জ্বলদর্চি

গোরস্থান /রাকিবুল হাসান বিশ্বাস

গোরস্থান
রাকিবুল হাসান বিশ্বাস


মারা গিয়েছিল, যার কাছে সজ্ঞানে প্রথম পড়তে গিয়েছিলাম, যিনি একটানা দশ বছর আমাদের পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন— তাঁরই মা। বয়স হয়েছিল। বেশিদিন ভুগলেন না, ভোগালেনও না! হঠাৎ এক দুপুরে নীরবে চলে গেলেন। আত্মীয়স্বজন কম নয়। তাই মাটির খবর হওয়ার আগেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। মগরিবের নামাজ পড়ার পর মাটি হবে, মসজিদের মাইকে শুনলাম আজানের পরই। 

মৃত্যু! এ এক অলৌকিক শব্দ। এক অলৌকিক কর্ম। কিন্তু যখন আসে, চারিপাশেই দেখি—আজন্ম দেখছি, আব্বা-রও দেখেছি— মনে হয় সাধারণ, অতি সাধারণ একটি শব্দ! সাধারণ কর্ম, চিরাচরিত— "জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে।" কেউ ফিরে আসেনি, কেউ আর ফিরে আসে না। সংসারের সাথে চিরবিচ্ছেদ ঘটে যায়। মানুষ শোকাচ্ছন্ন হয়। স্বপ্নে দেখে। ধীরে ধীরে স্বপ্নে দেখা কমে যায়! তারপর একদিন ভুলে যায়। তারপর রূপকথার নায়ক-নায়িকার মতো কখনও কোনও-কোনও সময় কথা-প্রসঙ্গে নাম ওঠে, গল্প হয়ে যায় সব! 

পরপারের খোঁজও কেউ জানে না। কেউ যে ফিরে আসেনি সে দেশ থেকে! হয়তো তারাও ভুলে গেছে সব আমাদেরই মতো। তারা তো এখন তাদের কৃতকর্মের হিসাব দিতেই ব্যস্ত। 'আমাদের কথা' স্মরণ করার এক মুহূর্ত সময় তাদের কই! গতকাল সে কোথায় ছিল, আর আজ!
🍂
জানাজার নামাজের সময় হয়ে এল। সরকারের কংক্রিটের রাস্তা পেরিয়েই পড়ে গেলাম ঘুটঘুটে অন্ধকারে। তারপর বিরাট ফুটবল ময়দান। জেনারেটরে চলা হ্যালোজেনের আলো চারিদিকে যেন অন্ধকারের সাথে ঠেলাঠেলি বাধিয়েছে। চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। সেই আলোয় সাইকেলের চাকার দাগগুলো স্পষ্ট। শিশিরভাঙা চাকার দাগ সব। এগিয়ে গেলাম। জানাজা নামাজ শেষে লাইন দিতে হয়। আবশ্যক নয়, তবে শৃঙ্খলা থাকে; কাজ সরে দ্রুত। ভিনগাঁয়ের আত্মীয়দের এগিয়ে দিই। 

মুর্দা এগিয়ে আসে চার কাঁধে। খাটিয়াটা অ্যালুমিনিয়ামের। তাতে মৃতদেহ বহন করতে সুবিধে। খাটিয়া থেকে নামিয়ে মুর্দাকে উত্তর-দক্ষিণে খোঁড়া লম্বা কবরে শোয়ানো হয়। তিনজন কবরে নেমে গিয়ে মুর্দাকে ধরে কবরের অন্তরালে শুইয়ে দেয়। তারপর গোলাপজলে আতর মিশিয়ে সাদা কাফন জড়ানো মুর্দার ওপর ছেটানো হয়। কাফনের বাঁধন আলগা করে মুর্দার মাথা পশ্চিমমুখী করা হয়। দু'জন উঠে আসে। তারপর মাপ করে কাটা বাঁশের ছড়িগুলো একে একে মুর্দাকে ঢেকে দেয়। দুনিয়াবি আলো রুদ্ধ হয়। তারপর মাপ করে কাটা ছেঁচা বাঁশ দিয়ে আবার কবরের মুখ ভালো করে বদ্ধ করা হয়। তারপর— "মিনহা খালাকনাকুম, ওয়া ফিহা নুঈদুকুম, ওয়ামিনহা নুখরিজুকুম তা রাতান উখরা" (অর্থ— আমি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, আর মাটিতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনব এবং পুনরায় তোমাদেরকে মাটি থেকে বের করব: সূরা তাহা, ৫৫নং আয়াত) বলতে বলতে প্রতিটি মানুষ তিনবার মাটি দিয়ে ফিরে আসে।

অবশিষ্ট বাঁশ ও আবর্জনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তার ধোঁয়া আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে-পাকিয়ে মিশে যাচ্ছিল। হ্যালোজেনের আলো আর অন্ধকার গলাগলি করে চোখ ধাঁধানো খেলা খেলছিল। অপরূপ রোমাঞ্চকর সান্ধ্যকালীন সে দৃশ্য দেখতে-দেখতে কখন যে লাইন শুরু হয়ে এগিয়ে চলেছে বুঝে উঠতে পারিনি। পিছনের ঠেলা খেয়ে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। জানি না এরপর কে, কিংবা আমিই কিনা। তবে যে আসতেই হবে, সেটা অবশ্যম্ভাবী, চিরসত্য!

গোরস্থানের চারিদিকটা বিরাট ঝোপের মতো বাঁশবনে ঘেরা। আকাশে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সেদিকে চোখ গেল। দেখলাম কিছু নতুন কোঁড়া-জন্ম বাঁশ ছন্নছাড়ার মতো অনেক লম্বা হয়ে সোজা উঠে গেছে। তারা যেন আকাশ ছুঁতে চায়। তাদের বয়স অল্প; নতুন চিন্তা, নব উদ্যম, নতুন শক্তি। কিন্তু তারা জানে না, বয়সের সাথে সাথে তারাও ভারাক্রান্ত হবে, শাখা-প্রশাখা গজাবে, গোঁড়া হয়তো শক্ত হবে, কিন্তু আজ যারা ন্যুব্জ, তাদের মতোই তাকেও একদিন মাথা নোয়াতে হবে।
----

Post a Comment

0 Comments