শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২২
সালেহা খাতুন
কোথায় যেন পড়েছিলাম জীবন খুব বড়ো একটা রোমান্স। বেঁচে থেকে একে ভোগ করাই রোমান্স। অতি তুচ্ছতম, হীনতম একঘেয়ে জীবনও রোমান্স। তাই উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো একটা রেজাল্ট চেয়েও যখন পেলাম না তখন নানান বই পড়ার সুফল নিজের জীবনেই প্রয়োগ করলাম “ চেয়েছিলাম, পাই নি ব্যস, ফুরিয়ে গেল। কিন্তু পেলাম না বলেই যে বাকী জীবনটা হাহাকার করে মরব এই বা কেমন যুক্তি।”
জগতের প্রভু যে আলো পাঠিয়েছেন বুক ভরে তা নিয়ে অন্তরের একটা জগত সৃষ্টির খেলায় উঠলাম মেতে। জন্ম নিল অপটু হাতের রাশি রাশি গদ্য এবং কবিতা। লাল নীল ডায়েরিদ্বয়ে নিজেকে প্রকাশের খেলায় মত্ত হয়ে গেলাম। ঐ ১৯৯১-৯২ এর ডায়েরিদ্বয় আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই দিনগুলিতে। কত অসম্পূর্ণ গল্প রয়েছে। কমলকুমার মজুমদারের গল্প পড়ে তাঁর স্টাইল রপ্ত করার চেষ্টা দেখে এখন হতবাক হয়ে যাই। আত্মবিস্মৃতির হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয় আমায়। আমার গল্পের নায়িকা সাইনি যে আমারই প্রতিভূ।
লিখেছিলাম – সাইনি হয় উনিশ বছরের। সে সারাদিন ব্যস্ত থাকে নানান গল্প বই নিয়ে। অপাঠ্য, সুপাঠ্য, কুপাঠ্য সব কিছুই সে পড়ে । সে বাংলা সাহিত্যের একেবারে উদার সমালোচক। সব গল্প উপন্যাস তার কাছে প্রিয় ঠেকে। পড়ে শেষ করতে না পেরে নিজে নিজে লেখার ইচ্ছা করলো। আবার দক্ষতাও কিছু নেই, তাই আবার গল্পের বই গিলতে আরম্ভ করলো।
🍂
কিন্তু লেখার অদম্য বাসনা তার; যেমন রোগগ্রস্ত রোগীর নিষিদ্ধ জিনিস খাওয়ার প্রবল বাসনা জন্মে। রোগীর মৃত্যু সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা না খেয়ে ঘটলে তার আত্মীয়স্বজনরা খুব দুঃখ পায়; তেমনি সাইনি লিখতে না পেরে দুঃখ পাচ্ছিল। কোন লেখকের স্টাইলে ও লিখতে শুরু করবে, এই ভাবনা নিয়ে অনেক লেখকেরই পাঠক হয়েছে।
প্রখর সূর্যালোকিত দিনের মধ্যাহ্নে সবাই যখন স্নান করার জন্য ব্যস্ত, এরপরই আহার গ্রহণ করবে সাইনি তখন বুঁদ হয়ে আছে কমল মজুমদারের লেখায়। এমন সময় সেখানে এলো এক ভদ্রমহিলা। ...এরপর গল্পে চলেছে ভাষাতাত্ত্বিক পরীক্ষা নিরীক্ষা।
ঐ বছরে লম্বা একটা লিস্টে পাঠক সালেহার পাঠপরিধি তার নিজেরই চোখকে প্রায় কপালে তুলে দিচ্ছে। কলেজ লাইব্রেরি, বুড়িখালি পাবলিক লাইব্রেরি, বাড়ির সংগ্রহ মিলে বেশ কিছু বই সে পড়ে নিয়েছে। শশধর দত্তের দস্যু মোহন দুই খণ্ড, নীহাররঞ্জন গুপ্তের তুয়া অনুরাগে-দূরের মানুষ-বকুল গন্ধে বন্যা এলো-অপরেশান-বেলাভূমি-তাজের স্বপ্ন-ইস্কাবনের টেক্কা,নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মহাকালের মন্দির,নারায়ণ সান্যালের আবার যদি ইচ্ছা কর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরকপালে রাজারানী-নগরপারে রূপনগর-একটি বিশ্বাসের জন্ম, সত্যজিৎ রায়ের আরো এক ডজন, রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎ রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাবলী, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্প,উমাপ্রসাদের পালামৌর জঙ্গলে, জামেদ আলীর অরণ্যে অরুণোদয়, নটরাজনের চক্রী ও চক্রান্ত-ওরা সেই পুলিশ,বিবেকানন্দের আমার ভারত অমর ভারত, হজরত মহম্মদের (সঃ)জীবনী,মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, পঞ্চসতী ,ওমরের জীবনী, ফাতেমার জীবনী, আনোয়ারা মনোয়ারা, ঠানদিদির থলে, অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল,ছেলে কার, পথের সন্ধান,সৌরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের আলেয়ার আলো, শৈলবালা ঘোষজায়ার রঘু সদ্দার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যাই-নীল মানুষের সংসার-সাদাবাড়ি,বুদ্ধদেব গুহর ঋভু বুলবুলি, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের সন্ধ্যারাগ, বুদ্ধদেব বসুর তিথিডোর, মুজতবা আলীর জলে ডাঙায় ,কমল মজুমদারের গল্প সমগ্র, মঁপাসা রচনাবলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলাম ইত্যাদি।
নির্বাচিত কলাম আমাদের চারবন্ধুকে কলকাতা থেকে এনে দিয়েছিলেন পরিতোষবাবু। তিনি তো ক্লাসে নানান বই পড়তে বলতেন। ঐ বইটি পড়ার কথা বলতেই আমরা স্যারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। স্যারকেই দায়িত্ব নিতে হয় আমাদের বই এনে দেওয়ার। কলেজ স্ট্রিট থেকে এনে দেন। সদ্যপ্রকাশিত বই পেয়ে আর কলামে নিহিত বক্তব্যে টগবগ করে ফুটতে থাকি আমরা-আমি,চৈতালী,বন্দনা আর তনুজা। বইটি পড়ার পর ১৯৯২ এর ২৩ সেপ্টেম্বর রাত্রি সাড়ে বারোটায় ‘তসলিমা নাসরিন’ শিরোনামায় একটি কবিতা লিখি। যা আজো ডায়েরির পাতায় বন্দি। সেদিনের উনিশ বছর বয়সীর যে সাহস হয়নি আজ পঞ্চাশ পূর্ণ করা সালেহা তাকে মুক্তি দিচ্ছে আত্মকথায় –
তসলিমা নাসরিন
নারী দলের অগ্রপথিক
তসলিমা নাসরিন,
তুমি মোর প্রাণে
বাজিয়ে দিলে এ কোন বিন?
এতোদিন যত সব অত্যাচার
ভদ্রতার খাতিরে করেছি সহ্য,
তা সবই আর করবো না গ্রহণ
যতই যে যাই বলুক ও নষ্ট চরিত্র।
রাস্তাঘাটে চলতে গেলে
দেখি লোভী কামনাতুর চোখ,
এখন তাদের অভিশাপ দিই
তোমাদের চির অন্ধত্ব হোক।
বাসে ট্রেনের পাপ পঙ্কিল
সে সব লম্বা হাত
ভেঙে হোক চূর্ণ চূর্ণ
করবো এ অভিসম্পাত।
আমায় বলতো সবাই
অতি ভালো মেয়ে,
এখন জুটেছে অভিধা
বুড়ো ধাড়ি বেপর্দা মেয়ে।
আমি শুধু বলি কত কাল
আর কাটাবে বাজে কথা কয়ে?
ধর্মের শৃঙ্খল পায়ে পরিয়ে
রেখেছিলে অন্ধকার অন্তঃপুরে।
আজ আমি বন্ধনমুক্ত
করলে তাড়া পথের মাঝে
রুখে দাঁড়াবো উদ্ধত ভঙ্গীতে
করবো প্রতিবাদ।
দেখব তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
তোমাদের আছে কোন ফাঁদ?
বাইরের লোকে ভাবছে এখন
এ মেয়ের কেন এই পরিবর্তন?
উত্তরে বলি তসলিমা নাসরিন
এর একমাত্র কারণ।
0 Comments