জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—কানাডা (উত্তর আমেরিকা)শিকারির শপথ /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 

দূরদেশের লোকগল্প—কানাডা (উত্তর আমেরিকা)
শিকারির শপথ
চিন্ময় দাশ

ছেলে-বউ নিয়ে সংসার এক শিকারির। তার বাড়িটা লোকালয় থেকে অনেকটা দূরেই। তবে নিজেদের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকে তার। অন্য কারও মুখ দেখা গেল কি গেল না, তা নিয়ে কিছু যায় আসে না তাদের। 
ভালো শিকারি হিসাবে বেশ নামডাক আছে লোকটার। শীতকালে যা শিকার করে, সেই মাছ আর মাংস দিয়ে, সারা বছর হেসেখেলে চলে যায় তাদের। 
বসন্তকাল এলে, তীর-ধনুক তুলে রেখে দেয় শিকারি। ঘর থেকে বেরুলেই ম্যাপল গাছের জঙ্গল। ছুরি আর ভাঁড় নিয়ে বনে ঢুকে পড়ে। ম্যাপলের রস সংগ্রহ করে আনে। ম্যাপল সিরাপ আর ম্যাপলের চিনির কদর দুনিয়া জোড়া। বিক্রিবাটা করে না। সংসারের সারা বছরের রসদ জোগাড় করে রাখে শিকারি।
তখন গরমের দিন। একদিন হয়েছে কী, তিনটে ভালুক ছানা ঢুকে পড়েছে শিকারির গুদামঘরে। চিনির মজুত সাবাড় করে ফেলেছে প্রায়। 
দেখে তো মাথায় আগুন জ্বলে গেল লোকটার। তীর-ধনুক নামিয়ে, তিনটাকেই গেঁথে দিল চোখের পলকে। মাথা ঠাণ্ডা হোল না তাতেও। বাচ্চাগুলোর চামড়া ছাড়িয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে দিল। মনে ভাবনা, হাতের দস্তানা বা মাথার টুপি বানিয়ে নেবে চামড়া দিয়ে। চিনির ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে যাবে তাতে। 
শিকারির বউ কিন্তু মোটেই খুশি হোল না কাজটাতে। মাথা নেড়ে বলল—কাজটা একেবারেই ভালো করোনি। যতই হোক, ঐটুকু বাচ্চা তো!
পরদিন ভালুক বেরিয়েছে বাচ্চাদের খোঁজে। কাল সারা দিনরাত গোটা বন খুঁজেছে তোলপাড় করে। আজ বেরিয়েছে লোকালয়ের দিকে। যদি কোথাও সন্ধান পাওয়া যায়, এই আশায়।
শিকারির বাড়ির সামনে এসে, আকাশের বাজ ভেঙে পড়ল তার মাথায়। তার বাচ্চাদের তিনটে চামড়া দড়িতে ঝুলছে! বুঝতে কিছু বাকি রইল না তার। 
লোকটার বেড়ার আগড় ধরে ঝাঁকাতে লাগল ভালুক—হায় ভগবান, আমার তিনটে বাচ্চাকেই মেরে ফেলেছিস তুই? ঐটুকু শিশুদের মারতে, হাত উঠল কী করে তোর? এবার দ্যাখ আমি কী করি? তোর বউ বাচ্চাদেরও রেহাই নাই আমার হাতে থেকে। এবার তোর একদিন কি আমার একদিন। তোর গুদামঘরের সব খাবার দাবার সাবাড় করে দেব আমি। এই বলে গেলাম।
ভয়ে রাগে গোটা শরীর কাঁপছে। তীর ছুঁড়ল বটে শিকারি, ভালুকের গায়ে বিঁধল না। এর পর বেশ ক’দিন তন্ন তন্ন করে সারা বন খুঁজে বেড়াল শিকারি। কিন্তু ভালুকের টিকির দেখাটিও পাওয়া গেল না। 
এদিকে ভালুক থাকে তক্কে তক্কে। রাতের বেলা ঠিক শিকারির ভাঁড়ার ঘরে এসে ঢুকে পড়ে মওকা বুঝে। টেরটিও পায় না শিকারি।
🍂

শিকারির তো মাথায় হাত। একটু একটু করে মজুদ কমে যাচ্ছে তার। এভাবে চললে তো, না খেয়েই মারা পড়তে হবে পুরো পরিবারকে।
হতাশ হয়ে শিকারি ভাবল, আমার দ্বারা ভালুকের সন্ধান হবে না। অন্য কারও একটা পরামর্শ নিতে হবে। 
বনের গা দিয়ে একটি নদী বয়ে চলেছে। অনেক দূরের চুনা পাহাড়ের দেশ থেকে নেমে এসেছে এই নদী। অনেক ভেবে, নদীর কাছে গিয়ে হাজির হোল শিকারি—দোহাই ঠাকুর, এই হতভাগা ভালুকটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাও তুমি। জল খেতে তো আসেই তোমার কাছে। 
জলদেবতা বলল—না, বাপু। গায়ে কালি লাগে, এমন কোন কাজ করব না আমি। তাছাড়া, হাজার হাজার ঝিনুকছানা জন্মাচ্ছে সাগরে। আমি চুন-গোলা জল বয়ে নিয়ে গেলে, তবে না তারা বড় হবে। দাঁড়াবার সময় আছে না কি আমার? 
নদী বয়ে চলে গেল নিজের গতিতে।
এবার বাতাসকে ধরে পড়ল শিকারি—দয়া করো, ঠাকুর। আজকের রাতটা আমার এখানে থাকো তুমি। রাতের বেলায় বদমায়েস ভালুকটা চুরি করতে এলে, ভয়ানক ঝড়ে একটা গাছের ডাল ভেঙে ফেলে দাও তার উপরে। ভালুকের উৎপাতে ছেলে-বউ নিয়ে আমি মরতে বসেছি।
বরুণ দেব বলল—আমার কি দাঁড়াবার জো আছে নাকি? নৌকা জাহাজ সব সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সাগরের পাড়ে। আমি না গেলে, তারা রওণা দেবে কী করে? পালে তো বাতাস লাগা চাই তাদের। 
বাতাসও চলে গেল নদীর মত। শিকারি এবার ধরে পড়ল মেঘের দেবতাকে (আমাদের যেমন ইন্দ্রদেব।)—একটা রাত আমার ঘরে থাকো ঠাকুর। ভালুক এসে ঢুকলে, ছোট্ট করে একখানা বাজ ফেলে দাও। পুড়ে মরুক ব্যাটা। ছেলে-বউ নিয়ে আমি যে মারা পড়ব এবার। 
দেবতা বলল—এখন গরমের দিনকাল। সব শুকিয়ে কাঠ। খেতের শাকসবজি, মাঠঘাটের ঘাসটিও হাঁ করে চেয়ে আছে আমার জন্য। আমি গিয়ে বৃষ্টি না দিলে, তারা পাতা মেলবে কী করে। আমার কি দাঁড়াবার জো আছে, বাপু?
হতাশ হয়ে একেবারে ভেঙে পড়ল শিকারি। তাকে ভালুকের হাত থেকে বাঁচায়, এমন কেউ নাই এই দুনিয়ায়। কী করা যায় ভাবছে, এমন সময় এক থুত্থুরে বুড়ি সামনে এসে হাজির। 
--অনেক দূরের পথ ভেঙে আসছি। শরীর বইছে না আর। এক টুকরো খাবার, আর এখানে একটু বসতে দেবে, বাছা? 
শিকারি বলল—এক হতভাগা ভালুকের পাল্লায় পড়েছি। রোজ রাতে আমাদে খাবার সাবাড় করে দিচ্ছে। সামান্য খাবারই আছে আমাদের। তবে, তা থেকেই তোমাকে অবশ্যই দেব কিছুটা। 
বাড়ি থেকে খানিকটা খাবার নিয়ে এলো শিকারি। বুড়ি খেতে লেগেছে। শিকারি তাকে নিজের সমস্যার কথা শোনাতে লাগল। শেষে বলল—আমার মন বলছে কোন মানুষের পক্ষে এই ভালুককে মারা সম্ভব নয়। কিছু যাদু আছে ব্যাপারটার মধ্যে। 
খাওয়া শেষ করে, বুড়ি বলল—ঠিকই বলেছ। কোন মানুষ এই ভালুককে মারতে পারবে না। তবে আছে ছোট্ট একটা জীব। একমাত্র সেই পারবে ভালুকটাকে খতম করতে। 
শিকারি অবাক হয়ে বলল—একটা ছোট্ট জীব পারবে কাজটা? সে কে? পাবো কোথায় তাকে আমি?
--ব্যস্ত হও কেন? কোন কাজেই ব্যস্ততা ভালো নয়। বুড়ি বলল—তুমি আমার উপকার করেছ। আমিও তোমাকে সাহায্য করব। একটা যাদুকাঠি দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। 
হাতে একটা কাঠের বাক্স ছিল। তা থেকে একটা কাঠি বের করে, শিকারিকে ধরিয়ে দিল বুড়ি। বলল— নদীর পাড়ে যাও। সেখানে গিয়ে আমি যে মন্ত্রটা বলে যাব, সেটা আওড়াবে। তারপর কাঠিটা তিন বার বাতাসে ঘুরিয়ে, ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম থেকে জেগে, সামনে দেখবে একটা ছোট্ট জীব। সে-ই তোমাকে উদ্ধার করবে এই ঝামেলা থেকে। 
বলেই, যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি একেবারে হঠাৎই মিলিয়ে গেল কোথায়। ছোটবেলায় মায়াবি নীল পাহাড়ের গল্প শুনেছিল ঠাকুমার কাছে। সেই গল্প মনে পড়ল শিকারির। এ বুড়ি নিশ্চয় সেই পাহাড়ে থাকে। বেশ চমকে গেল বটে, তবে বুড়ির কথামতই চলবে, এটাও ভেবে নিল।     
কাঠিটা তিন বার বাতাসে ঘুরিয়ে, শিকারি চেঁচিয়ে উঠল—   এসো বন্ধু, সামনে এসো, 
শক্তি দেখাও তোমার। 
চটজলদি ভালুক মেরে
ফ্যাসাদ ঘুচাও আমার।

বুড়ি যেমনটি বলে গিয়েছে। পর পর তিনবার ছড়াটা চেঁচিয়ে গেল  শিকারি। তখনই ঝিমুনি এসে গেল, নদীর পাড়েই শুয়ে পড়ল গা এলিয়ে।
তবে বেশি সময় গেল না। রোদের তাতে খানিক বাদেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখ দুটো রগড়ে নিয়ে খুলতেই, সামনে গাছের আড়াল থেকে কাউকে একটা উঁকি মারতে দেখল। বুড়ির নির্দেশ  মতো, বিড়বিড় করে মন্ত্রটা আউড়ে গেল—
এসো বন্ধু, সামনে এসো, 
শক্তি দেখাও তোমার। 
চটজলদি ভালুক মেরে
ফ্যাসাদ ঘুচাও আমার।।

আড়াল ছেড়ে, একটা ধূসর রঙের নেউল (বেজি) এসে হাজির হোল সামনে। শিকারী ভাবল, মায়াবি পাহাড়ের বুড়ি চাতুরি করে গেছে তার সাথে। এই পুঁচকেটা কি না মারবে মস্ত একটা ভালুককে! 
শিকারি প্রশ্ন করল—কে তুমি? 
--আমি একজন নেউল। মায়াবি পাহাড়ের বুড়ি পাঠিয়েছে এখানে। তোমার জন্য ভালুক মারতে হবে আমাকে। 
শিকারী হেসে উঠল শুনে—তুমি মারবে ভালুক? এই চেহারা নিয়ে? ভালুক একবার হেঁচে দিলেই তো তুমি কোথায় উড়ে চলে যাবে।
--ব্যাপারটা অতো সোজা নয়। তোমার হাতে এই যে যাদুকাঠি, এটার বলেই আমি বলীয়ান। আমার এই দাঁতগুলো দেখতে পাচ্ছো? দুনিয়ার যে কোন জীবকে মেরে ফেলতে পারি আমি।
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। শিকারি বলল—তাহলে আর কী? কাজে লেগে পড়ো। আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে যাই।
--দাঁড়াও, দাঁড়াও। অতো ব্যস্ত হয়ো না। আগে বলো, কী দাম দেবে আমার কাজের?  
--তুমিই বলো, কী দাম চাও তুমি?
--শরীরটা দেখেছ আমার। ম্যাড়মেড়ে ধূসর রঙের একটা পোষাক পরে ঘুরে বেড়াতে হয়। একেবারে শেয়ালদের মতো। কী বিচ্ছিরী, কী বিচ্ছিরী!
শিকারি বলল—আমি তার কী করতে পারি? বিধাতা যাকে যেমন দিয়েছেন।
নেউল বলল—বুড়ির দেওয়া যাদুকাঠি আছে তোমার হাতে। অনেক কিছুই করতে পারো তা দিয়ে। ধবধবে সাদা রঙের একটা কোট চাই আমার। সেটা পরেই বনে ঘুরে বেড়াব এবার থেকে।
তিন বার যাদুকাঠিটা ঘোরাতেই, শিকারির চোখ ছানাবড়া। ঝলমলে সাদা লোমে ঢাকা একটা নেউল তার সামনে। যেন শীতের প্রথম পড়া বরফ। ধুলোকণার সামান্য দাগও ধরেনি তাতে। তার পাঁশুটে রঙের জামা কোথায় উধাও!
নেউল ভারি খুশি সাদা জামা পেয়ে। বলল—এবার একটা শর্ত করতে হবে তোমাকে। 
--চাহিদা মতো সাদা জামা পেয়ে গেছো। আবার শর্ত কিসের?
নেউল বলল-- শর্ত করো। জীবনে কখনও বাচ্চা ভালুকদের শিকার করবে না তুমি। যত দিন কোন জীব, নিজে শিকারে বেরুবার মতো বড়টি না হবে, তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবেও না কখনও। বলো, রাজি?
শিকারির আর দেরি সয় না। যাদুকাঠিটা হাতে ধরা। সেটা ছুঁয়ে বলল—এই যাদু কাঠি ছুঁয়ে শপথ করলাম, কম বয়সী কোন জীবকে কখনও শিকার করব না। 
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হাতের কাঠি আর হাতে রইল না তার। ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল বাতাসে। হাসি মুখে নেউলও চলল তার কাজে।
ভরপেট খেয়ে ঘুম দেওয়া ভালুকদের অভ্যেস। সেদিনও ভালুক ঘুমোচ্ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে নদীর পাড়ে। চার পা আকাশের দিকে উঁচিয়ে তোলা। নাক ডাকছে বেদম জোরে। যেন জলপ্রপাতের শব্দ। 
নেউল একেবারে গলার পাশটিতে এসে দাঁড়াল—এই তোমার শেষ নাক ডাকানো। দুষ্টু চোর কোথাকার! বলেই এক মরণ কামড় ভালুকের গলায়। টুঁটি কামড়ে ধরেছে। ছটফট ধ্বস্তাধস্তি করেও, সুবিধা হোল না। মরেই গেল ভালুক। 
ভালুকটা মারা পড়েছে। শিকারির তো আনন্দ ধরে না। বড় একটা ভোজসভা ডেকে দিল বাড়িতে। হবে না কেন? ভালুকের জিভটা কেটে এনে শিকারিকে দিয়েছিল নেউল। সেদিনের ভোজসভায় সেটিই সুস্বাদু পদ। ভোজসভায় নেউলও হাজির ছিল সেদিন।
সেই থেকে, দুটো জিনিষ দেখা গেল দেশে (কানাডাতে)।  এক-- কানাডা সহ উত্তর আমারিকায় কয়েক ধরণের নেউল দেখা যায়, গায়ের রঙ সাদা তাদের। ২-- সেদিন থেকে সেই এলাকার শিকারীরা কমবয়সী কোন জীবকে হত্যা করে না। বেড়ে উঠবার সুযোগ দেয় বাচ্চাগুলোকে।

Post a Comment

0 Comments