জ্বলদর্চি

খাঁকড়ির রাজা দশরথ মাহাত /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮৫

খাঁকড়ির রাজা দশরথ মাহাত
সূর্যকান্ত মাহাতো


এক যে ছিল রাজা। হ্যাঁ, এ এক আশ্চর্য রাজার কথা। যার পূর্বপুরুষ কোন রাজা ছিলেন না। যার শরীরে কোন রাজরক্তও প্রবাহিত হয়নি। কোন উত্তরাধিকার সূত্রেও পাওয়া নয়, বরং তিনি নিজস্ব ক্ষমতা গুণেই রাজা হয়ে উঠেছিলেন। তাই এ 'কাহিনী' কেবল এক রাজার কাহিনী নয়, এক 'রাজা' হয়ে ওঠার কাহিনী। আপন প্রতিভাগুণে তার রাজা হয়ে ওঠার সেই কাহিনী যেমন অদ্ভুত তেমনি অনুপ্রেরণাদায়কও বটে। কারণ অতি সাধারণ এক কাড়া-মোষ চরানোর 'বাগাল' থেকে তিনি রাজা হয়ে উঠেছিলেন।  নয়াগ্রাম পরগনায় 'খাঁকড়ির রাজা' নামেই তিনি অধিক পরিচিত। হ্যাঁ, 'রাজা দশরথ মাহাত'র কথায় বলা হচ্ছে। তবে এ কথাও সত্যি যে, জঙ্গলমহলের সিংহভাগ মানুষ এ রাজার কথা জানে না। কারণ এই রাজা সম্পর্কে কেউ এক কলমও কালি খরচ করেননি। এমনকি বর্তমান ফেসবুক ও হোয়াটস আপের যুগেও রাজা ও রাজবাড়ি ব্রাত্য। কিন্তু কেন তিনি লোক চক্ষুর অন্তরালে? তবে কি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাওয়া? নাকি উদাসীনতা? উত্তর জানা নেই।

একজন অতি সাধারণ 'বাগাল' থেকে রাজা! কীভাবে হয়েছিল রাজা 'দশরথ মহাত'-র সেই রাজোত্থান? রাজার নাতি অর্থাৎ রাজা দশরথ মাহাতর ছোট ছেলে রাজেন্দ্রনাথ মাহাতর জ্যৈষ্ঠ পুত্র ধীরেন্দ্রনাথ মাহাতর কথায়, রাজা দশরথ মাহাতর পিতৃপুরুষের আদি বাসস্থান ছিল 'নিশ্চিন্তা' গ্রামে। দশরথ মাহাত পরবর্তীকালে সেখান থেকেই 'বালিগেড়িয়া'তে এসেছিলেন। এখানেই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাদের কাড়া-মোষ চরানোর জন্য 'বাগাল' হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কাজে নিষ্ঠা দেখিয়ে মালিকের বিশ্বস্ততাও দ্রুত অর্জন করে ফেলেছিলেন। তারপর মালিক বা প্রভুর সঙ্গে এক শর্ত হয়েছিল যে মোষ(মহিষ) এর বাচ্চা হলে সেই বাচ্চা যদি কাড়া(পুং) হয় তাহলে সেটা মালিকের এবং মোষ বা বকনা(স্ত্রী) হলে সেটা বাগালের। এভাবেই দশরথ মাহাত কিছু কিছু মোষের মালিকানা পেতে শুরু করেছিলেন। সেগুলোকে বিক্রি করে বেশ কিছু অর্থও সে জমাতে শুরু করেছিলেন। সেই সঙ্গে মাসোহারা তো কিছু ছিলই। এভাবেই সে অনেকটাই টাকা জমিয়েও ছিলেন। টাকাগুলো সর্বদা নিজের কোমরে গেজুয়ায় বেঁধে রাখতেন। তারপর হঠাৎ একদিন মুর্শিদাবাদের 'নবাব বাহাদুর' 'খেলাড়- নয়াগ্রাম' স্টেটের নিলাম ডাকেন। সেই খবর পেয়ে দূরদর্শী 'দশরথ মাহাত' নিলামে যোগ দিয়েছিলেন। এবং তার কোমরে বাঁধা পয়সা দিয়ে বন ও জঙ্গল মিলিয়ে মোট ১৬০০ একর জমি নিলামে গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার জন্য বেশ কিছু পরিমাণ বাৎসরিক রাজস্বও তাকে দিতে হত নবাব বাহাদুরকে। এরপরই তিনি রাজা হয়ে উঠেছিলেন।

অনেকে বলেন রাজা নয়, তিনি জমিদার ছিলেন। কারণ এখানকার সামন্ত জমিদারেরা নিজেদেরকে নাকি 'রাজা' বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করতেন। (ঝাড়গ্রাম: ইতিহাস ও সংস্কৃতি/মধুপ দে, পৃষ্ঠা- ১৪০) যাই হোক তার জমিদারির অংশও ছিল বেশ বিস্তৃত। নয়াগ্রামের দুধিয়াশোল, বেতঝরিয়া পাথরবাঁধ, ভেলাগুড়ি, খুকড়াশোল, পচাখালি, তুঙ্গাধুয়া, বড় খাঁকড়ি, ছোটখাঁকড়ি, কদমডিহা, ভালুকঘোরা, জামদাশোল রুকনিমারা ইত্যাদি ছিল রাজার জমিদারি অংশ।
🍂

এখানে একটা প্রশ্ন উঠে আসে, নয়াগ্রামে তো পূর্ব হতেই এক রাজবংশ(মান্ধাতা) ছিল, এমনকি নয়াগ্রামের খেলার গড় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দ্বিতীয় রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ। ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই গড় এর ভিত নির্মাণ করেছিলেন এবং শেষ করেছিলেন তার পুত্র 'বলভদ্র সিংহ'।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, পৃষ্ঠা- ১২৬) তাহলে 'রাজা দশরথ মাহাত' এখানকার জমি জায়গা হঠাৎ মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছ থেকে নিলামে নিতে গেলেন কেন? পূর্বেকার রাজবংশের রাজাদের জমি হঠাৎ মুর্শিদাবাদের নবাবের হাতেই বা গেল কীভাবে? তারও নাকি একটা ইতিহাস আছে। 'মধুপ দে' তার 'ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ব্রিটিশদের পূর্বে নয়াগ্রাম উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের রাজার অধীনে ছিল। নয়াগ্রাম রাজারা ছিলেন সামন্ত জমিদার। তবে স্বাধীন ছিলেন। কোন খাজনা দিতে হত না। কেবল বহিঃশত্রুর আক্রমণ হলে সৈন্যসহ ময়ূরভঞ্জের রাজাকে সাহায্য করতে হত। ময়ূরভঞ্জের রাজা নয়াগ্রামের রাজাকে 'মংরাজ ভূঞা' উপাধিও দিয়েছিলেন। পরে উড়িষ্যা মারাঠাদের অন্তর্ভুক্ত হলে নয়াগ্রামও মারাঠাদের অধীনস্থ হয়।(ঝাড়গ্রাম: ইতিহাস ও সংস্কৃতি/ মধুপ দে, পৃষ্ঠা- ১৪৬) এরপরের কথা যোগেশচন্দ্র বসুর 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ১৮০৩ সালে 'মারহাট্টার' যুদ্ধের পর মারাঠি অধিকৃত জায়গাগুলো ব্রিটিশ কোম্পানি যখন দখল করতে শুরু করেছিল, নয়াগ্রামের রাজা সে সময় পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে ইংরেজ গভর্মেন্ট তার পুত্র পরশুরাম সিংহকে তার বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন। পরে শেষ রাজা, পৃথ্বীনাথ সিংহ মান্ধাতা ১৮৮৪ সাল বাংলা ১২৯০ সালের ২০শে আশ্বিন অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তার দুই পত্নী কুঙরমণি ও গোলকমণি-র মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে নানা গলযোগ তৈরি হয়েছিল। তাই জমিদারী ১৮৮৬ সালে 'কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের' তত্ত্বাবধানে চলে গিয়েছিল। এদিকে রাজা পৃথ্বীনাথের এত বেশি দেনা করেছিলেন যে তা পরিশোধের জন্য 'খেলাড় নয়াগ্রাম' পরগনাটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। আর সেটাই ১৮৯০ সালের ৮ই জুন পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে মুর্শিদাবাদের 'নবাব বাহাদুর' রেজিস্ট্রিকৃত দলিল দিয়ে তা কিনে নিয়েছিলেন।(মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশ চন্দ্র বসু, পৃষ্ঠা- ৫৩৬)

সে কারণেই মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের কাছ থেকে দশরথ মাহাত নিলামে খেলাড়-নয়াগ্রামের এই অংশ নিয়েছিলেন। নিলেও ঠিক কি ছিল সেই চুক্তিপত্র? যদিও এখন তার কোন স্বাক্ষরিত তথ্য প্রমাণ রাজ পরিবারের কাছে আর সংরক্ষিত নেই। তবে দশরথের নবাবকে দেওয়া রাজস্বের একটি শেষ প্রতিলিপি আছে। যেখানে বাংলা '১৩৪৭ বঙ্গাব্দ' তারিখের উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে রাজার নাতি ধীরেন্দ্রনাথবাবু জানালেন, তার কাছেও বেশ কিছু মূল্যবান নথি ছিল, কিন্তু সেগুলোও হারিয়ে গেছে। এমনকি রাজার জন্ম মৃত্যু সাল কোন কিছুই এখন আর তারা বলতে পারছেন না। অথচ রাজ পরিবারের সেইসব ঐতিহাসিক তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা গেলে দারুণ এক ইতিহাস রচিত হতে পারত।

বর্তমানে 'রাজ বাড়িটি' কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো বেশ কিছু বছর পর সেটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রাজা দশরথের মতো হয়তো বা সেটাও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। ধীরেন্দ্রবাবু জানালেন ১২ কাঠা জমির উপর এই রাজবাড়ীটি গড়ে উঠেছে। মূল ফটক, কাছারি ঘর, সদর দরজাগুলো এখনো আছে। দরজার উপর বেশ নকশা ও কারুকার্য এখনো কিছু কিছু অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। রাজবাড়ীটি অন্যান্য আর পাঁচটা রাজবাড়ীর মতোই। তবে আয়তনে কিছুটা ছোট এই যা। মূল বাড়ির সামনে এখন যে মাটির বাড়িগুলো রয়েছে তার নিচের অংশগুলো রাজবাড়ীর পরিত‍্যক্ত অংশ বলেই মনে হল। সেটা যদি রাজবাড়ীর অংশ বা উঠোন হয় তাহলে সেটা যে বিরাট এলাকা জুড়ে একসময় অবস্থিত ছিল তা দেখলেই বোঝা যায় যে রাজবাড়ীটা কতটা প্রসারিত ছিল। মূল রাজবাড়ীতে রাজার চার ছেলেই এক সময় অবস্থান করতেন। এখন পরিবারের সদস্যরা পৃথক পৃথক অবস্থান করেন।

জঙ্গলমহলের রাজাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা একটি করে 'মন্দির' নির্মাণ করতেন। যেমন ঝাড়গ্রামের রাজা কর্তৃক সাবিত্রী দেবীর মন্দির নির্মিত হয়েছিল। আবার রামগড়ের রাজা নির্মাণ করেছিলেন কালাচাঁদের মন্দির। সেইরকম দশরথ মাহাতও একটি 'রাস-মন্দির' নির্মাণ করে গেছেন। ধীরেন্দ্রনাথবাবু সেটার সময়কাল ১৩২৭ বঙ্গাব্দ বলেই জানালেন। এই সময়কাল থেকেও রাজার সময়কাল অনেকটা অনুমান করা যায়। প্রতি বছর রাসের সময় বেশ ঘটা করে পূজা অর্চনা হয়। মন্দিরের ভিতর রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি রয়েছে। এক সময় এখানেও নাকি 'ইন্দ্রধ্বজ' উত্থাপিত হত এমনটাই জানালেন পরিবারের সদস্যরা।

রাজা দশরথ মাহাত নিজে ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু শিক্ষা প্রসারে তার বেশ অবদান ছিল। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ছেলেকে পড়িয়েছেন। পড়াশোনাই উৎসাহও দিতেন। এমনকি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল, বেলদা স্কুল সহ একাধিক স্কুল নির্মাণে তিনি কাঠ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন বলে ধীরেন্দ্রনাথবাবু জানালেন।
রাজা দশরথ মাহাতর দুই স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্ত্রী ছিলেন নিঃসন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রীর চার পুত্র ও এক মেয়ে ছিল। বড় দুর্গাপ্রসাদ মাহাত। মেজো রামচন্দ্র মাহাত। সেজো হরিশচন্দ্র মাহাত। ছোট রাজেন্দ্রনাথ মাহাত। এবং একমাত্র কন্যা জানকী মাহাত। 'রামচন্দ্র মাহাত' স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন বলেও জানালেন। মেদিনীপুর জেলাশাসক 'বার্জ হত্যার' সময় তিনি নাকি মেদিনীপুরে ছিলেন। বার্জ হত্যার ঘটনার পরেই রাজা তাকে দ্রুত মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে এনেছিলেন।
তবে কি তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? তা না হলে ব্রিটিশদের গ্রেপ্তারের ভয়ে রাজা সেসময় কেন তাকে দ্রুত মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে এনেছিলেন!

বর্তমানে রাজবাড়ীর ঠিকানা হল- মৌজা- কদমডিহা, পো: নেগুই, থানা- নয়াগ্রাম, জেলা- ঝাড়গ্রাম। যে কেউ সেখানে গেলেই 'রাজবাড়ি' ও 'রাস মন্দির' প্রত্যক্ষ করে আসতে পারবেন।

Post a Comment

0 Comments