জ্বলদর্চি

ইঁদ পরব /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮২
ইঁদ পরব

সূর্যকান্ত মাহাতো

একসময় জঙ্গলমহলের রাজাদের হাত ধরেই 'ইন্দ্রধ্বজ' উত্তোলিত হত এবং 'ইঁদ' পরবটি সম্পন্ন হত।  এখন আর সেই রাজাও নেই এবং তাদের রাজত্ব নেই। কিন্তু 'ইঁদ' পরবটি এখনো উজ্জ্বল রকমভাবে প্রচলিত হয়ে চলেছে। আগের সেই জৌলুস হয়তো এখন কিছুটা কালের নিয়মেই কমেছে কিন্তু একেবারেই ভাটা পড়ে যায়নি। রাজা রাজপোশাকে সুসজ্জিত হয়ে 'ইঁদকুড়ির মাঠে' গিয়ে 'ইঁদ' কাঠকে উদ্দেশ্য করে হয়তো আর বলবে না, "হে বৃক্ষরাজ তোমাকে নমস্কার করি, ইন্দ্রধ্বজের জন্য আমি তোমার পূজা করছি, তুমি এ স্থান ছেড়ে ধ্বজার্চনার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে উপনীত হও।"(সীমান্তবাংলার লোকযান/ সুধীর কুমার করণ, পৃষ্ঠা- ১৩৫) কিন্তু রাজা না থাকলেও প্রজাদের কন্ঠ নিঃসৃত গান আর ধমসা মাদলের ধিতাং ধিতাং সুর আছে। সারারাত্রি ধরে চলে সেই সঙ্গীতানুষ্ঠান। যেমন ঝাড়গ্রামের উৎসবে উপস্থিত লোকেরা গেয়ে চলে---

"যখন উঠে ইঁদটি
তখন ভাঙে নিঁদটি
ঝাড়গাঁর গড়ে
ঠমকি ঠমকি হাতি চলে
ঝাড়গাঁর গড়ে।"

জঙ্গলমহলে প্রচলিত তার নিজস্ব কতকগুলি উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'ইন্দ্রধ্বজ উৎসব'। অনার্য উৎসবগুলোর মধ্যে যে কয়েকটি হিন্দু শাস্ত্রের ছাড়পত্র পেয়েছে 'ইন্দ্রধ্বজ উৎসবকে' তাদের মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করেছেন সুধীর কুমার করণ। (সীমান্ত বাংলার লোকযান, পৃষ্ঠা- ৯)

ঠিক কোন সময় এই উৎসব পালিত হয়? এই উৎসবের সময়কালটা যদি দেখা যায় সেটাও বেশ তাৎপর্যময়। নাচে গানে মুখরিত 'করম' একাদশীর ঠিক পরের দিন অর্থাৎ দ্বাদশীর দিনই পালিত হয় এই উৎসব। কিন্তু কেন এই তিথি বা দিনটিকেই বেছে নেওয়া হল সে বিষয়ে আচার্য 'যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি' তার 'পূজাপার্বণ' গ্রন্থে একটি কারনের কথা উল্লেখ করেছেন। এক সময় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল নবমী থেকে ঠিক তিন মাস তিন তিথি পরে ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীতে রবির দক্ষিণায়নের সূচনা ঘটেছিল। ঐ তিথির নাম ছিল 'বামন দ্বাদশী'। ঐ দিন তাই ভারতের কোন কোন দেশীয় রাজ্যে 'ইন্দ্রধ্বজ রোপণ' উৎসব পালিত হত। সেদিন রাজারা প্রজাবর্গ সহ একটি বড় 'ধ্বজ' রোপন করে তার উপর একটি পতাকা বেঁধে দিত। কারণ এরপর কবে থেকে রবির দক্ষিণায়ন শুরু হবে সেটা ধ্বজের ছায়া দেখে বোঝা যেত এবং বায়ু প্রবাহের গতিপ্রকৃতি ওই পতাকা দিয়ে নির্ধারণ করা হত।(পূজাপার্বণ/যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, পৃষ্ঠা- ৬৮)

'বিনয় ঘোষ' এই উৎসবকে বহুকালের প্রাচীন উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২২) কিন্তু কতটা প্রাচীন? 'নীহাররঞ্জন রায়' এ বিষয়ে বলেছেন, প্রাচীনতার দিক দিয়ে এই উৎসব একাদশ শতাব্দীরও আগের বলে উল্লেখ করেছেন। এবং তার প্রমান হিসেবে তিনি 'গোবর্ধন আচার্যের' নাম ও তার লেখা 'আর্য- সপ্তশতীর' কথা উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, জীমুতবাহনের 'কালবিবেক' গ্রন্থের কথাও এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন। যেখানে 'শত্রুধ্বজ' পূজার কথা উল্লেখ আছে। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব, পৃষ্ঠা- ৬১৩)

জঙ্গলমহলে এই উৎসব মূলত রাজাদের হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল। তরুনদেব ভট্টাচার্য বলেছেন "'করম' ও 'জাওয়া' জনতার উৎসব, ইঁদ পরবের পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং রাজা।" (পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা- ২৫৭) কেন রাজাদের হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল তার পিছনে দুটো কারণের কথা জানা যায়। একটি পৌরাণিক এবং অন্যটি অপৌরাণিক। পৌরাণিক কাহিনীটি হল, দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের সঙ্গে পরাজিত হলে তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্মরণাপন্ন হন। তারা তখন ইন্দ্রকে 'মাল্যছত্র-ঘন্টাদিযুক্ত, শরৎসূর্যপ্রতিম দেদীপ্যমান' এক দিব্য 'ধ্বজ' দান করেন। সেই দিয়ে 'ইন্দ্র' জয় লাভ করেন। 'ইন্দ্র' আবার সেই বেণুময় 'ধ্বজ' চেদীপতিকে দান করেন এবং তার 'ধ্বজ' পূজায় সন্তুষ্টি হয়ে বলেন, "যে রাজা এরকম 'ধ্বজ' পূজা করবে তার ধনবল শস্যবৃদ্ধি হবে এবং সর্বকার্যে সে সিদ্ধিলাভ করবে।" (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি,২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪) আবার 'দেবীপুরান' মতে, বিষ্ণু ব্রহ্মার সাহায্যে শিবের কাছ থেকে প্রথম 'কেতু' লাভ করেছিলেন। এরপর 'ইন্দ্র' সেই 'কেতু' বিষ্ণুর কাছ থেকে লাভ করেন। 'ইন্দ্র' আবার সেটি দান করেন চন্দ্রকে। চন্দ্র সেটি দান করেন দক্ষকে। দক্ষরাজ সেটি গ্রহণ করার পর থেকেই সব রাজারা সেই 'কেতু' বা 'ইন্দ্রধ্বজ' উত্তোলিত করেন।(সীমান্তবাংলার লোকযান/সুধীর কুমার করণ, পৃষ্ঠা- ১৩৪) 
'জন আরউইন'(John Irwin) আবার এই কিংবদন্তিকে বর্ণনা করেছেন একটু অন্যভাবে, ইন্দ্র বহনযোগ্য খুঁটি বা স্তম্ভটিকে 'যষ্টি'(Yashti)-র আকারে প্রথম স্থলজ রাজা, 'রাজা বসুকে'(King Vasu) দিয়েছিলেন এবং নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি এবং পরবর্তী পার্থিব রাজারা বার্ষিক এর পূজা করবেন। এই আচার যে ঋকবৈদিক যুগেও প্রচলিত ছিল সেকথাও উনি উল্লেখ করেন। এবং বলেন যে, ভারতীয় আচার ঐতিহ্যের সংরক্ষণের একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল 'ইন্দ্র উৎসব' বা 'ইন্দ্র মহোৎসব', যা বর্তমান দিন পর্যন্ত শাসকের দ্বারাই প্রণীত হয়ে আসছে।(John Irwin: 'Asokan' pillars, part IV Symbolism: Burlington Magazine, vol. CXVIII, November 1976)
🍂

এই পৌরাণিক কাহিনীগুলো থেকেই কি তবে পরবর্তীকালে রাজারা 'ইন্দ্রধ্বজ' পূজার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন? আমার তা মনে হয় না। বরং দ্বিতীয় যুক্তিটি বেশি গ্রহণযোগ্য। এই  যুক্তিটি হল, 'ধ্বজ উৎসব' আসলে রাজাদের একরকম 'বিজয় উৎসব'। 'বিজয় উৎসব' কেন? কারণ আর্যরা যখন অনার্যদের পরাজিত করে 'রাজা' হয়েছেন তখনই তারা এই বিজয় উৎসবের রীতি প্রচলন করেছেন। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪) কিন্তু এভাবে কেন বিজয় উৎসব? আসলে আগে থেকে অনার্যরা বড় বড় গাছ বা বৃক্ষ পূজা এমনিতেই করে থাকেন। সেই দেখে বিনয় ঘোষও প্রশ্ন তুলেছেন, "তবে কি ঐ পূজাকেই রাজারা একটা রাজকীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে 'ধ্বজ উৎসবে' পরিণত করেছেন?"  শাল বৃক্ষকে 'ইন্দ্রধ্বজ' বানিয়ে রাজকীয় প্রতীক সহ রাজ-অভিষেকের উৎসব হিসাবে যেভাবে 'ইন্দ্রধ্বজের উৎসব' নামকরণ হয়েছে তাতে সেটাই বড় বেশি করে প্রমাণিত হয়।

জঙ্গলমহলে এই উৎসব প্রচলিত হওয়ার পিছনে তাই ঐ দ্বিতীয় কারণটিই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। কারণ আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলেও রাজ সিংহাসন দখল করে রাজা হওয়া এবং তারই বিজয় উৎসব হিসাবে 'ইন্দ্রধ্বজ উৎসবের' প্রচলন ঘটান রাজারা। বিনয় ঘোষও সেটাই মনে করেন। তিনি বলেন, এই উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রাচীন ইতিহাসের এক অবলুপ্ত সংঘাত পর্বের পরিচয় পাওয়া যায়।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা- ২৪) এই 'ইঁদ' পরবকে তরুনদেব ভট্টাচার্যও স্থানীয় রাজার আধিপত্য ও প্রভুত্ব ঘোষণার উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন।(পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা-২৫৭)

লেখক সুধীর কুমার করণ 'ইঁদ' এবং 'ছাতা পরবকে' এক বলেই উল্লেখ করেছেন। (সীমান্তবাংলার লোকযান, পৃষ্ঠা- ১৩১) তবে 'ছাতা পরব' পুরুলিয়া সহ বেশ কিছু জায়গায় ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীর দিন নয়, বরং ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও আবার দ্বাদশীর দিনেও হয়।

'ত্রৈলোক‍্যনাথ পাল' তার 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে 'ধারেন্দা' গ্রামে পাল জমিদারদের 'ইন্দ্রপূজা' সম্পর্কে যে বর্ণনা করেছেন সেখান থেকে জানতে পারি যে, এই গ্রামেও ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীতে 'ইঁদকুড়ির' মাঠে একটি লম্বা শালগাছের চূড়ায় 'ছাতা' বেঁধে তার উপর খৈ ও দই ছড়িয়ে উৎসব পালন করা হয়। পুজো শেষে চলে সারারাত ধরে সাঁওতাল নাচ।

সুধীর কুমার করণ 'ইঁদপূজা' সম্পর্কে বলেছেন, দ্বাদশীর বিকেলে পূজা হয়। দুটি বড় শাল গাছকে কেটে এনে 'ইঁদতলায়' পোঁতা হয়। দুটি শাল কাঠেই কাপড় জড়িয়ে তাদের মাথায় ছাতা বেঁধে দেওয়া হয়। এবার রাজা বা রাজপ্রতিনিধি ঐ শাল দন্ড উত্তোলন করেন। কাজটি আসলে জনসাধারণই করে, রাজা কেবল নিয়ম মতো দড়ি ধরে থাকেন। এরপর পূজার্চনা শুরু হয়। অনেক ইঁদতলায় যে পাঁঠা বলিও হয় সে কথাও তিনি বলেছেন।(সীমান্তবাংলার লোকযান, পৃষ্ঠা- ১৩৩)

কিন্তু 'শাল' গাছই কেন? অন্য গাছ কি ব্যবহার করা যায় না?

সুধীরবাবু এই 'কেতু উত্থাপন বিধি' প্রসঙ্গে পাঁচটি বৃক্ষের কথা বলেছেন, 'ধর', 'অর্জুন', 'প্রিয়ক', 'উড়ুম্বুর', এবং 'অশ্বকর্ণ'। কিন্তু এই পাঁচটি গাছ পাওয়া না গেলে তখন চন্দন, তাম্র, শাল অথবা সেগুন গাছকে 'ইন্দ্রকেতু' করা যায়। তবে আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হয় 'স্ত্রী-নামা' যে কোন বৃক্ষই কিন্তু নিষিদ্ধ। আবার এদের মধ্যে যে গাছটি নেওয়া হবে সেটি যেন 'সুলক্ষন যুক্ত ও সর্বাঙ্গ সুন্দর' হয়। কোনরকম "লতাবন্ধ, কৃমিব্যাপ্ত, পাক্ষিণীযুক্ত, বল্মীকাবৃত, শ্মশানসম্ভূত, কোটরযুক্ত, বিদ্যুদাহত, বজ্রাহত বা অগ্নিদগ্ধ না হয়।(সীমান্ত বাংলার লোক যান, পৃষ্ঠা- ১৩৪)

'ইঁদপরব' জঙ্গলমহলের যেখানে যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর যেখানেই হোক না কেন, সর্বত্রই প্রায় একই রকমের। জনসাধারণও বেশ উৎসাহ নিয়ে উৎসবে যোগদান করেন।

তথ্যসূত্র: ১) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খন্ড/ বিনয় ঘোষ
২) সীমান্তবাঙলার লোকযান/ সুধীর কুমার করণ
৩) বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব/নীহাররঞ্জন রায়
৪) পুরুলিয়া/ তরুনদেব ভট্টাচার্য

Post a Comment

0 Comments