মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৬৮
সতীশচন্দ্র সামন্ত (স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাংসদ, মহিষাদল)
ভাস্করব্রত পতি
"অজ পাড়াগাঁয়ের যে ছেলেটিকে ছাত্রাবস্থায় পাড়ার ছেলেরা খালের কাদায় জাঁকিয়ে দিলে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল, ভাবতে ভালো লাগে সেই ছেলেটি বড়ো হয়ে ভিয়েনার আন্তর্জাতিক দরবারে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে বক্তৃতা করছেন; ভারতের সংবিধান তৈরির কাজে ব্রতী হয়েছেন; বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার জন্য গণপরিষদে দরবার করছেন, ভারতবর্ষের পার্লামেন্টে প্রথম বেসরকারি বিল আনছেন, চিরকাল সব সাংসদদের সশ্রদ্ধ অভিনন্দন কুড়োচ্ছেন। সাংসদ হিসাবে যে বাংলোটি তিনি পেয়েছিলেন, সেটি ছিল এ অঞ্চল থেকে দিল্লিগামী সব মানুষের থাকা- খাওয়ার আস্তানা। অকল্পনীয় তাঁর মানুষের প্রতি ভালোবাসা। গান্ধি-জীবনীকার Louis Fischer গান্ধিজি সম্পর্কে বলেছিলেন—জনসাধারণ গান্ধিকে ভালোবাসতেন কারণ গান্ধিও তাঁদের ভালোবাসতেন প্রতি মুহূর্তে, প্রতিক্ষণে। সতীশচন্দ্র সম্পর্কেও সেকথা বলা যায় সহজে" -- এভাবেই সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্তকে মূল্যায়ন করেছেন অধ্যাপক হরিপদ মাইতি। তিনি লিখেছেন, "অবক্ষয়ের পঙ্কিলতায় যখন আমরা দিশা হারাচ্ছি, তাঁর চরিত্রের মহান আদর্শগুলি আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের পথ দেখাবে। একদিন সেগুলি হবে সমাজ, সভ্যতা তথা সংস্কৃতির রক্ষাকবচ"।
১৯০০ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর মহিষাদলের গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সতীশচন্দ্র সামন্ত। বাবা ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত এবং মা কিশোরী দেবী। তবে তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল পাঁশকুড়ার পাইকবাড় গ্রামে। মাত্র আড়াই বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু হয়। তখন ঠাকুমা, কাকিমা এবং বিমাতার কোলে কোলে বড় হয়েছেন।
মহিষাদল রাজ হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেনী থেকে ভর্তি হলেন। অত্যন্ত মেধাবী সতীশচন্দ্র এখানে ১৯১৬ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ঠিক এই সময় (১৯১৬ - ১৯২০) এখানে অন্তরীন ছিলেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী। তাঁর সান্নিধ্যে চলে আসেন বালক সতীশচন্দ্র। প্রতি দিন কিছুটা সময় হলেও তাঁর কাছে এসে যাবতীয় বিষয়ের আলোচনা শুনতেন। ধীরে ধীরে বিপ্লবের বীজমন্ত্র সতীশচন্দ্রের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হয়। ম্যাট্রিক পাস করে বঙ্গবাসী কলেজে আই এস সি তে ভর্তি হন। এসময় ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয় মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চল। তখন বিপর্যস্ত মানুষগুলোর জন্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় গঠন করেন 'সঙ্কট ত্রাণ সমিতি'। সেই সংগঠনের জন্য কলেজ পড়ুয়া সতীশচন্দ্র নিজে নেতৃত্ব দিয়ে তাঁর সহকারী বন্ধুদের নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে সংগ্রহ করেছিলেন প্রায় এক হাজার টাকা। যা এখনকার এক লক্ষ টাকার সমান। তা তুলে দেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিভাগে আই এস সি পাস করে ভর্তি হন শিবপুর বি ই কলেজে। কিন্তু তাঁর আর ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হয়ে ওঠে নি। ১৯২১ এ মহাত্মা গান্ধী ভারত জুড়ে শুরু করেছিলেন মহাসংগ্রাম। সেই সংগ্রামে নিজেকে ব্যাপৃত করলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা ছেড়ে। তিনি কলকাতায় একটি পিকেটিংয়ে যোগ দেন। এজন্য গ্রেফতার হয়ে বিচারে ছয়মাসের কারাদণ্ড হয়। ১৯২২ নাগাদ মেদিনীপুরের ২২৭ টি ইউনিয়ন বোর্ড বাতিল করে ব্রিটিশ সরকার। তখন বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে সতীশচন্দ্র ইউনিয়ন বোর্ড বর্জন আন্দোলনের শরিক হন। ১৯২৪ এ তমলুকের হ্যামিল্টন হাইস্কুলে আয়োজিত হয় স্বদেশী মেলা। এখানেই প্রথম আলাপ হয় সতীশচন্দ্র সামন্তের সাথে অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের। যা পরবর্তীতে এক যুগান্তকারী ঘটনার উদাহরণ হয়েছিল।
১৯৩০ সালে নরঘাটে লবন সত্যাগ্রহ শুরু হয়। সেখানে অংশগ্রহণ করেন সতীশচন্দ্র সামন্ত। জেলাশাসক পেডীর নির্দেশে সত্যাগ্রহীদের ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। আন্দোলনের তৃতীয় দিন তিনি চূড়ান্ত নির্যাতনের শিকার হন। তবে ১৬ ই এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় সতীশচন্দ্র সামন্তের জেলজীবন। জেল থেকে ফেরার পর তমলুক থানায় আন্দোলন পরিচালনার ভার পড়লো তাঁর ওপর। ১৯৩২ এর মার্চে গান্ধীজী অনশন শুরু করেন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে। সতীশচন্দ্র সামন্তও অনশন করলেন বর্গভীমা মন্দির প্রাঙ্গণে। অবশেষে গান্ধীজী অনশন ত্যাগের পর তিনিও অনশন ভঙ্গ করেন। ১৯৩৪ এ ব্রিটিশ সরকার এক বছরের জন্য তাঁকে নিজের বাড়িতেই গৃহবন্দী করে রাখে।
গঠনমূলক কাজকর্মের অঙ্গ হিসেবে নিমতৌড়িতে পল্লী সেবা সমিতির একটি স্কুল খোলা হল অজয় মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দাস এবং ভবতোষ দাস। শুধু শিক্ষাদান নয়, গ্রামবাসীদের একটু ভালো চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার জন্য সতীশচন্দ্র ভর্তি হন কলকাতা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে। এখানে চার বছর ধরে পড়াশোনা করেন। তবে ডিপ্লোমা তিনি পাননি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছাড়ার মতো ডাক্তারিও ছেড়ে দেন মাঝপথে। ১৯৪০ এর ১৫ ই অক্টোবর শুরু হয় ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ। ডাক্তারী পড়া ছেড়ে তমলুক ফিরে আসেন। এই আন্দোলনে নেমে মহিষাদলের গোহালবেড়িয়া গ্রাম থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। এজন্য তাঁকে গ্রেফতার করে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পল্লী সেবা সমিতির কাজের দরুন মানুষজনের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন সে সময়। ঐ মানুষজনের কাছে অজয় মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন 'বড়বাবু' এবং সতীশচন্দ্র সামন্তের পরিচয় হয় 'মেজবাবু' নামে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই পল্লী সেবা সমিতির গুরুত্ব এবং অবদান অপরিসীম।
নিমতৌড়িতে দিনের পর দিন একসাথে কাজের সূত্রে সতীশচন্দ্র সামন্ত এবং অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নিবিড় সম্পর্ক। যা দেশের জন্য অম্লান কীর্তি স্থাপন করতে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। এই বিষয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী রাধাকৃষ্ণ বাড়ী লিখেছেন, "এই নিমতৌড়ীতেই কাজের সূত্রে সতীশচন্দ্র সামন্ত এবং অজয় মুখোপাধ্যায় — এই দুই মহান কর্মযোগীর মধ্যে ধীরে ধীরে এমন একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা শুধু তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, তমলুক তথা মেদিনীপুরের সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসকে বহুলাংশে প্রভাবিত করেছিল। দুই বন্ধুই নিজেদের জন্য কিছুই চাননি। সারা জীবন অবিবাহিত থেকে দেশের কাজে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ত্যাগে ও নিষ্ঠায়, শ্রমে ও সেবায়, সাহসে ও সংযমে এই দুই মহান কর্মযোগীর তুলনা মেলা ভার। উভয়ের চরিত্রের মধ্যে তফাত যেটুকু ছিল তা কখনও তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত সৃষ্টি করেননি। বরং তা উভয়ের চরিত্রের পরিপূরক হিসাবে তাঁদের বন্ধুত্বকে একটা সম্পূর্ণতা এনে দিয়েছিল।
তীক্ষ্ণধী অজয়কুমার বিশ্লেষণশীল মন নিয়ে সব কিছু যাচাই করে তবে গ্রহণ করতেন। আর যা কিছু গ্রহণ করতেন যুক্তির কষ্টিপাথরে বারে বারে তাকে যাচাই করতেন। প্রয়োজন বোধে পরিবর্তন করতেন। স্থিতধী সতীশচন্দ্রের মন ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল। তিনিও বিচার বিবেচনা করেই গ্রহণ করতেন। তবে একবার যা শ্রেয় বলে গ্রহণ করতেন — সহজে তা বিসর্জন বা পরিবর্তন করতেন না। অজয়কুমার তীক্ষ্ণ যুক্তিজাল বিস্তার করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হতেন; স্বল্পবাক সতীশচন্দ্র সকলের মতামত শুনতেন, শেষে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতেন। সে সিদ্ধান্ত ছিল অলঙ্ঘনীয়।
এই দুই মহারথী কর্মবীরের বন্ধুত্ব তাঁদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই বলে তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ যে কখনও ঘটেনি — তা নয়। তবে সেই মতান্তর কখনও মনান্তর সৃষ্টি করেনি। এই দুই দৃঢ়চেতা মানুষ তাঁদের নিজস্ব বিচার বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু যাচাই করে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সব সময় হয়তো একমত হতে পারেননি। কিন্তু সেই মতপার্থক্য তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে বা বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কখনও বিপর্যয় ডেকে আনেনি। তাঁদের পরস্পরের প্রতি আস্থা এবং শ্রদ্ধা এত গভীর। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস এত প্রবল যে একজন অন্যজনের দৃষ্টিভঙ্গি, বিচার বিবেচনা বোঝার চেষ্টা করতেন। নিজের মতকে অন্যের মতের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিয়ে একযোগে কাজে নেমে পড়েছেন"।
১৯৪২ এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর ছিল তমলুকের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ঘটনা। এদিন থানা দখলের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তাই তার আগের দিন ২৮ শে সেপ্টেম্বর সতীশচন্দ্র ও অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জেলার প্রতিটি রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং কেটে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪২ এর আন্দোলন সারা ভারতে বিশাল প্রভাব ফেলে। থানা দখল করতে গিয়ে মাতঙ্গিনী হাজরা সহ বহু মানুষের মৃত্যু হয় ইংরেজদের গুলিতে।
এই ঘটনার পর ডিসেম্বর মাসে মহকুমার সকল নেতৃবৃন্দ একসাথে হন সতীশচন্দ্র সামন্তের সভাপতিত্বে। সেখানে তিনি সিদ্ধান্ত নেন তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম ও সুতাহাটা এই চারটি থানায় গঠিত হবে 'জাতীয় সরকার'। সেই মোতাবেক ১৯৪২ এর ১৭ ই ডিসেম্বর (১৩৪৯ এর ১ লা পৌষ) গঠিত হয় "মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত তাম্রলিপ্ত জাতীয় শাসন ব্যবস্থা, সংক্ষেপে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার"। এই সরকার চলছিল ১৯৪৪ এর ৮ ই আগস্ট পর্যন্ত। এই জাতীয় সরকারের প্রথম সর্বাধিনায়ক হন সতীশচন্দ্র সামন্ত ( ১৭/১২/১৯৪২ - ২৬/০৫/১৯৪৩)। মহকুমা নেতৃবৃন্দের নির্দেশে একটি কাজে কলকাতাতে এলে সেখানে তিনি ও জাতীয় সরকারের প্রচার সচিব প্রহ্লাদ কুমার প্রামানিক গ্রেপ্তার হন ২৬ শে মে। তারপর সর্বাধিনায়ক হন অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় (২৭/০৫/১৯৪৩ - ১৯/০৯/১৯৪৩)। বিচারে সতীশচন্দ্র সামন্তের তিন বছরের কারাবাস হয়।
১৯৪৫ এর ডিসেম্বরে জেল থেকে বেরোনোর পর দায়িত্ব পড়ে মহাত্মা গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানানোর। ১৯৪৫ এর ২৫ শে ডিসেম্বর তিনি মহিষাদল আসেন। ছিলেন ২৯ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। সতীশচন্দ্র ছিলেন অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি। দ্বিতীয় দিন তাঁর সাথে গান্ধীজীর আলোচনা হয়। তিনি সব হিংসাত্মক ঘটনার দায় স্বীকার করে নেন গান্ধীজীর কাছে। সে প্রসঙ্গে ডাঃ সুশীলা নায়ার লিখেছেন, "সতীশদা ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ নিজেদের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন যে তাঁদেরকে নিন্দা বা তিরস্কার করা হবে। কিন্তু বাপু তাঁদের সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছেন"।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আগেই। ১৯৪৬ সালে সেই গণপরিষদের সদস্য হন তমলুকের সতীশচন্দ্র সামন্ত এবং কাঁথির বসন্তকুমার দাস। পাকিস্তান আলাদা গণপরিষদ গঠন করায় ভারতে আবারও গণপরিষদ গঠিত হল। ১৯৪৭ এর জুলাই মাসে এই গণপরিষদের সদস্য ফের নির্বাচিত হন সতীশচন্দ্র সামন্ত। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি। এরপর অন্তর্বর্তী পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে কাজ করেন ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত। ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫২ তে। তমলুক কেন্দ্র থেকে তিনি কংগ্রেসের হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫৭, ১৯৬২, ১৯৬৭ এবং ১৯৭১ এ জয়ী হন সাংসদ হিসেবে। তবে ১৯৬৭ এর লোকসভা নির্বাচনে তিনি সারা ভারতের মধ্যে সর্বাধিক ৬৮.৪৭% ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন।
দীর্ঘ ৩০ বছরের সংসদীয় জীবনে তিনি তিনটি ক্ষেত্রে ছাপ রেখে গিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণ বাড়ী লিখেছেন, "প্রথমত পার্লামেন্ট এবং সরকার কর্তৃক গঠিত বহু কমিটিতে তিনি তাঁর কর্মকৃতির পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৫৪ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন কনফারেন্সে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত পার্লামেন্টে বেসরকারি বিল এবং প্রস্তাবাদি উত্থাপনেও তিনি সমান সক্রিয় ছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারতীয় লোকসভায় প্রথম যে বেসরকারি বিলটি গৃহীত হয়েছিল এবং সরকারি স্বীকৃতি লাভ করেছিল — সেটি রচনা এবং উপস্থাপনার কৃতিত্বও তাঁরই। তৃতীয়ত যে ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছিলেন সেটি হল লোকসভায় তাঁর আনীত প্রশ্নসমূহের উত্থাপন এবং আলোচনার মুন্সিয়ানায়। তাঁর সাংসদীয় জীবনে তিনি আড়াই হাজারেরও বেশি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং সে সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন"। তাঁর জীবনের আরেকটি মহৎ কাজ হল হলদিয়া বন্দর স্থাপন। এমনকি হলদিয়া বন্দরের নামকরণ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
সতীশচন্দ্র সামন্তের চরিত্রের মহৎ গুণ হল তাঁর কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ বিফল মনোরথ হননি। দিল্লিতে তাঁর বাসস্থান ছিল এখান থেকে যাওয়া লোকজনের নিরাপদ আস্তানা। একসময় যাঁর কাছে রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল, সেই স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের স্মৃতি রক্ষার্থে নিজের পৈতৃক সম্পত্তির ৪ বিঘা ১২ ডেসিমল দান করে দেন। মহিষাদলে গড়ে উঠেছে 'প্রজ্ঞানানন্দ ভবন'। ১৯৭৭ সালে তিনি রাজনীতির অঙ্গন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। শেষ দিনগুলি এই প্রজ্ঞানানন্দ ভবনেই কাটান। অবশেষে ১৯৮৩ র ৪ ঠা জুন মেদিনীপুরের এই রতনটি চিরতরে বিদায় নেন ধরাতল থেকে।
[তথ্য সহায়তা -- সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র, রাধাকৃষ্ণ বাড়ী, মেদিনীপুর আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা কেন্দ্র]
0 Comments