জ্বলদর্চি

বলাগড়ের রোদ- বৃষ্টির -খাতা দ্বিতীয় পর্ব /অয়ন মুখোপাধ্যায়

বলাগড়ের রোদ- বৃষ্টির -খাতা  
দ্বিতীয় পর্ব

অয়ন মুখোপাধ্যায়

শিউলি রঙের দেবী

পাটুলি গ্রামের আমবাগানে বসে বসে আজও মনে হয়—এই গ্রামটা এক রহস্যের খোলস।  পাটুলি। ছোট্ট গ্রাম। অথচ এখানে মাটি খুঁড়লেই ভেসে ওঠে ডুবে যাওয়া কালের ফিসফিসানি। ভাঙা নৌকার কাঠ, মাটির ভেতর ঘুমিয়ে থাকা জাহাজের হাল। মনে হয়, এই ভূমি একসময় ছিল বিস্তীর্ণ জলসভ্যতার প্রান্তর। আজ নদী নেমেছে সরে গিয়ে, কেবল শান্ত নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে গ্রাম।

আমি বসে থাকি বাগানে। মুঠোয় একটা শিউলি ফুল, কাণ্ড থেকে ভেজা গন্ধ বেরোচ্ছে। হঠাৎ যেন চেতনা ভেসে গেল পাঁচশো বছর আগে। আমার পাশে এসে দাঁড়াল ওই গ্রামেরই ছেলে হরিদাস। খালি গা, বুকের হাড় দেখা যাচ্ছে। চোখে অদ্ভুত দীপ্তি।

সে ফিসফিস করে বলতে লাগল।


“রাঘব দাদু একবার পূজার রাতে আমায় ডেকেছিলেন। বললেন—
—‘হরিদাস, তুই জানিস, এই গ্রামে একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধ্যান করত। তারা পূজা করত এক অদ্ভুত দেবীকে। সেই দেবী-ই পরে আমাদের মঠবাড়ির মা হয়ে ওঠেন।’

আমি হতবাক। দূরে মঠবাড়ির দিক থেকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ, গাছের ছায়া দুলছে। সন্ধ্যে নামব নামব মনে হচ্ছিল। তখনকার সেই মুহূর্তটা কেবল মানুষের ছিল না, অন্য এক অস্তিত্বেরও।”

হরিদাস থামল একটু। তার চোখে তখনও সেই সময়ের ছায়া খেলা করছে।
🍂


“সেই যে বছর গ্রামে এলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বয়সে তরুণ, অথচ চোখদুটি যেন গভীর কুয়োর মতো। চারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করলেন—
—‘আজ থেকে দ্বিভুজা দুর্গার পূজা শুরু হবে। স্বপ্নাদেশ পেয়েছি। মা বলেছেন—আমায় জাগাও। আমি শক্তির রূপ।’

গ্রাম জোড়া কানাকানি।
এক মহিলা ভয়ভরা গলায় বলল—
—‘কিন্তু মা যদি দশভুজা না হয়ে কেবল দুই হাতে আসেন? এও কি হয়?’

মদনমোহন মৃদু হেসে উত্তর দিলেন—
—‘দৃশ্যমান দুই হাতই তাঁর দয়া। বাকি আট হাত অদৃশ্য শক্তি। মানুষের চোখে দেখা যায় না, কিন্তু আছেই। ভয় পেয়ো না, মা আমাদের রক্ষা করবেন।’

সেই নিশুতি রাতে আমি শুনেছিলাম অদৃশ্য কণ্ঠের গুঞ্জন—যেন গোটা গ্রাম নিঃশ্বাস নিচ্ছে মায়ের নাম ধরে।”


মৃৎশিল্পী গোপাল তখন উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে। হাত ভিজে কাদা মাখা। তার কণ্ঠ কাঁপছিল—
—“যত দুর্গা গড়েছি, কেউ তো এমন নয়। এই প্রথম আমাকে দ্বিভুজা দুর্গা গড়তে হবে। আমি কি পারব?”

মদনমোহন শান্ত, প্রায় তন্দ্রার মতো স্বরে বললেন—
—“এই রূপই তাঁর সত্যরূপ। তুমি প্রতিমা গড়ো। তোমার হাত দিয়েই মায়ের প্রকাশ হবে।”

গোপাল মাটির দলা কপালে ঠেকাল। তার চোখে জল ভরে উঠল।
—“হাজার বছর গড়লেও যদি এ প্রতিমা না গড়ি, তবে শান্তি পাব না।”

পরে বোঝা গেল, পাটুলির পালবাড়ির পালেরা কেবল মৃৎশিল্পী নন, তাঁরা যেন দেবীর হাতের যন্ত্র। প্রতিমা গড়া শেষ হতে শুরু হলো ষষ্ঠীর বোধন।


রাত্রি তখন গভীরতর। সপ্তমীর পূজার সময়। মঠবাড়ির মন্দিরে দরজা বন্ধ। ভিতরে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন মদনমোহন। বাইরে গ্রামবাসী ভিড় করে দাঁড়িয়ে।

কারও ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। ফিসফিস—নরবলি হবে।
এক বৃদ্ধা কাঁপা গলায় বলল—
—“মানুষের রক্ত দেবীর পায়ে?”

মদনমোহনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল ভেতর থেকে—
—“ভয় পেয়ো না।”

কিন্তু তবু ভয় কাটল না। ঢাকের আওয়াজ ক্রমে গর্জনে বদলে গেল। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো চিৎকার।

ভোরে দরজা খুলল। ভিতরে কোনো রক্ত নেই। কেবল প্রতিমার চোখ জ্বলজ্বল করছে।

সেই আলোয় এক বাউল গাইতে শুরু করল—
“যে দেবী দুই হাতে প্রকাশ,
আট হাতে লুকায় ভয়—
তাঁর পায়ের তলায় মানুষ পড়ে,
মানুষ হারায় ক্ষয়।”

গ্রাম যেন এক মন্ত্রে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।


কয়েক বছর পর চট্টোপাধ্যায় বংশের একজন উঠোনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন—
—“আর কোনো নরবলি নয়। এমনকি পশুবলি-ও নয়। মা ভয় নন, মা শক্তি। মা ভক্তি চান।”

জনতার কণ্ঠস্বর একসঙ্গে উঠল—
—“জয় মা মঠের মা!”

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো কুলবধূ উমা তখন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—
—“মা, তুমি ভয় নও, তুমি মাতৃত্ব। আমি আমার শিশুর মুখেই তোমায় দেখি।”

সেই মুহূর্তে মাতৃত্ব যেন পূজার মন্ত্র হয়ে উঠল।


সময় কেটে গেল। জমিদারি এল, শরিকবাড়ি উঠল। কিন্তু পূজার রূপ বদলাল না। প্রতিমার রঙ আজও শিউলি ফুলের মতো সাদা-কমলা, চোখ বাঁশপাতার মতো চিকন, আর পৌরাণিক সিংহের মুখ আজও ঘোড়ার মতো লম্বা।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জেনে গেল—মা কেবল দেবী নন, তিনি গ্রামের আত্মা।


হরিদাস নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই হলো পাটুলির ইতিহাস।”

আমি চমকে উঠলাম। চারপাশে কেবল পাতা পড়ার শব্দ। কিন্তু তার গল্প শেষ হতেই যেন আমার চোখে ভেসে উঠল আজকের পাটুলি।

মনে মনে বললাম—
—“এই পূজা উৎসব নয়, ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। দেবী দ্বিভুজা, তুমি মানুষের রহস্য। সামনের দুই হাত দৃশ্যমান, পেছনের আট হাত অদৃশ্য—প্রকাশ ও অপ্রকাশ।”

রাত গভীর হতে থাকল। আবার শোনা গেল ঢাকের আওয়াজ। প্রতিমা যেন চোখ মেলে তাকাল। আমি কানে পেলাম এক কণ্ঠস্বর—
—“ভয় পেয়ো না। আমি তোমাদের মা। আমি বৌদ্ধেরও, আমি হিন্দুরও, আমি এই গ্রামের আত্মা।”


অষ্টমীর সন্ধ্যায় বাউল গেয়ে উঠল—
“শিউলি রঙের দেবী,
তুমি গোপন হাতের আলো,
তুমি ভয়ের ছায়া পেরিয়ে
ভক্তির পথের ভালো।”

ঢাক বাজতে লাগল, উলুধ্বনি উঠল, গ্রাম জেগে উঠল।
সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল—
—“জয় শিউলি রঙের দেবী! জয় মঠের মা!”

আকাশে তখন শিউলি ফুল ঝরে পড়ছে, যেন দেবী নিজেই আশীর্বাদ দিচ্ছেন।

এভাবেই  পাটুলি গ্রাম আজও বয়ে বেড়ায় শিউলি রঙের দেবীর কাহিনি। ইতিহাস, লোককথা আর ভক্তি মিলেমিশে এখানে এক হয়ে যায়।

ক্রমশ.......

Post a Comment

0 Comments