জ্বলদর্চি

দেশপ্রেমের বালাই /কুহেলী ব্যানার্জী

দেশপ্রেমের বালাই 
কুহেলী ব্যানার্জী

রবিন বাবুর সরকারি চাকরি ১৭-১৮ বছরের বেশি হয়ে গেল কিন্তু এমনতর বিচিত্র অভিজ্ঞতা  তাঁর এর আগে কখনো হয়নি।  ট্রান্সফারের চাকরি তাঁর। সবে ছমাস হলো হাতিপোতায় এসেছেন। ফ্যামিলি থাকে বাড়িতে, ছেলেদের পড়াশোনার সুবিধার্থে।  সপ্তাহান্তে তিনি সেখানে যান।  
           
         বর্তমানে হাতিপোতার ছোট্ট কোয়াটারটিতে দু-কামরার মাঝারি মাপের ঘর,রান্নাঘর,ছোট্ট ব্যালকনি নিয়ে তাঁর নিজস্ব সংসার। আর আছে শানবাঁধানো একখানি উঠোন। যার একপাশে কলতলা আর অন্যপাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে বাগান।  এর মধ্যেই তিনি সময়ে-অসময়ে সেখানে নানা সবজিও লাগিয়েছেন । টগর আর গন্ধরাজের দুটো ফুল গাছ আছে।  একসময় কেউ  লাগিয়েছিল, তাতে বেশ থোকা থোকা ফুল ধরেছে।  সারা বাগানময় তার সুবাস।  রাস্তার ওপাশে চালতা-নিম গাছের ডালে সকাল হলেই পাখিরা কিচিরমিচির করতে থাকে।  ছোট্ট বারান্দায় বেতের চেয়ারখানি পেতে তিনি সকাল-বিকেল  চা খান  আর পেপার পড়েন। বর্ষার মেঘ দেখে নিজের মনেই কখনো আবার গুনগুন করে গান জোড়েন। এভাবেই অবসরযাপন  করেন তিনি। 
🍂

            সেদিক থেকে দেখতে গেলে একপ্রকার নির্ঝঞ্ঝাট  জীবন তাঁর।  জানেন কদিন পর আবার পাততাড়ি গোটাতে হবে সেই কারনে লোকজনের সাথে খুব একটা মেলামেশা করেন না। আসলে মোহ বাড়াতে চান না।  নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সারাদিন।  দিনের অধিকাংশ সময় অবশ্য অফিসেই কেটে যায়। তাই তাঁর বিশেষ অসুবিধেও হয় না। হাতিপোতায় এসে তিনি রান্না-বান্নার কোন ঝামেলায় যাননি।  এবেলা-ওবেলা হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।

           দুদিন পর স্বাধীনতা দিবস। সেই উপলক্ষে পাড়ার ক্লাবের  কিছু ছেলে এসে তাঁকে  নিমন্ত্রণপত্র দিয়ে গেছে। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান মতো হবে। কোয়াটারগুলোর পাশেই পাড়াটা। বাউন্ডারি ওয়ালটা  ভেঙে গিয়ে  পাড়াটা কোয়াটারগুলোর সাথে  প্রায় মিশে যেতে বসেছে। দুর্গা মন্দিরের গা ঘেঁষে ক্লাব। তার সামনে খোলা মাঠ। বিকেলে বাচ্চারা সেখানে খেলাধুলো করে। অফিস থেকে ফিরবার পথে কিছু সময়ের জন্য সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। তাদের খেলা দেখেন।

          ভোর-রাত্রে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তবু আকাশটা তখনও মেঘলা হয়েই আছে। যে কোন সময় আবার বৃষ্টি নামতে পারে। পথে যেখানে-সেখানে জল দাঁড়িয়ে রয়েছে। রবিনবাবু সকাল সকাল তাঁর সাদা রঙের পাজামা-পাঞ্জাবিটি পরে ক্লাবে হাজির হলেন। পতাকা উত্তোলন হলো । পাড়ার কিছু মান্যিগুণ্যি ব্যক্তি বক্তৃতা রাখলেন। ছোট ছোট বাচ্চারা নানারকম অনুষ্ঠান করলো। তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে বেশ কিছু কথা বললেন ।

         প্রত্যেক বছর এই দিনটা এলেই তাঁর দেশপ্রেমটা যেন আরও বেড়ে ওঠে ।  সেই সাথে একরাশ স্মৃতিরা ভিড় করে।  স্কুলজীবনের নানা কথা মনে আসে।  ইতিহাসের স্যার কালিপদবাবু এই দিনটায় তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদুর গল্প বলে শোনাতেন। সে এক ভারিক্কি গলা ছিল তাঁর। বলার সময় তাঁর উত্তেজনার পারদ যত বাড়তো স্বরও চড়তো উচ্চগ্রামে।  গোটা স্কুল চত্বরটা গমগম করত সে সময়। টিচার এবং স্টুডেন্ট সকলে মিলে দেশাত্ববোধক গান গাইতেন। মিতা খুব ভাল আবৃত্তি করত। রবিনবাবুর স্কুল জীবনের সেই ছিল প্রথম ভালো লাগা। সেই ভালোলাগার  মানুষটিই আজ তার জীবনসঙ্গী। অথচ তার সাথে সময় কাটানোর সুযোগটুকুও পান না। মিতার মনের নাগাল আজকাল আর পান না তিনি। ছুটির দিনগুলোও তাই বড় পানসে লাগে। মনের মাঝে কি যেন এক অসীম শুন্যতা বিরাজ করে।
           কোয়াটারে ফিরে তিনি স্নানে গেলেন। চারদিক থেকে দেশ মাতৃকাবন্দনা হেতু বিভিন্ন সংগীত  ভেসে আসতে থাকলো। তাদের পাড়ার মাইকেও কিছুক্ষণ পর থেকে গান শোনা যেতে থাকলো।

   //''এ মেরে বতন কে লোগো যারা আঁখমে ভরলো পানি''..... //
//  ''সন্দেশে আতে হে , হামে তড়পাতে হে ''.....//

       কিন্তু একি মহা ফ্যাসাদ রে বাবা এক ঘন্টা পর থেকে পুরো ভোল পাল্টে গেল !  'কবুতর যা যা'..... থেকে শুরু করে  'গোল প্রিন্টের শাড়ি পড়ে'...... বাজতে থাকলো।  রবিনবাবু পুরো হাঁ হয়ে গেলেন। ঘরের পাশেই ক্লাবটা। তাই খুব জোরেই তার ঘরে আওয়াজ আসছে। এদিকে সকালে   শুরু হয়েছিল ......
 ''উঠো গো ভারত লক্ষ্মী''   দিয়ে।
      তখন দেশপ্রেমী রবিনবাবু খুশি হয়ে ক্লাবের বিষয়ে নানা  প্রশংসা সূচক মন্তব্য করে এসেছেন। এরপর বেলা বাড়লে যে এমন দশা হবে তখন তিনি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি। এখন সোয়া দুটো। একনাগাড়ে বেজে চলেছে নানা রকমের রঙচঙে গান। কিন্তু সে গান বন্ধ হওয়া  কিংবা আওয়াজ কমের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না । কানে প্রায় তালা লাগার জোগাড়। মনে হচ্ছিল থানায় একটা ফোন করেন। কিন্তু নিতান্ত ছাপোষা বাঙালির মতো তিনিও ঝামেলা এড়িয়ে চলতেই ভালবাসেন। নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল তাঁর।  কি কুক্ষণে যে এতো প্রশংসা করতে গেলেন ! সাধারনত তিনি এমন কাজ করেন না। এ তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধই বলা যেতে পারে। আসলে এতো বয়স হয়ে গেলেও দেশপ্রেমের উত্তেজনাটা তাঁর মধ্যে কাজ করছিল সে সময়। যাইহোক কি আর করা যাবে মনকে বোঝালেন। 

          সপ্তাহে সপ্তাহে  তিনি বাড়ি যান। সেখানে  নানান সাংসারিক কাজকর্ম থাকে।  বিশ্রাম নেওয়ার তেমন সুযোগ পান না। আজ ছুটির দিন ছিল। ভেবেছিলেন দুপুরে বেশ জম্পেশ করে ভাত-ঘুমটা দেবেন। কিন্তু ছুটির দিনটা যে এভাবে হঠাৎ করে মাঠে মারা যাবে ভাবতে পারেন নি ।  
            সবে  খেয়েদেয়ে একটু তন্দ্রা মতো এসছিল ।  আচমকা বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। শুনতে পেলেন........
   ''বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম'' ......                         
  গানটা ডিজে মিউজিকের সাথে বাজছে। ঘাবড়ে গেলেন।   ভাবলেন, এটাতে আবার এমন বুক ধড়ফড়ানি  মিউজিক কবে জুড়লো রে বাবা ! 
      
       পর পর গান বাজতে থাকলো। ডিজের ঢিপ ঢিপ আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে কোয়াটারের দরজা-জানলাগুলোও কাঁপতে লাগলো। কিছুক্ষন পর মাথাটা তাঁর কেমন টিপটিপ করতে লাগলো। আর থাকতে পারলেন না।  কোনমতে চোখে-মুখে  জল দিয়ে  বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ছোট মফস্বল শহরটার পাশেই একটা বড় জলাশয় আছে তার ধারেই কিছুটা সময় কাটিয়ে আসবেন বলে মনস্থির করলেন। 
        দূর থেকে  ঢিপ ঢিপ মিউজিকটার সাথে তখনও ভেসে আস্তে থাকল.......
    ‘যমুনা…………… ও নীল যমুনা….।



Post a Comment

0 Comments