যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৮৬
আবার এলোমেলো কথা বলা শুরু করেছেন। ঠিক মত ওষুধ খাচ্ছেন না। আমি কিছু বলতে গেলে তেড়ে আসছেন। সবসময় একটা কল্পনার জগতে বাস করছেন। আমারও বাস্তব জীবন আর কাজের জগৎ দুটো বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। অবচেতন মনে সবসময় দেখি কে যেন সারা বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেটা মনে মনে চাইছি, মনে হয় সেটাই দেখছি। ওনাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারছি না। মাঝে মাঝে ভীষণ অসহায় বোধ করি, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করি না। আমি নাকি অনেকের বেঁচে থাকার প্রেরণা!
সন্ধ্যায় জেলা পরিষদ হলে ‘কাব্য ও কলা’র প্রোগ্রাম আছে। ব্রবতী আসছেন। চিত্তরঞ্জন দুখানা গেস্টকার্ড দিয়ে গেছে। একখানা আমার জন্য, আর একখানা চন্দ্রিমার আমার ছোট্ট সংস্থা ‘এক আকাশ’এর জন্য। এক আকাশ এর নিচে দাঁড়িয়ে কারো সাহায্য না নিয়ে নিজেদের সামর্থ্য মত কিছু জিনিস নিয়ে বিভিন্ন স্কুল, আশ্রমে যাই। তাদের জন্য খাতা, পেন, পেন্সিল, কেক বিস্কিট, কম্বল, স্কুলড্রেস, দেওয়ালঘড়ি, ওয়াটার ফিলটার, ইত্যাদি ওদের প্রয়োজনে লাগবে এমন কিছু জিনিস নিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আসি, কখনও দুপুরের খাবার আয়োজন করে একসঙ্গে সবাই খাই। এটুকু করে থাকি নিজেদের শান্তির জন্য।
আজ উনি ভালই আছেন। মুরগির মাংসের ঝোল দিয়ে রুটি খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন আমি বিকেলে একাই গেলাম। চন্দ্রিমা পরে যাবে। একটি মেয়ে আমাকে নিয়ে গিয়ে সামনের সারির একটি চেয়ারে বসাল। চেয়ারে আমার নাম চেটানো ছিল। প্রচুর ভিড়, চিত্ত একবার এসে দেখা করে গেল। আমাকে দিয়েই চারাগাছে জল সিঞ্চন করে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হল। কিছু কথাও বললাম। এক আকাশ, জঙ্গলমহল, মেদিনীপুর কুইজকেন্দ্রকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল, চিত্তর ছাত্রছাত্রীরা আবৃত্তি পরিবেশন করল। তারপর শুরু হল ব্রততীর আবৃত্তি। মন ভরে গেল। কিন্তু আমার থাকার উপায় ছিল না। ৭ টার সময় আমি চন্দ্রিমা বাড়ি ফিরে এলাম। এসে দেখি উনি রানী তানিকে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন।
আজ দুটি প্রোগ্রাম ছিল। সকাল ১০টাতে কুইজ কেন্দ্রের ‘মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার’, এই বিষয়ে আলোচনা ছিল। যাওয়া হয়নি। দুপুরে ‘এস কে বি’র মিটিং ছিল, গেছলাম। সবিতা এসে ছিল। ওর জন্য বই নিয়ে গেছলাম। নন্দিনী এক কপি নিল, সারদা মঠের মাতাজিকে এক কপি দিলাম। রেখাদি, ভারতীদি ও তপতীদির তিল তিল করে গোড়ে তোলা এই সংস্থার ভার রেখাদির অবর্তমানে নেওয়ার মত কেউ না থাকায় এর দায়িত্ব সারদা মঠের মাতাজিদের দেওয়া হয়েছে। আজ মৌসুমি ঘোষ নামে একটি মেয়ে নতুন সদস্য হল। এখানে ইচ্ছে করলেই সদস্য হওয়া যায় না। দিদিরা কিছুদিন তাকে নজরে রাখেন, সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করলে তবেই তাঁকে সদস্য করা হয়। মৌসুমিকে শুভেচ্ছা জানাতে ও বলল, ‘দিদি বহুদিন ধরে আমি আপনার ফ্যান। এই প্রথম আপনার সঙ্গে দেখা হল। সাহস হয়নি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবার। আমি আর আমার স্বামী নিয়মিত আপনার ওয়াল ফলো করি( তখন লক করা ছিল না)।রেখাদি বললেন, রোশেনারা অনেক কাজ করে, কিন্তু আমরা ওকে দিয়ে কোনও কাজ করাতে পারছি না। টিনেজার মেয়েদের একটা কাউন্সেলিং ব্যবস্থা করতে হবে। সবিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ( ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটি) রোশেনারাদিকে নিয়ে গেছলাম, আমার স্টুডেন্টরা বক্তব্য শুনে মুগ্ধ, তারা বলছিল, মকে আবার নিয়ে আসবেন। ওনার বক্তব্য আমরা আবার শুনতে চাই।
এদিকে সরকার নিত্য নতুন এমন সব ফরমান জারি করছে যে বলার নয়। আজ নোট বাতিল, কাল ‘এন আর সি’ ভয় দেখানো, আধার প্যান কার্ড এর লিঙ্ক, ব্যাঙ্ক বেসরকারি করণেরও হুমকি দেওয়া। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ টাকাই থাক না কেন, প্রত্যেককেই পাঁচ লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। ‘এ তো জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ এর মত অবস্থা। ব্যাঙ্কে রাখলে সরকার ঘুরপথে চুরি করবে। আর বাড়িতে রাখলে বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয়। কী করি তাহলে?
আজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। পাহাড়িপুড় বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে হবে। ওঁরা গাড়ি নিয়ে এলে রওনা হলাম। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সবই ভাল ছিল, ভাল হয়ে ছিল। ছাত্রীদের অনুষ্ঠানও খুব ভাল হচ্ছিল, কিন্তু আমি তো থাকতে পারবনা। দুটোর সময় ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। উত্তরিও ফুলের তোড়া দিয়ে, চন্দনের ফোঁটা দিয়ে বরণ করেছিল। আসার সময় একখানা শাল ও মিষ্টির বাক্স গাড়িতে তুলে দিয়ে গেল।
এসবের পর সরকারি ঝামেলা, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আধার কার্ডের সঙ্গে প্যান কার্ডের লিঙ্ক করাতে হবে। রেশন কার্ড সংশোধনের জন্য নভেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে।
আজ রবীন্দ্রনগরে রামকৃষ্ণ আশ্রমে গেছলাম। এখানে ১৫ জন মাতাজি ও একজন মহারাজ থাকেন। সবার জন্য একসেট করে ষ্টীলের বাসন আর মিষ্টি নিয়ে গেছলাম। ওখানেই দুপুরে খেলাম। বিকেলে মনি এসেছিল, পেনশনের টাকা নিয়ে কী একটা সমস্যা হচ্ছে। আগামিকাল ব্যাঙ্ক যেতে হবে। আমরা পেনশন বিক্রি করবনা বলেছি, তবুও ব্যাঙ্ক টাকা কেটে রাখছে। আমরা নাকি বিক্রি করব বলে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি।
আজ ব্যঙ্কে গিয়ে যিনি এসব কাজ করেন সেই সন্দীপের কাছে গেলাম। উনিও একই কথা বলছেন, আমরা দরখা স্ত জমা দিয়েছি। হেড অফিসে নাকি ডকমেন্ট আছে। বুঝলাম তর্ক করে লাভ নেই। ওনাকেই জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, কেটে ‘রাখা টাকা ফেরত পাওয়া সহজ নয়। আপনি দাদাকে হেড অফিসে একটা চিঠি পাঠাতে বলুন। তাতে যেন লেখেন্, ‘ভুল করে দরখাস্তে সই করে ফেলেছেন’। আমি পেনশন বিক্রি করতে চাই না। আমার টাকা ফেরত দেওয়া হোক’। চলে আসছিলাম হঠাৎ তন্ময়দার সঙ্গে দেখা, ওনাকে সব কথা জানালাম। উনি সন্দীপকে বললেন, ‘ কাজটা আমি করেছি। ওনারা কমিটেশন ফর্মে সই করেন নি।পরদিন মেসেজ পেলাম ওনার এরিয়ারসহ সম্পূর্ণ টাকা আকাউন্টে জমা পরেছে’ । পরে জানলাম, গতকাল আমি চলে আসার পর তন্ময়দা হেড অফিসে ফোন করলে, ওখান থেকে জানায়, ডকমেন্টন আছে। ছবি তুলে পাঠাতে বললে, কিছু পরে জানান ডকমেন্ট নেই। আমাদের ভুল হয়েছে। তন্ময়দা না হলে কী যে হত। ব্যাঙ্কের সব বিষয়ে উনি আমাকে সাহাজ্য করেছেন।
আজ ওনাকে একটা স্মার্টফোন কিনেদিলাম, আমার ফোন নিয়ে টানাটানি করেন। এখন ওনার ভাল সময় কাটবে। এরপর কয়েকদিন ভালই ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ আবার পাগলামি শুরু করলেন। তার ওপর একটা অস্থির অস্থির ভাব। সন্ধ্যারাতে বাবলি ভিডিও কল করেছিল,বাপির সঙ্গেও কথা বলল। ঘুমাল রাত ১২ টার পর। রাত ১ টার সময় আমার সুরু হল বাথরুম যাব, জল খাব, এই করেই প্রায় ১ ঘণ্টা কাটল। ২ টোর সময় বললেন, ‘আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। রাজুকে ডাকো নার্সিংহোম যাব’। রাজুকে ডেকে স্পন্দনে নিয়ে গেলাম। দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেছে, আজ সপ্তমী, এই মুহূর্তে আর এম ও ছাড়া স্পন্দনে কোনও ডাক্তার নেই।উনি তখন বাড়ি ফিরতে চাইলেন। এখন কোনও কষ্ট হচ্ছে না। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি বাড়ি যাব। বাড়ি ফিরিয়ে এনে এসি চালিয়ে শোয়ালাম। কিছুক্ষণ পর আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রাজুকে ফোন করলাম, কিন্তু ও ধরল না। কী করি? পাশের বাড়ির ছেলেটি গাড়ি নিয়ে কোথাও গিয়েছিল, ফোন করে ওকেই বললাম। ওর নিজের গাড়িতেই স্পন্দনে পৌঁছে দিল। বন্ড লিখে সই করে ৩ টে ২০ তে ওনাকে ‘আই সি ইউ’তে ভর্তি করে বসে থাকলাম। অক্সিজেন চলছে। রানী একা বাড়িতে আছে। কারো সঙ্গে আলোচনা করার নেই, করে লাভও নেই। ৭ টা ১৫ ডাক্তার রাউন্ডে এসে বললেন অবস্থা ভাল নয়, আরও কিছু টেস্ট করতে হবে, আজ ডায়ালিসিস করা যাবে না। কয়েকটা জিনিস টেস্ট করাতে দেখা গেল, রিপোর্ট সত্যিই খুব খারাপ। আমি অল্প সময়ের জন্য বাড়ি এসেছিলাম। ফোন এলো, অনার অবস্থা খুবই খারাপ। এখুনি ডায়ালিসিস করাতে হবে এবং সেইসঙ্গে ব্লাডও দিতে হবে, অবশ্য যদি উনি নিতে পারেন। পড়িমরি করে গেলাম। দেখি ভীষণ ছটফট করছেন। ২ ঘণ্টা ডায়ালিসিস চলার মধ্যে ব্লাড দিতে হবে।আমাকে সকালে ব্লাড নিয়ে আসার কথা বললেও, আমি রাতেই ব্লাডের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম । ব্লাড দেওয়ার পর কিছুটা অবস্থার উন্নতি হয়। পাশে সেই চন্দ্রিমা, সৌনক, সুদীপ। মনিকে রাতে খবর দিলাম।
🍂
আজ অষ্টমী, তবুও সকালে সুদীপ এসেছে, মনি আসেছে, মিলিজামাই ফয়েজ এসেছে। ভীষণ ছটফট করছেন, তাই বেঁধে রেখেছে। আজও ব্লাড টেস্টের পর ডায়ালিসিস হবে, ব্লাডও দেওয়া হবে। সুদীপ সব হাস্পাতালে জমা দিয়ে এসেছে, সৌনক গিয়ে ব্লাড নিয়ে আসবে। আজ আমার ছোট ননদ আর নন্দাই এসেছিল। আমি বেশ রাতে বাড়ি ফিরেছি। টোটো, রিক্সা, কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আজ ঝর্ণা(সমাজকর্মী)এসেছিল। চন্দ্রিমা, ঝর্ণা ও আমি হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তায় আমাকে একটা রিক্সা ধরিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল।
নবমী আজ, চন্দ্রিমা সকালে দেখা করে শ্বশুরবাড়ি গেছে। সৌনক, ফয়েজ, ছোটবাবু এসেছিল। এখন আমি অনাকে খাইয়ে দিচ্ছি । ডাক্তার বলছেন, ‘এই পেসেন্টের বিষয়ে আপনিও জানেন আমিও জানি। চিকিৎসা চলছে, নতুন করে তো কিছু করার নেই’। যাইহোক, কবে যে বাড়ি ফেরার মত সুস্থ হবেন, জানি না। বেঁধে রাখাটা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া উপায়ও নেই। খাট থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমি বারবার ভিতরে ঢুকে দেখছি। দুপুরে আনন্দবাজার থেকে ফোন করে ‘আমার ছোটবেলার পুজো’ লেখাটি আরো দু’জায়গায় মেল করতে বলে। সন্ধ্যায় আমার লেখাটি আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত হয়।
আজও একই রকম আছেন, তবে রিপোর্ট ভাল। ডাক্তারকে রিলিজ করার কথা বলাতে উনি বললেন, বিকেলে করে দেব? তারপর নিজেই বললেন, ‘নাহ, আজ থাক। আজ সারাদিন কেমন থাকেন দেখে কাল সকালে রিলিজ করে দেব’। বাবলিদের এতদিন কিছু জানায়নি, কিন্তু এরপর কী করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনার জন্য দীপকে ফোন করে সব জানালাম।ও কলকাতা নিয়ে যেতে বলছে। বাবলিও তাই বলল।
আজ সকালে আমি নার্সিংহোমে পৌঁছানোর আগেই ডাক্তার এসে রিলিজ অর্ডার লিখে দিয়ে গেছেন। সাহবাজ গাড়ি নিয়ে নিতে এসেছিল। সব মিলিয়ে ৬০,০০০ টাকা বিল হয়েছে। এত ক্যাশ টাকা ছিল না, ভাগ্যিস কার্ড নিয়ে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া করে খুব ঘুমিয়েছে। বাড়িতেও অনেকে ওনাকে দেখতে আসছে। সন্ধ্যায় ডঃ সুচন্দ দাসকে ফোন করে সব জানালাম। উনি পরের ডায়ালিসিস সামনের শুক্রবার নিতে বললেন। বিজয়ার প্রণাম জানালেন। একবার অনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসার কথাও বললেন।
ক্রমশ
0 Comments