সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব-৭
গৌতম বাড়ই
সেদিনের কথা:
ভরতরাজভৃগু বা ভরতভৃগুর আজ সকাল থেকেই পরিবেশটা কেমন গুমোট লাগছিল। এক বিচ্ছিরি ধরনের বাতাসের গায়ে এঁটুলির মতন সেঁটে যাওয়া সন্দিহান আবহাওয়া চারিদিকে। কথিত আছে, গুপ্তচরদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় শিকারি কুকুরের চেয়েও প্রখর হয়। ভরতরাজের আদি বাসস্থান পাটালিপুত্রের দিকে। বেদজ্ঞ পুরুষদের সান্নিধ্য সে ছোটোবেলা থেকে পেয়েছে। বেদবর্ণিত সমাজের চারিভাগের, একদম উচ্চতম স্থানে তাদের বংশের অবস্থান। মিথিলা নগরীর ব্রাহ্মণকূল জাত সে। তারপর কেমন করে এ বঙ্গেশ্বরের কাছে এসে একদম রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে। গুপ্তচরবৃত্তি এখন তার পেশা। আর এ শুধু রাজাধিরাজ জানেন। অত্যন্ত কুটিল স্বভাবের এবং রাজার চরম আজ্ঞাবাহী। বলতে গেলে রাজার খাস আদমী সে। সেনাপতি অনুরের কর্মকুশলতা, তার দৈহিক শক্তির প্রশংসা করতেই হয় সবার। তার সৈন্যদলের গুরুত্ব এই সেনাপতির জন্য। তবুও রাজার কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা একশো শতাংশ নয়, যা আছে রাধিকা স্বভাবের আর কিছুটা নারীসুলভ কথাবার্তার আদব-কায়দার এই ভরতভৃগুর জন্য। রাজার একান্ত আপনজন ও গোপন পরামর্শদাতা এই ভরতভৃগু এখন। রাজপ্রাসাদের নাড়ি টিপলে রাজনৈতিক উস্তাদেরা বলে দেবেই, আগামী দিনের মন্ত্রীপদে হয়ত এই ভরতভৃগুকে দেখা যেতেই পারে বঙ্গদেশে। চেহারায় একদম ছোটোখাটো সে নয়, তবে চোখমুখে পুরুষের দীপ্ততা নেই। বরং মেয়েলী গড়নই বেশি, টানাটানা হরিণের মতন চোখ, ভ্রুর বক্রতা, আঁখি পল্লবে যেন নারীর সৌন্দর্য আঁকা। অমন নরম মুখে আর যাই হোক যুদ্ধ- বিশৃঙ্খলা মানায় না। ঈশ্বর হয়ত এক সুন্দরী নারী আঁকতে গিয়ে শেষে একজন পুরুষ এঁকে ফেলেছেন। বঙ্গেশ্বর তাকে খুব পছন্দ করেন। তার ধীর লয়ে বলা কথার গভীরতা, বুদ্ধি বাতলানো, যেন এক মিষ্টি তরঙ্গ বয়ে এনে দেয় রাজার বুকে। আর অনুর কথার থেকেও , কাজে বেশি আগ্রহী। বঙ্গেশ্বর হয়ত মনে-মনে অনুরকে ঈর্ষা করেন। অনুরের পরাক্রমশালী পুরুষালী চেহারার পাশে খোদ বঙ্গেশ্বর বড়ই ম্রিয়মাণ। ভরতভৃগুর এ কথা মনে বেশ জানা আছে, রাজার স্নেহের দূর্বলতা তার প্রতি, তাই সে বেপরোয়া, তাই সে রাজার খাস গুপ্তচর।
দিনের শুরু থেকেই একটা সন্দিহান পরিবেশ, একটা বিষাক্ত গন্ধ ভরতভৃগুর নাকে আজ লাগছিলো। তাই রাজপ্রাসাদের সবার চালচলনেই সে কঠিন দৃষ্টিপাত করছিল। এইভাবে একটি আচানক মুহূর্তে অনুরের সাথে চোখাচোখি হলো। কোন কথা হল না। অনুরের চোখগুলো ইস্পাতের অস্ত্রের মতন ঝলসে উঠলো যেন। ভরতভৃগু বুঝলো আজ তাকে একপলও শিথিল হলে চলবে না। রাজকন্যা সুসীমা আজ তার আপন কক্ষে গতদিনের মতন হাসিখুশিতে রয়েছে। দিনের আলো পড়ে আসাতে, রাজমহলের দরজা- জানালা অন্ধকারে ভূতুড়ে ছায়ায় পরিণত হল। সন্ধে নামল রাজপ্রাসাদে। রাণীমা আজও সায়াহ্নে এসে ঢুকলেন তার কন্যার কক্ষে। দাস-দাসীরা তেলের বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এতবড় রাজপ্রাসাদে এখন আলোছায়ার রহস্যময় পরিবেশ। থামের আড়ালে ছিলেন ভরতভৃগু, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেই বিরাট কক্ষের একদিকে ঘাপটি মেরে রাণীমা আর রাজকন্যার কথাবার্তা শুনলেন। গুপ্তচরবৃত্তির কোনও মর্যাদা নেই, যতক্ষণ সে ধরা না পড়ছে। আবার ধরা পড়লেও, তার এই পেশা বড় নড়বড়ে হয়ে পড়বে। বিশ্বাসঘাতক বলে গণ্য হবে সে। ভরতভৃগুর আজকে বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করছিল, এইরকম ভাবে গোপনে রাজকন্যার কক্ষে প্রবেশ করে। কোনো অশনি সংকেত কী? তার এই বুক ঢিপঢিপ করাটা।
যামের তিনপ্রহর সে বড় শুভ এবং ভীষণ অশুভ ক্ষণ। এই সময় দেবতারা আর ভূত-প্রেত- পিশাচেরা পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসে। দেবালয় আর যমালয় থেকে। আর এই সময়েই মানুষ আর প্রাণীকূলের সবাই গভীর নিদ্রায় অচেতন থাকে। তস্করেরা বেছে নেয় গৃহস্থের বাড়িতে সিঁদ কাটবার প্রকৃষ্ট সময়। গাছেরা আপনমনে কথা বলে এ- ওর সাথে। ফুলেরা ফোটবার জন্য তোড়জোড় করে। যারা এই সময় জেগে থাকে, তারা জানে রাতের তিনপ্রহরে কেন সাধু- সন্ন্যাসী- মুনিরা সব জাগরণে যায়! প্রহরীদের মিনার থেকে নেমে আসে অনুর , অন্দরমহলের ভেতরে অন্ধকারে গা-ঢাকা দেয়। এই রাতের অন্ধকারেও তার উপরে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অন্দরমহলে সজাগ পাহারার। আর অনুরের প্রতিটি গতিবিধির ওপর নজর রাখছে গুপ্তচর ভরতভৃগু একদম গা-ঢাকা দিয়ে। রাজকন্যার কক্ষ থেকে বেশ হ্যাপা করেই বেরিয়ে আসতে হয়েছিল তাকে। বেরিয়ে সে এখন আড়াল নিয়েছে অন্ধকার থামে। তবে মা ও মেয়ের দু- চারটি মামুলি কথাবার্তা ছাড়া তেমন কিছু আর হয়নি ঐ সন্ধ্যারাতে। ভরতভৃগু ভেবেছিল কিছু খাসখবর রাজনের কানে তুলে দিতে পারবে, না, সে আশা গুড়েবালি হল। এ রাজকন্যা শাল্মীকাঠের চেয়ে দৃঢ় , ইনি এক-পা পিছিয়ে, ভবিষ্যতে চার-পা এগিয়ে যাবেন। এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ। ভরতভৃগু মার্জারের চেয়েও শব্দহীন পদচালনা করে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সে। ধরা পরতে পরতে বেঁচে গিয়েছিলেন। এখন পরনে কালোপোষাক। হাত দুয়েক দূর থেকেও অন্ধকারে ঠাওর করা যাবে না, থামের আড়ালে একজন মানুষ লেপ্টে আছে।
🍂
রাজপ্রাসাদের ছাদের কোথাও বা কার্নিসে বা ঘুলঘুলিতে রাতচরা প্যাঁচা ডেকে উঠলো। এক-দুবার শোনা গেল কর্কশ কাকের ডাক। তক্ষকের তীব্র চিৎকার ভেসে এলো দূর থেকে। বাস্তুসাপেরা শিকারে বেরোবে এবার। একটি বালিরদানা বা পাতা খসলেও ভরতভৃগুর কানকে এড়িয়ে যেতে পারবে না মনে হয়, সে কান খাড়া করে উৎস বুঝে নিতে চাইছে। এবারে তার কানে মানুষের পদচারণা ধরা দিল। কানেই সে বুঝতে পারছে অন্ধকারে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। ভয়াল আর ভয়ংকর সে পদচালনা। মানুষ নয়, হিংস্র কোনও শ্বাপদ শিকারে বেরিয়েছে এই গভীর কালো রাতের অন্ধকারে। গুপ্তচরের নাক, কান, চোখ, মুখ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিকারি কুকুরের থেকেও বেশি সক্রিয়। আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে। ঘাতক লুকিয়ে আছে অন্ধকারে। তবে কে? কাকে হত্যা করবে? না কি জটিল কোনো অভিসন্ধি আটবে কেউ রাতের অন্ধকারে? কেউ জানে না। প্রতিটি রাজবংশের এইরকম একই ধারা। কেউ, কোথাও না কোথাও, এক কুটিল- জটিল অভিসন্ধি এঁটে যাচ্ছে। সনাতন ঐতিহ্যের ধারা। ভরতভৃগু কান পেতে শোনে সে শব্দ। দীর্ঘ বলিষ্ঠ এক ছায়া যেন তার বুক ঘেঁসে বেরিয়ে গেল। ভরতভৃগুর কোমরে গোঁজা ছুরিকায় হাত চলে এলো, দৃঢ় ভাবে ধরলেন। সেই ছায়া মিলিয়ে গেল কালো অন্ধকারে। এখন চারিদিক নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধতা খুব ভয়ংকর। কান পেতে থাকেন উনি। হ্যাঁ, হালকা অথচ তীক্ষ্ণ এক শব্দ। অন্ধকারে সন্তর্পণে পা- চালিয়ে শব্দের কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করলেন ভরতভৃগু। একদম ঠিক, খিড়কি খোলার আওয়াজ। মানুষের ফিসফাস, নারীকন্ঠ মিশে আছে তাতে। তারপর চুপচাপ। ভরতরাজভৃগু এই মুহূর্তে রাজকন্যার কক্ষের কাছাকাছি এসে গিয়েছেন। তিনি সন্ধ্যা হতেই আজ বিধিনিষেধ ভেঙ্গে রাজকন্যার কক্ষে প্রবেশ করেছেন। রাজকন্যার কক্ষের এত কাছাকাছি তার যাওয়ার রাজার অনুমতি নেই। তবে তিনি তো রাজার একান্ত খাস- গুপ্তচর, প্রয়োজনে বিধিনিষেধ ভাঙতেই পারেন। ভেবেছিলেন আজ নতুন কোনও খবরে রাজাকে চমকে দেবেন, তাহলে রাজা যারপরনাই সন্তুষ্ট হবেন তার উপরে। ওরকম খবর সংগ্রহ করতেই চুপিসারে সুসীমার ঘরে গা- ঢাকা দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। আর শূন্য মগজে ফিরেছিলেন। শুধু একবার মাতা আর কন্যার চড়াসুরে কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিলেন। তবে এবারে নিশ্চয় সেই পিলে চমকানো খবর পাবেন, আর রাজার কানে পৌঁছে দিতে পারবেন এখন এই যামের তিনপ্রহরে। তবে? প্রতিপক্ষটি কে? অনুর কী? ভয়ে বুকের রক্ত কিন্তু ভরতভৃগুর শুকিয়ে এলো। রাজমহলের অন্দরে কথিত আছে, পবনের চেয়েও বেশি গতিবেগে চলে সেনাপতি অনুর। যিনি সব্যসাচী। পশ্চিমা দেশের ঘোড়া তার আদেশে, তাকে নিয়ে যেন চোখের পলকে শূন্যে উড়ে যায়। অসি যখন তার দু-হাতে বনবন ঘোরে চোখে দৃশ্যই হয় না। এই পরাক্রমশালীকে স্বয়ং রাজাও খুব সমঝে চলেন, জানেন অনুর হচ্ছে তার পরম সম্পদ। ভরতভৃগু আজ যদি সেই সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে, তবেই না কেল্লাফতে। মহামন্ত্রী বৃদ্ধ না হলেও, রোগগ্রস্ত হয়ে রাজকার্য সামলাতে পারছেন না, রাজাও চাইছেন মহামন্ত্রীপদে একজন যোগ্যলোক। ভরতভৃগুর চোখ ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই অন্ধকারেও চকচক করে উঠলো আর টের পেলো রাজকন্যার কক্ষের সদর দরজা একদম সপাটে খোলা। ভিতরে নারী পুরুষের কন্ঠস্বর। দ্বিধান্বিত হয়ে নিকটে এক জায়গায় ভরতভৃগু আড়াল নিলো। আবার তার বুক ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে! সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো খানিকক্ষণ।
এ কোন অশুভ সংকেত? যামের তিনপ্রহর আর চতুর্থ প্রহরের শুভ-অশুভ এই সন্ধিক্ষণের সংকেত মিথ্যে হয় না! তাহলে------
0 Comments