সুমিত্রা ঘোষ
চতুর্থীর যাবতীয় কাজ শেষ করে রানি রাসমণি জানবাজারের বাড়ি ফিরে এলেন। অন্যের দুঃখকষ্ট রানি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি স্বামী রাজচন্দ্রকে অনুরোধ করলেন গঙ্গার ঘাট বাঁধিয়ে আর গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার রাস্তাও বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন এদেশে বিদেশী শাসনতন্ত্র চলছে। সুতরাং এক্ষেত্রে কোম্পানীর অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন, কোম্পানী অনুমতি দিল। ইংরাজী ১৮৩০ সালে গঙ্গার ঘাট তৈরি করলেন। নাম রাখা হল বাবুঘাট, আজও বাবুঘাট সেই নামে পরিচিত।ঘাট তৈরির পর রানির কথামত গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার রাস্তাও তৈরি হল। রাস্তার নামকরণ হল বাবু রোড। সেই সময় গঙ্গার তীরে বেশ কয়েকটি ঘাট তৈরি করালেন রাজচন্দ্র দাস। রাজচন্দ্র দাস মায়ের স্মৃতিরক্ষার জন্য আহিরীটোলায় একটি ঘাট নির্মাণ করালেন। এরপর নিমতলায় মুমূর্ষু গগঙ্গাযাত্রীদের জন্য গৃহ নির্মাণ করালেন।
তখনকার দিনে নিয়ম ছিল মৃত্যুপথযাত্রীদের (মুমূর্ষু রোগী) গঙ্গার তীরে এনে রাখা হত। এই প্রথাকে বলা হয় অন্তর্জলি যাত্রা। অবশ্য মৃত্যুপথযাত্রীর ইচ্ছে না থাকলে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হত না। রাজচন্দ্র দাসের মা- মায়ার ইচ্ছানুসারে তাঁকে অন্তর্জলিযাত্রা করানো হয়েছিল। এই অন্তর্জলি যাত্রার পেছনে অনেক অপসংস্কৃতি ও অত্যাচার লুকিয়ে ছিল। বাড়ির লোকের থাকার ব্যবস্থা ছিল না গঙ্গার ঘাটে সুতরাং রাত্রে দুষ্ট লোকেরা রোগীর বাড়ির লোকের উপর চড়াও হয়ে নানাভাবে উৎপীড়ন করত। মেয়েদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালাত ও জিনিসপত্র লুঠ করে নিত। রাজচন্দ্র চিন্তাভাবনা করে কয়েকটি গঙ্গার ঘাটে ঘর তৈরি করিয়ে দিলেন যার ফলে মৃত্যুপথ যাত্রীর বাড়ির লোকজন বিশ্রাম করতে পারে। প্রতিটি ঘরের জন্য চিকিৎসক ও দারোয়ান নিযুক্ত করলেন। তখনকার দিনে এমন অভিনব চিন্তা-ভাবনা কল্পনার অতীত ছিল।
সেযুগে রানি রাসমণি ও রাজচন্দ্র দাস একে অপরের পরিপূরক হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সেবাধর্ম, সদাচার ও দানধ্যানে ইতিহাসে নজির স্থাপন করেছিলেন। তখনকার দিনে অনেক রাজা রানি মন্দিরের জন্য অনেক দান করেছেন, মন্দির তৈরি করেও দিয়েছেন এমন নজির আছে কিন্তু অনাথ,আতুর ও সাধারণ প্রজাদেরকে সন্তানস্নেহে ভালবেসে সবরকম সাহায্য করা, অনেক দুঃস্থ মেয়েকে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছেন রানি--এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। তখনকার দিনে বিশাল জমিদার বাড়ি আত্মীয় -পরিজনে ভর্তি, সকলে রানির কাজ মেনে নেননি কিন্তু রানি এ ব্যাপারে মাথা নোয়াননি। মুখ বুজে তার কাজ করে গিয়েছেন। দেবতার মত স্বামী তাঁকে যতদিন পেরেছেন আগলে রেখেছেন। তারপর প্রকৃতির নিয়মে রাজচন্দ্রকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
🍂
জানবাজারের ঐতিহাসিক বাড়ি রাজচন্দ্র দাস তৈরি করিয়েছিলেন রানির জন্য। এই বাড়ি তৈরির আগে রাজচন্দ্র দাস সপরিবারে একটা দোতলা বাড়িতে থাকতেন। রাজচন্দ্র দাস জানবাজারের বাড়িটি ছিল বিশাল বাড়ি। সাত মহলে বিভক্ত এই বাড়িটিতে প্রায় তিনশো ঘর ছিল। এই বাড়ি নির্মাণ শুরু হয় ১২২০ বঙ্গাব্দে এবং শেষ হয় ১২২৮ শব্দে। তখনকার দিনে খরচ হয়েছিল পঁচিশ লক্ষ টাকা। রাজচন্দ্র স্ত্রীকে কতটা ভালবাসতেন তার প্রমাণ এই বৃহৎ সাতমহলা বাড়িটির নাম রাখা হয় 'রানি-রাসমণি কুঠি''।পিতার মৃত্যুর পর রাজচন্দ্র নিজের চেষ্টায় ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধি করে বিষয় সম্পত্তির পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়েছিলেন। তিনি অতি সজ্জন এবং পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন।
ক্রমশ
0 Comments