জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৭ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৭ 
সালেহা খাতুন 

উলুবেড়িয়া কলেজে বাবা পড়েছেন। আমিও পড়েছি। এমনকি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পরের স্তরের পড়াশোনা অন্যত্র করলেও পরীক্ষা দিতে এসেছি এই কলেজে। এই কলেজের সাথে নাড়ির যোগ। আমার দিদিরা সবাই এখানে পড়েছে। আমি যে দিদির মতো হতে চেয়েছিলাম বা মা আমার সামনে যাকে আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই চিনা দিদিও এখানে কেমিস্ট্রি অনার্স পড়েছে। আমি যখন এই  কলেজে পড়ছি দিদিও তখন পড়ছে। ফলে দিদির বন্ধু সুলতাদি আমাদের এলাকার বাসিন্দা হলেও চিনাদির সূত্রেই আমাকে খুব ভালোবাসতো। চিনাদি এককথায় আমার প্রাণের দোসর। 

বড়দি মিনুদিদির সঙ্গে ছোটোবেলায় মসুদিদির রেলের কোয়ার্টারে গিয়েছি। মিনুদিদির বিয়ের অনুষ্ঠানের কথাও মনে আছে। তবে সবচেয়ে বেশি মনে আছে মিনুদির প্রথম সন্তানের জন্মের সময় রাতের অন্ধকারে ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী এক মহিলাকে ডাকতে গিয়েছিলাম বড়োমাসির গৃহকর্মে সাহায্য করতেন যে ভদ্রমহিলা তাঁর সঙ্গে। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। আর রীণুদির বিয়ের সময় আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। 

ফলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যখন বড়োমাসির কাছে যেতাম চিনাদি মিলাদি টিঙ্কুদি এবং টুম্পাদিকে পেতাম। প্রচুর গল্প হতো আমাদের। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়েছিল উলুবেড়িয়া হাইস্কুলে। বড়োমাসির বাড়ির খুবই কাছে। আর পরীক্ষার সময় ট্রেন চলাচল যদি ঠিকঠাক না থাকে এই আশঙ্কায় বাবা আমাকে বড়োমেসো এবং বড়োমাসির দায়িত্বে তাঁদের কাছে রেখে আসেন। এই উদ্দেশ্যে বেশ কিছুদিন মাসির বাড়ি ছিলাম। এতো দীর্ঘদিন মনে হয় আর কখনো থাকিনি। এজন্য মাসতুতোদিদি ও ভাইদের সঙ্গে অন্যদের তুলনায় আমার আলাদা একটা বন্ধন আছে। 

তখন দুবেলা পরীক্ষা হতো। মাঝখানে একটা ব্রেক থাকতো। চিনাদি পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিত। মেসো কোর্টের ফাঁকে টিফিন নিয়ে মাঝের ব্রেকে যেতেন। আর মাসতুতো ভাই বুবাইও গেছে।  টুম্পাদি রোজ খুব সকালে মুড়িজল বানিয়ে দিয়েছে পেট ঠাণ্ডা রাখার জন্য। টিঙ্কুদি   যত্ন করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়। মিলাদি খাইয়ে দিয়েছে। 
মাসির বাড়ির পরিবেশ ছোটোবেলায় আমার কাছে ছিল রূপকথার জগত। আর সেই জগতের মহারাণী আমার বড়ো মাসি। আধুনিক সভ্যতার সমস্ত উপকরণ কোন ছোটোবেলা থেকে ঐ বাড়িতে দেখে আসছি। বাঙালি অভিজাত মুসলিম পরিবার। উলুবেড়িয়া কোর্টের দুঁদে অ্যাডভোকেট ফজলুল হক মোল্লা আমার মেসো। বন্ধুদের কাছে আমার দর বেড়ে যায়। নন্দিতা বালা, পিয়ালি কর এরা আমার মেসোকে বিশেষ ভাবে চিনতো। তিনি তাঁর সব কাজ ছেড়ে আমাকে সময় দিচ্ছেন এটা তাদের অবাক করতো। পরীক্ষার মাঝে ইদ পড়লেও বাড়িতে যাই নি। বাবা চিনাদিকে দায়িত্ব দেন আমাদের দুইবোনের জামা কেনার। সুন্দর দুখানা সালোয়ার কামিজ পছন্দ করে কেনে চিনাদি। চিনাদির থেকে বয়সে আমি ছোটো হলেও আমাদের মানসিকতার সাযুজ্য ছিল অনেকটাই। ফলে দুজনেই দুজনের কাছে মন খুলে কথা বলতাম। 
🍂

এই পরীক্ষার মাঝেই আমি বড়ো মেসোর বাড়ির লাইব্রেরিতে থাকা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সমগ্র পড়ে ফেলি। অবশ্য ক্লাস সিক্সে বাবার সংগ্রহে থাকা “চন্দ্রশেখর” উপন্যাস লুকিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম। এটিই আমার প্রথম পড়া উপন্যাস। 

আমাদের আর এক আত্মীয়া মনিরাদি তখন উলুবেড়িয়া কলেজে হিস্ট্রি অনার্স পড়তো। সেই দিদি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল ভবিষ্যতে আমি কোন সাবজেক্টে অনার্স পড়তে চাই। কলেজ থেকে ফেরার পথে ট্রেনে উঠতে উঠতে বলেছিলাম সেটা কী? এতোই অজ্ঞ ছিলাম যে উচ্চমাধ্যমিক পড়াকালীনও জানতাম না অনার্স ব্যাপারটা আসলে কী জিনিস!!

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments