্লান্তে তার তো আয়োজন চাই বাইরে। পৃথিবীর আদিম ব্যাবসা তাই এই দেহ-ব্যাবসা, সে নারীসম্পদ লুন্ঠন করেই হোক বা দারিদ্রতার সুযোগে ফন্দি-ফিকির করেই হোক, তাই বন্দরে- বন্দরে ঘাটে -ঘাটে জনপদে আজও এই ব্যাবসা চলে রমরমিয়ে। 

সেই অভুক্ত  বণিকদলের মধ্যে এসে দাঁড়ালো অপরূপা এক নারী। বেশভূষা স্খলিত, চোখে-মুখে ভালোমতন খেয়াল করলে পরিশ্রম ও ক্লান্তির, ভবঘুরে যাপনের সামান্য ইঙ্গিত থাকলেও, তবুও উজ্জ্বল আর  পরমাসুন্দরী এ নারী। উদ্দেশ্য কী? কী তার অভিপ্রায়? 

মুটেরদল  আর অন্যান্য কিছু লোকজন এগিয়ে গেল প্রথমে। বণিকদল আর স্থানীয় মুটের দলের মাঝে ভাষার বিস্তর ফারাক। কারও শব্দ কেউ বোঝে না। ভিনদেশী উভয়েই। তবে আকার ইঙ্গিতে ইশারায়  মানুষের দরকারে মানুষের কাছে আসতে মানুষের  আজ পর্যন্ত অসুবিধা হয়নি কোথাও ভাষার জন্য। "কী চাও তুমি নারী? " -অনেকে বলল একসাথে।

"চাই তোমাদের সঙ্গ, চাই তোমাদের আশ্রয় । আমি অসহায়া, বিপদগ্রস্ত, সময়ে সব বলব, এই মুহূর্তে চাই তোমাদের সহযোগিতা আর আশ্রয়"- উচ্চকন্ঠে জানাল সেই অজ্ঞাতা কুলশীলা। 

এ নারী শুধু পরমা সুন্দরী নয়। সেই স্খলিত বেশভূষণ দেখলেও কিন্তু বোঝা যাচ্ছে খুব ধনী ঘরের বটে। উচ্চ-বংশের কেউ  বা কোনো জনপদের রাজকুমারী নয় তো? সারাদেহ ভর্তি সোনার অলঙ্কার। এই অরণ্যপথে, লোকালয়হীন অঞ্চলে একাকী সে এলো কোথা থেকে? রেশমবস্ত্র পরিধানে। আর এই রেশমবস্ত্র দেখে বণিকদল তো তাজ্জব হল! আসলে তো তারা প্রধানত  ঐ রেশমের কারবারি। এই রেশমসুতোর বস্ত্রের দাম তারা জানে। কোটিতে গুটি নারী এ বস্ত্র পড়বার জন্য সৌভাগ্যবতী হয়! ঐ নারী অস্ফূট কন্ঠে বলল এরপর- " আমি বলতে গেলে অভুক্ত ক'দিন। পথে ফলমূল যা সংগ্রহ করেছি, খেয়েছি। আমায় খেতে দাও আগে কিছু। শারীরিক বল প্রয়োজন আগে। তারপর হয়ত প্রাণ ভরে বাঁচব।" ভয়ার্ত চোখে বারবার পিছন ফিরে দেখছিল।

বসন্তসেনা জানে সুসীমার কথা। তার জানা এই পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের সেই ক্ষুদ্র কাহিনী। এই গল্পের পিঠে ভর করে আসবে তার সেই গুহা আবাসের, অরণ্যবাসের  কাহিনী। 

বঙ্গেশ্বর রাজাধিরাজ আর কলিঙ্গরাজার দুহিতা তার মা । বঙ্গরাজ মেয়েকে বলেছেন -- " তুমি স্বেচ্ছাচারী। তুমি নিয়ম কানুন কিছুই মানো না। একজন নারী, একজন পুরুষের মতন আচরণ করতে পারেনা। তোমার লজ্জা আর কুন্ঠিতবোধ থাকা উচিৎ। "

সুসীমা চটজলদি বলেন - " কেন পিতা? অস্বীকার করছি না, আমি অবশ্যই বিদ্রোহী, এই রকম সমাজব্যবস্থার প্রতি। স্বেচ্ছাচারী কী?  তা আমি জানি না। " 

বঙ্গেশ্বর চেঁচিয়ে উঠলেন- " খবর পেয়েছি, তুমি তোমার আপন রাজপ্রাসাদের কক্ষে অনেক পরপুরুষের সঙ্গে রাতের পর রাত কাটাও। আমার ঘৃণা লাগে তোমায় রাজকন্যা বলে পরিচয় দিতে। আমার কন্যা বলে পরিচয় দিতে। তুমি কি অস্বীকার করবে ? এই বিশাল বঙ্গ সাম্রাজ্যের রাজা আমি। আমার গুপ্তচর বাহিনী,  আমার সেনা সদা সন্ত্রস্ত সজাগ। তাদের অগোচরে এই সাম্রাজ্যে কিছুই ঘটতে পারেনা। আর প্রতিটি খবর আমার কানে আসবেই। ঐ বেতনভূকদের ভয়ডর তো আছে আমার প্রতি। আমি চাইলে তোমার ঐ পুরুষসঙ্গীদের গুপ্তহত্যা করতে পারি, সরাসরি হত্যা করতে পারি। কিন্তু করিনা কেন জান? তুমি এই রাজ্যের রাজকুমারী, আমার কন্যা বলে। তবে ক্রমে তুমি আমার স্নেহ-মায়া-মমতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি। এই আমার শেষ উচ্চারিত চরম সাবধান বাণী।"

সবাই সমান কলিজা নিয়ে বোধহয় জন্মায় না। এতে সুসীমার যে কোনও ভাবের বদল হল তা কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হলো না। ধীরেসুস্থে সে তার পিতার কথার উত্তর দিল-" না পিতা, আপনি আমার জন্মদাতা হয়েও আমার মননের সঠিক বিচার করে উঠতে পারেন নি। আমার শরীরের তাপ-উত্তাপের কী জানেন আপনি? সব মানুষের মন-মনন- দেহের চাহিদা কী এক? আর কাকে বলছেন পরপুরুষ? তারা আমার বন্ধু, আর বন্ধু তো মানুষের মনোরঞ্জনের, মানুষের দূরূহ কোণের একান্ত সহচর। আশাকরি আপনি আপনার রাজন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারবেন না। আমি বন্ধুত্বের লিঙ্গভেদ করিনা আর এই দেহকে পবিত্র এক মন্দির বলে ভেবে নিয়ে আগল দিয়ে আমার চাহিদাকে অবদমিত করেও রাখতে পারব না। পুরুষ শারীরিক ভাবে যতই পরাক্রমশালী হোক না কেন, আমি আলাদা করে তাকে স্থান দেব না, প্রাধান্য দেব না। পুরুষকে আমি নাস্তানাবুদ করে ছাড়ি আমার শারীরিক যাদু কাঠিতে। প্রাকৃতিকভাবে একটা নারী আর পুরুষের শারীরিক গড়ন আলাদা হতে পারে, তবে আমি পুরুষকে দেখে সম্মান দেখিয়ে লিঙ্গভেদ করি না। আপনার মতামত , আপনার চাহিদার গুরুত্ব এখানে বেশি। কতটা গুরুত্ব পায় মা আপনার  কাছে? কখনও কী ভেবে দেখেছেন? তবে‌ এও বলছি, আপনি যা শুনেছেন তা অতি বেশিমাত্রায়। কানপাতলা হলে রাজধর্ম পালন করা খুব মুশকিল  পিতা। রাজধর্ম পালন করতে হলে, চোখ দিয়ে শুনতে হয় আর কান দিয়ে দেখাই শ্রেয়, পিতা। "

দুহিতার কথায় বঙ্গেশ্বরের দু-চোখ জ্বলে উঠল। একান্তে ঘরের ভিতরে পিতা-পুত্রীর এরকম কথোপকথন চলছিল। কথার নাদে এক অমঙ্গলজনক বার্তা যেন অন্তঃপুরে কলিঙ্গরাজের কন্যা তথা বঙ্গেশ্বরের স্ত্রীর কানে গিয়ে পৌঁছালো । ছুটে এলেন তিনি  রাজার কাছে। রাজার এই দুচোখ পরখ করেছেন রাণী অনেকবার। জানেন তার ভয়াবহ পরিণাম। রাজকন্যা আর রাজার মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। 

বসন্তসেনা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এরপরেই তার কল্প-জাগরণ ঘটবে কোনও এক সময়ে।

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments