ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৪
বিজন সাহা
গির্জার শহর উগলিচ
উগলিচ রাশিয়ার বিখ্যাত গোল্ডেন রিং বা সোনালি চক্রের বাইরে অন্যতম শহরগুলোর একটি। গোল্ডেন রিং এটা সোভিয়েত আমলে তৈরি এক পর্যটন রুট যা উত্তরপূর্ব প্রাচীন শহরগুলোকে এক সূত্রে যোগ করেছে। এসব শহরে রাশিয়ার অনন্য ঐতিহাসিক স্মৃতি ও সংস্কৃতি সংরক্ষিত থাকায় এখনও দেশ বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। উগলিচে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৬৯২ সালে স্থাপিত রক্তের উপর দ্মিত্রি গির্জা সহ উগলিচ ক্রেমলিন, ১৭১৩ সালে স্থাপিত স্পাসো-প্রেওব্রাঝেনস্কি গির্জা, ১৪৮২ সালে তৈরি যুবরাজ দ্মিত্রির ঘর, সেন্ট ভস্ক্রেসেনস্কি মনাস্তির, ১৮৪৩ – ১৮৫৩ সালে তৈরি বোগোইয়াভলেনস্কি মনাস্তির, আলেক্সেয়েভস্কি মনাস্তির, রঝদেস্তভো ইয়োয়ানা প্রেদতেচি, করসুন গড মাদার আইকন গির্জা, ১৭৭৮ সালের তৈরি কাজানস্কায়া গির্জা, ১৭৯৮- ১৮১৪ সালের প্রতিষ্ঠিত দ্মিত্রি না পোলে গির্জা, শুকনো পুকুরে নিকোলা গির্জা, ভস্ক্রেসেনিয়ে খ্রিস্তা গির্জা ইত্যাদি। গির্জা ছাড়াও এখানে আছে প্রাচীন বানিজ্য কেন্দ্র। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের কাঠের বসত বাড়ি এখনও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আছে নিকোলা উলেইমিনস্কি মনাস্তির। গোল্ডেন রিঙের খুব কাছে হওয়ায় প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখান আসে। সোভিয়েত আমলে তো বিশেষ ব্যবস্থায় এসব শহরে নিয়ে আসা হত পর্যটকদের। এছাড়া গ্রীষ্মে যখন নদীপথ খুলে দেওয়া হয় তখন মানুষ দলে দলে এখানে আসে জাহাজে করে। আগেই বলেছি এখানে বর্তমানে মাত্র ৩২ হাজারের মত লোক বাস করে। কিন্তু পর্যটকদের ভিড়ে মনে হয় এর জনবসতি অনেক। পর্যটনই এসব শহরের আয়ের অন্যতম উৎস। তাই লোকজন খুব বন্ধুবৎসল।
তবে উগলিচ শুধু গির্জার জন্যই নয়, মিউজিয়ামের জন্যও বিখ্যাত। এখানে বিভিন্ন ধরণের মিউজিয়াম আজ কাজ করছে। আছে ঐতিহাসিক-স্থাপত্য ও শিল্প বিষয়ক মিউজিয়াম। রাশিয়ার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় মিউজিয়ামও এখানে। আছে উনবিংশ শতকের শহুরে জীবনের যাদুঘর, উগলিচের ইতিহাসের যাদুঘর, আছে পুতুলের যাদুঘর আর জেলখানার শিল্পের যাদুঘর। রাশিয়ান ভোদকার যাদুঘর অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেমন করে রুশ জনগণের মিথ ও কুসংস্কারের কর্মশালা। এছাড়াও আছে কর্মী ঘোড়ার যাদুঘর, উগলিচ-টাইম শো রুম, কালাশনিকভ মিউজিয়াম, মোরগের পার্ক কাম যাদুঘর, বাইসাইকেল মিউজিয়াম, তাসের যাদুঘর। এক কথায় দেশ বিদেশের পর্যটকদের আনন্দ দেবার জন্য যা কিছু দরকার সবই আছে এই উগলিচে। এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম – ফেব্রুয়ারিতে শীত সাঁতার, মে মাসে যুবরাজ দ্মিত্রি দিবস, জুনে বাইসাইকেল ফেস্ট, আগস্টে আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফার দিবসে উগলিচ প্যারেড, নতুন ফসলের মেলা, কর্মী ঘোড়ার উৎসব। তাই সব মিলিয়ে উগলিচকে বলা যায় গির্জা, যাদুঘর আর উৎসবের শহর।
উগলিচ শহরে আমি প্রথম যাই ১৯৮৮ সালে। সে সময় আমাদের স্বল্পস্থায়ী ভ্রমণ ছিল মূলত কয়েকটি গির্জাকে ঘিরে। মনে আছে রক্তের উপর দ্মিত্রি গির্জার কথা যার সম্পর্কে আমরা আবার বলব। অন্যান্য অনেক প্রাচীন শহরের মত উগলিচ অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে যায়। স্মুতা বা অরাজকতার সময় উগলিচ পোলিশদের হাতে সর্বস্বান্ত হয়। ১৬১২ সালে পোলিশদের রাশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেবার পরে শুরু হয় রোমানভ বংশের রাজত্ব। রোমানভ বংশের প্রথম জার মিখাইল রোমানভ উগলিচ পুনর্নির্মাণে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এক ভাষ্য অনুযায়ী জারের মা এক্সেনিয়া শেস্তোভা উগলিচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পোলিশ ও লিথুনিয়ান হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেসব উগলিচবাসী প্রাণ দেন তাদের স্মৃতিতে ১৬২৮ সালে আলেক্সেয়েভস্কি মনাস্তিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় উস্পেনিয়া প্রেসভ্যাতোই বোগোরদিৎসি গির্জা। উল্লেখ করা যেতে পারে যে পিতৃভূমির জন্য আত্মদানকারী যোদ্ধাদের রাশিয়া সব সময়ই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সোভিয়েত আমলে প্রতিটি জনপদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের নাম খোঁদাই করা দেয়াল গড়া হত। বর্তমান রাশিয়াও বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত সেনাদের নাম চিরস্মরণীয় করার জন্য রাস্তার বা স্কুলের নামকরণ তাদের নামে করা হয়। আমাদের সব দেশে সেরকম কিছু করা হয় বলে জানা নেই।
তবে শুধু গির্জাই নয়, এখানকার মানুষ ইতিহাস, শিল্পকলা এসব বিষয়েও সচেতন ছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এখানে পুরাকীর্তির যাদুঘর, লাইব্রেরি, নাট্য সমাজ ইত্যাদি গড়ে ওঠে। এর পেছনে উগলিচের ব্যবসায়ীদের অবদান অনেক। তাঁরা শুধু এসব কাজে আর্থিক ভাবেই সাহায্য করেননি, এতে সক্রিয় অংশগ্রহণও করতেন। নাট্য সমাজের পেছনে আন্তন চেখভের ভাইয়ের অবদান অনেক। সে সময় সালতিকভ-শেদ্রিন, আলেক্সান্দর অস্ত্রভস্কি, ঝুকভস্কি, সুরিকভ, গ্রাবার, নিকোলাই রেরিখ সহ অনেক লেখক, আর্টিস্ট, শিল্পী, ইতিহাসবিদ উগলিচে আসেন। এমনকি নৌপথে আস্ত্রাখান ভ্রমণকালে আলেক্সান্দর ডুমা উগলিচে অবস্থান করেছিলেন।
উগলিচ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রাশিয়ার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫৫ সালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৯৪০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বিশেষ করে মস্কোর উপকণ্ঠে লড়াইয়ের সময় মস্কোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই শহরে আছে এক অনন্য মিউজিয়াম যা রাশিয়ায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিকাশের ইহিতাস বর্ণনা করে। আধুনিক প্রযুক্তি, সাউন্ড সিস্টেম, কম্পিউটার প্রোগ্রাম ও নিয়ন্ত্রিত মডেল ইত্যাদির সাহায্যে যাদুঘর আমাদের নিয়ে যায় রাশিয়ার বিভিন্ন কোণে। এগারটি হলে বিন্যস্ত এই যাদুঘরে উপস্থাপিত এক্সপোজিশন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ায় জলবিদ্যুতের ইতিহাস, এই পেশায় কর্মরত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও এতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জলের উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়। আমার মনে আছে সেখানে বর্তমানে রিজার্ভে থাকা দুবনার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নাম দেখে কী যে আনন্দ হয়েছিল। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল এখানে আসার আগে ভোলগার উপরে দুবনার বাঁধকে কখনই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বলে মনে হয়নি। আসলে দুবনার বাঁধের মূল কাজ হচ্ছে ভোলগা ও মস্কো নদীকে মিলিত করা। যুদ্ধের সময় এই কানাল দিয়েই ভোলগার জল যেত মস্কোয়, এটাই ছিল মস্কোর মত বিশাল এক শহরে সব ধরণের জল সরবরাহের একমাত্র পথ। তাই জার্মান বাহিনী অনেক চেষ্টা করেছে দুবনার বাঁধ গুঁড়িয়ে দিতে। বর্তমানে অবশ্য মস্কো আরও অনেক নদী থেকে জল সংগ্রহ করে। বাসে করে দুবনা থেকে আমরা যখন এখানে এসে নামলাম – প্রথমেই গেলাম এই বাঁধ দেখতে। আমার মনে পড়ে গেল ব্রাতস্কের কথা। সেটা ১৯৮৬ সাল। আমি সেবার গ্রীষ্মে গেছিলাম সাইবেরিয়ায় নির্মাণ দলে কাজ করতে। পথে ব্রাতস্কে রাত কাটাই, স্থানীয় স্টেডিয়ামে। বিকেলে যাই ব্রাতস্কের বিখ্যাত বাঁধের উপর হাঁটতে। যদি ভুল না করি সেসময় এটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
২০১৮ সালে আমরা যখন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মিউজিয়ামে এসে পৌঁছুই কোন কারণে যেন এক্সারশনে সময় পিছিয়ে যায়। এখন মনে পড়ে ভোলগার তীরের সেই রাস্তায় আলো আর ছায়ার লুকোচুরি খেলা। মিউজিয়ামে ঢোকার অপেক্ষায় আমরা সেই পথে এদিক সেদিক হাঁটছিলাম। যদি ভুল না করি অন্য একটা গ্রুপ তখন সেখানে ছিল। এসব জায়গায় নির্দিষ্ট পরিমানের বেশি লোক ঢোকা নিষেধ। তাই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল নদীর অন্য তীরে – বাঁধের উপর দিয়ে। একেই বলে শাপে বর, কেননা তা না হলে আমাদের আর ওপার নিয়ে যেত না। সেখান থেকে শহরটাকে একেবারে অন্য রকম লাগছিল। ঘাঁটে ভেড়া জাহাজগুলো আর তত বড় মনে হচ্ছিল না। জাহাজ থেকে যাত্রীরা নেমে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার মনে হল দেশীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর কথা। সেখানে লোকজন নামার আগেই চারিদিক থেকে লোক এসে ডাকতে শুরু করে। আর ভারতের তীর্থস্থান হলে তো কথাই নেই। পাণ্ডাদের অত্যাচারে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। এখানে সেরকম কিছু নেই। একটু ভালো করে ম্যাপ দেখে নিলেই ভালো আইডিয়া পাওয়া যায়। চাইলে গাইড নেয়া যায় যিনি শুধু শহর ঘুরিয়েই দেখাবেন না, বলবেন বিভিন্ন ইতিহাস। এসব ইতিহাসের অনেক কিছুই বইয়ে পাওয়া যায় না। এসব স্থানীয় লিজেন্ডা। আছে বিভিন্ন রকমের জায়গা যেখানে পর্যটকরা ছবি তুলতে পছন্দ করে। এখনও মনে পড়ে উগলিচের বিভিন্ন স্যুভেনির ঝোলানো বৃত্তাকার ফ্রেমে অনেকের ছবি তুলে দেবার কথা। আর আছে স্যুভেনিরের দোকান। সবাই চায় নিজের আগমনটা কোন না কোন ভাবে স্মরণীয় করে রাখতে। কেনে স্থানীয় স্যুভেনির। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আমাদের সাথে ছিল স্থানীয় গাইড। এখানে, ক্রেমলিনের পাশে আমাদের সাথে যোগ দিলেন অন্য গাইড। তিনি আমাদের নিয়ে চললেন বিভিন্ন গির্জা দেখাতে।
উগলিচের উপর ছবি পাওয়া যাবে এখানে
http://bijansaha.ru/album.php?tag=180
0 Comments