জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা বাঙালি পদার্থবিদ ড. বিভা চৌধুরী/ পর্ব-৩/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৮৭
বিভা' – অন্য আকাশের তারা — ০৩

প্রথম মহিলা বাঙালি পদার্থবিদ ড. বিভা চৌধুরী 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


১৮৯৮ সালের ঘটনা। প্রেসিডেন্সি কলেজের গবেষণাগারে একজন প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক তখন নিজের গবেষণার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। এমন সময় একখান চিঠি এসে পৌঁছল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর এতিহ্যবাহী ল্যাব-এ। বর্ষীয়ান বৈজ্ঞানিকের নামে চিঠি। আসলে চিঠি নয়, আস্ত একখানা চার্জশিট। চার্জশিটের বয়ান বেশ কড়া। রূঢ় তার ভাষা। অপমান জনক এর বক্তব্য। চার্জশিটের ছত্রে ছত্রে এক অলিখিত হুকুম। কৈফিয়ৎ তলব-নামা। খোদ বৈজ্ঞানিকের বিপক্ষে দোষারোপের একগুচ্ছ ফিরিস্তি। খাম থেকে চিঠিখানা বাইরে বের করে পড়া শুরু করলেন প্রৌঢ়। আংশিক পড়েই তাঁর ঝাপসা চোখ। সম্মুখে স্থির দৃষ্টি। অস্থির মনের ভেতরে দারুণ তোলপাড়। তীব্র দোলাচল। সময় বয়ে চলে। তখনও পড়া শেষ হয়নি। তাঁর হাতে ধরা আছে পত্রখানি। আনমনে গবেষণাগারে কাষ্ঠবৎ দণ্ডায়মান প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক। তাঁর মুখ চোখ গাল রাগে রাঙা। অপমানে ঘৃণায় ক্ষোভে গরগর করে গোটা শরীর। চিবুক খানি শক্ত হল ক্ষণিকে। চোয়ালের অস্থি ওঠানামা করে। অথচ, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ কিংবা আওয়াজ বের হয় না। মাথা নাড়লেন পণ্ডিত। নাহ! এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। মনে মনে তাঁর কঠোর সংকল্প। এই অপমানের সঠিক জবাব সুদ সমেত ফেরত দেবেন সময় হলে। আপাতত চুপচাপ থাকাই শ্রেয়। উত্তর না দেওয়াই বুদ্ধি মানের কাজ। একদিন কড়া ভাষায় মোকাবিলা করবেন শ্বেতাঙ্গ অধ্যক্ষের নাক উঁচু স্বভাব, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও চরম অবহেলা। চাঁচাছোলা ভাষায় ফিরিয়ে দেবেন অপমানের কঠোর জবাব। সকল প্রত্যুত্তর। সেদিন হয়তো ক্ষণিকে ভেঙে পড়বে চিরাচরিত বিদ্যায়তনিক সম্পর্কের বেড়াজাল; ঠুনকো প্রাচীর।

ঘটনা কী? কে সেই বিজ্ঞানী যাকে অপমানের দুঃসাহস দেখায় প্রিন্সিপাল? এমন কী ঘটনা ঘটল যে প্রৌঢ় বৈজ্ঞানিক পর্যন্ত তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন? 
       
ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালে (১৮৪২ – ১৯১৯) তখন সারা বিশ্বের সমীহ আদায় করা এক নাম। ফিজিক্স ও গণিতে রীতিমতো পণ্ডিত ব্যক্তি। র‍্যালে বিচ্ছুরণ তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কার। আকাশের রঙ নীল কেন? সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের সময় আকাশ কেন রাঙা হয়ে ওঠে? শহরের ট্রাফিক সিগন্যালে কিংবা রেল ক্রসিং-এ লাল আলোর বিপদ সিগন্যাল কেন ব্যবহৃত হয়? এমন আরও একগুচ্ছ প্রাকৃতিক ঘটনার মূলে যে-থিওরি, তা হল র‍্যালে বিচ্ছুরণ। যদিও ১৯০৪ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন নিস্ক্রিয় আর্গন মৌল আবিষ্কারের সৌজন্যে। এ হেন পণ্ডিত মানুষটি একবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার রাজধানী সিংহল বেড়াতে এসেছিলেন। সেখান থেকে তাঁর ইংল্যান্ড ফিরে যাবার কথা। কিন্তু লর্ড রিপন-এর আহ্বানে ফেরার পথে দিন কয়েক কলকাতায় ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক। একদিনের ঘটনা। বলা নেই, কওয়া নেই, আমন্ত্রণের বালাই নেই; আচমকা তিনি হাজির আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮ – ১৯৩৭)-এর ল্যাবরেটরি দর্শন হেতু। তাঁকে সশরীরে উপস্থিত দেখে যারপরনাই বিস্মিত জগদীশচন্দ্র। ল্যাবের চারপাশ ঘুরে দেখে লর্ড র‍্যালে দারুণ মুগ্ধ। মুগ্ধতা তাঁর চোখে মুখে লেপ্টে আছে সারাক্ষণ। মুখের দিকে তাকালেই তা টের পাওয়া যায়। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর প্রশংসায়‌ পঞ্চমুখ ভদ্রলোক। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে জগদীশচন্দ্র বসুর ল্যাবরেটরি‌‌ ব্যবস্থাপনায় খুব খুশি। খুশি খুশি মনে ল্যাব পরিদর্শন করে তিনি ফিরে গেলেন। 
        
ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালে'র প্রেসিডেন্সি কলেজে আগমনের সংবাদ কলেজে রটে গেল মূহুর্তে। খবর গেল কলেজের অধ্যক্ষের কানে। ব্যাস, তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। যথারীতি রেগে মেগে কাঁই। লোহিত তপ্ত কড়াইয়ে সিঞ্চিত জলকণা যে রূপ সশব্দ আর্তনাদ সহকারে নিমেষে হাওয়ায় মিলিত হয়, কলেজের অধ্যক্ষের তেমনই অনুরূপ দশা। লর্ড র‍্যালে ফিরে যেতে না যেতেই সেদিন বিকেল থেকে শুরু হল নাটক। নাটক নয়, কলেজের অধ্যক্ষের কেরামতি। এদেশীয় বিজ্ঞানীর প্রতি বিমাতাসুলভ নোংরা আচরণ। সায়েন্টিস্ট জগদীশচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে লম্বা একখান চার্জশিট দাখিল করলেন অধ্যক্ষ। কড়া ভাষায় কৈফিয়ৎ তলব করে বসলেন তিনি — 
কলেজের অনুমতি ছাড়া লর্ড র‍্যালে'র মতো একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে কেন তিনি ল্যাবরেটরিতে নিয়ে আসেন? 
এ তো প্রচ্ছন্ন হুমকি! এমন ঘটনায় জগদীশচন্দ্র বসু খুবই অপমানিত বোধ করেছিলেন সেদিন। এমনকি, এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্য তীব্র প্রতিবাদও করেছিলেন। প্রতিবাদের ফল আরও মারাত্মক হল। পদে পদে বৈজ্ঞানিকের গবেষণায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলে কলেজ কর্তৃপক্ষ। শেষমেশ বিজ্ঞানী মনস্থির করলেন — নিজ তত্ত্বাবধানে এমন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তিনি তৈরি করবেন যেখানে ভারতীয় বৈজ্ঞানিকগণ স্বাধীন ভাবে নির্দ্বিধায় রিসার্চের কাজ করতে পারবেন। তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, যিনি আদর করে বিজ্ঞানীকে 'ব্রায়ান' নামে সম্বোধিত করতেন। স্কটিশ শব্দ 'ব্রায়ান'-এর বাংলা অর্থ 'খোকা'। ভগিনী নিবেদিতা আজীবন জগদীশচন্দ্রকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। 

তারপর উনিশটি বসন্ত পেরিয়েছে। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ঘোলা জল। কিন্তু গঙ্গা নোংরা হয়নি কোনোদিন। বরং তার কদর বেড়েছে দিনকে দিন। বন্ধু হয়েছে একমুখী সময়। খরস্রোতা নদীর মতো আপন নিয়মে বয়ে চলেছে কারও অপেক্ষা না করে। ইতিপূর্বে ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন বৈজ্ঞানিক। কিন্তু বিস্মৃত হননি নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। অপমানের গল্প। অবসরের পর দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন গবেষণাগার ভারত গড়ার লক্ষ্যে। এ ব্যাপারে বছর কুড়ি আগে, ১৮৯৬-তে তাঁর প্রাণের বন্ধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনা সেরে রেখেছিলেন তিনি। যদিও নানান রকম জটিলতায় বৈজ্ঞানিকের সে-স্বপ্ন তখন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তারপর এল সেই সন্ধিক্ষণ। 
       
সালটা ১৯১৭। সাকার হল বিজ্ঞানীর দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন। প্রতিষ্ঠিত হয় বোস ইনস্টিটিউট। বসু বিজ্ঞান মন্দির। এ হেন প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ভারতের প্রাচীনতম ও অন্যতম প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটা। প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তনের সময় থেকে প্রথম কুড়ি বছর পরিচালক পদে বহাল ছিলেন স্বয়ং বৈজ্ঞানিক। ১৯৩৭ সালে তাঁর অকাল প্রয়াণের পর প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যভারের হাল ধরলেন তাঁর সুযোগ্য ভাগ্নে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক ড. দেবেন্দ্রমোহন বসু। ওই একই সময়ে বিভা চৌধুরী তরুণী গবেষক হিসেবে বসু বিজ্ঞান মন্দির জয়েন করেন। এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! তরুণী গবেষকের সুপ্ত ইচ্ছে সাকার হওয়ার দারুণ সুযোগ। অযাচিত ভাবে এসে গেল সে সুযোগ। কী সেই ইচ্ছা? প্রফেসর দেবেন্দ্র মোহন বসুর অধীনে তরুণী বিভা চৌধুরীর গবেষণার স্বপ্ন, যা অচিরেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল প্রিয় অধ্যাপক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে। অথচ, বসু বিজ্ঞান মন্দিরে জুটে গেল সেই অভাবনীয় সুযোগ। ওদিকে, বিভা চৌধুরীর অধ্যবসায়, গবেষণার প্রতি নিষ্ঠা ও ভালোবাসা দেখে গাইড দেবেন্দ্র মোহন বসু আপ্লুত। শুরু হল দুজনের যৌথ গবেষণা। জোর কদমে চলছে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে কাটা ছেঁড়া। পরীক্ষা নিরীক্ষা। সংগৃহীত তথ্য অনুসন্ধান। বিশ্লেষণ।

দুই

যত দূর দৃষ্টি যায়, দিকচক্রবাল জুড়ে শুধু বরফ আর বরফ। বরফের পুরু চাদরে ঢেকে রয়েছে চরাচর। থেকে থেকে ধবল গিরিশৃঙ্গগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একাকি, নিঃসঙ্গ ও স্থবির। স্ফটিক স্বচ্ছ পাহাড় চূড়ায় যখন দিনের প্রথম সৌর কিরণ পড়ে, চূড়া থেকে ঠিকরে বের হয় আলোকের দ্যুতি। সোনালী আলোয় ঝলমল করে বরফ চূড়া। যেন স্বর্গ নেমে আসে মর্তের মাটিতে। সে এক অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। চোখ জুড়িয়ে যায়। নীচে পাহাড়-কোলে খেলা করে বেড়ায় সম্পুরক মেঘগুলি। হাট করে খোলা বিমনা জানলা কিংবা উদাসী দরজা দিয়ে তারা ফুরুৎ করে কখন যে ঢুকে পড়ে গৃহস্থের ঘরের ভেতর! নিমেষে ভিজিয়ে দিয়ে যায় ঘরদোর, চেয়ার, টেবিল, সোফা, পর্দা, এমনকি উঠোন ইত্যাদি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধূমায়িত বাষ্পগুলো নেচে নেচে পাহাড়ের গা বরাবর আরও যখন উপরে উঠে আসে, ঘুরে বেড়ায়, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে মাঝে মধ্যে; নরম বৃষ্টির জলে ভেজা পাহাড়ের গায়ে গায়ে সাপের মতো আঁকা বাঁকা নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তাগুলো তখন সপাটে জাপটে ধরে থাকে পাহাড়কে। বৃষ্টি ভেজা রাস্তার দুপাশে সারি সারি পাইনের ঘন জঙ্গল। নাম না জানা অর্কিড আর বনফুলের সমাহার পথের শোভা‍ বাড়ায়। মনের ক্লান্তি দূর হয় নিমেষে। চলতে চলতে কদাচিৎ দেখা মেলে সুন্দর সাজানো গোছানো পাহাড়ী গ্রামগুলি। পাহাড়ের ধাপে ধাপে থরে থরে সাজানো রয়েছে গ্রামের ঘরবাড়ি। নিপাট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন উঠোন, বারান্দা ও ব্যালকনি। বেশিরভাগ বাড়িই হয় হোম-স্টে অথবা পর্যটকদের রাত্রি যাপনের অব্যর্থ ঠিকানা - হোটেল। হোটেলের রুম থেকে কিংবা ব্যালকনির আরামকেদারায় অলস শরীর এলিয়ে দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও এভারেস্ট চাক্ষুষ করার আলাদা মজা। বলে বোঝানো দুষ্কর। অনুভব করে নিতে জানতে হয়। আর তা না হলে পাহাড়ে ঘুরতে আসার ষোলআনা মজাই মাটি হয়ে যায়। প্রকৃতির মধ্যে থেকে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে না পারলে, প্রকৃতির রূপ-রঙ-রস-সৌন্দর্য আস্বাদন করতে না পারলে বৃথা এ জীবন। 
🍂
সমুদ্রতল থেকে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় সমতলের চাইতে এমনিতেই বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রাণ আই-ঢাই করে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় আঁকা বাঁকা পাহাড়ী পথ আর গভীর খাদ। রাস্তার একপাশে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে অ-বাক পর্বত। অন্য পাশে হিমশীতল মৃত্যু। এ দুয়ের মাঝে ব্যালেন্স করে চলার নামই পাহাড়ী জীবন। পর্বতদেশে এমনিতেই জনপদের সংখ্যা বেশ কম।  আলাদা তাদের সংষ্কৃতি। জীবন সংগ্রামের নেপথ্য কাহিনী। এ হেন জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গ – নেপাল সীমান্তের দার্জিলিং জেলার সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণীর সবচাইতে উঁচু শিখর — সান্দাকফু। পাশেই রয়েছে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান। বিশ্বের পাঁচটা পর্বত শীর্ষের চারখানা – এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে ও মাকালু'র দেখা মেলে সান্দাকফুর শিখর থেকে। এখান থেকে পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের একখানা প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। অবশ্য সবাই যে পাহাড়ে শুধু বেড়াতে আসে, তা কিন্তু নয়। অনেকে একগুচ্ছ কাজ নিয়ে হাজির হয় পাহাড় চূড়ায়। কেউ কেউ তল্পি তল্পা গুছিয়ে হাজির হয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে। মাসের পর মাস পড়ে থাকে পাহাড়ের চূড়ায়। গভীর রাতে এখানে আকাশের তারাগুলি যেন মাটির আরও কাছাকাছি নেমে আসে। হাত বাড়ালেই একটুকরো আকাশ। ছুঁয়ে দেখা যায় আকাশের দিনরাত্রি ও বারোমাস্যা।
 ‌‌      
সময়টা ১৯৩৮ সাল। সেবছর সান্দাকফু গিরিশিখরে হাজির দুজন। একজন অধ্যাপক - বিজ্ঞানী। অন্যজন গবেষক। প্রথম জন ড. দেবেন্দ্র মোহন বসু। দ্বিতীয় বিভা চৌধুরী। এক-আধ মাসের ব্যাপার না। বহু মাস ধরে সান্দাকফুর ১২ হাজার ফুট ওপরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন তাঁরা। তাঁদের গবেষণার বিষয় ছিল কণা পদার্থবিজ্ঞান ও কসমিক রশ্মি। এ হেন মহাজাগতিক রশ্মির সম্মুখে ফটোগ্রাফিক প্লেট ধরলে কী ঘটবে? বায়ুমণ্ডলে যত উপরে ওঠা যায়, সংশ্লিষ্ট রশ্মির ঘনত্ব তত বাড়ে। পাহাড় চূড়ায় এমনিতেই আকাশ খুব পরিস্কার থাকে বছরের বেশির ভাগ সময়। তায়, বহির্জগৎ থেকে আগত অতিথি রশ্মির সমাহার বেশি। সে সকল রশ্মির সঙ্গে বায়ু কণার মুখোমুখি সংঘর্ষে জন্ম নেয় একগুচ্ছ কণিকা। তাদের অধিকাংশই অজানা। অজ্ঞাত তাদের ঠিকুজি কুষ্ঠি। তাহলে কীভাবে সম্ভব তাদের অস্তিত্ব নির্ণয়? ফটোগ্রাফিক প্লেটের সুক্ষ্ম কায়দায় ধরা পড়বে তারা। সেজন্য পাহাড়ের চূড়া আদর্শ জায়গা। সেখানে স্বভাবতই এক্সপেরিমেন্টের ঢের বেশি সুযোগ। কণাবিজ্ঞানী মাত্রেই এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার মানে হয় না। অগত্যা দুজনের পাহাড়ে আগমন। এই পরীক্ষার আরও দুটি বিকল্প উপায় রয়েছে। এক, কণা-ত্বরক (Particle Accelerator) যন্ত্র উদ্ভাবন। কিন্তু সাব-অ্যাটমিক কণিকার ত্বরিত গতি বাড়ানোর পেল্লাই সাইজের যন্ত্র তখন বিজ্ঞানের এক দূর গ্রহের বিস্ময়। অর্থাৎ, যন্ত্র উদ্ভাবন আপাতত অসম্ভব। বর্তমানে যে যন্ত্র কণাবিজ্ঞানে বিপ্লব এনেছে, অতীতে তা সত্যিই কল্পনাতীত ছিল। দুই, ক্লাউড চেম্বার (Cloud Chamber)। বাংলায় 'মেঘকক্ষ'। অতীতে পরা-পারমাণবিক কণার অস্তিত্ব নির্ণয়ে মেঘকক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। মেঘকক্ষ কী? 
 ‌    
একটি বদ্ধ সরঞ্জামের মধ্যে ইথানল কিংবা অন্য পদার্থের বাষ্পপূর্ণ অবস্থাকে মেঘকক্ষ বলা হয়। এ হেন মেঘকক্ষের মধ্য দিয়ে কোনো উচ্চ শক্তির কণা চলে গেলে জেট বিমানের মত একটা রেখাপথ এঁকে দিয়ে যায়। সেই রেখাপথ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে তার থেকে কণাটির ভর, আধান কিংবা ভরবেগ সংক্রান্ত নানান রকম তথ্য জানা যায়। মেঘকক্ষের বদলে বিভা চৌধুরী প্রথমে ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করেন যেখানে কণার গতিপথ খুব সহজে নির্ণয় করা সম্ভব হত এবং তা অতি দ্রুত অদৃশ্য হওয়ার সমস্যা ও সম্ভাবনাও ছিল না। এরূপ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বিভা ও দেবেন্দ্র মোহন বসু মেসোট্রন এবং মেসন কণিকার ভর, গতিবেগ, আধান ইত্যাদি নির্ণয় করতে সমর্থ হন। তাঁদের দুজনের গবেষণা লব্ধ ফলাফল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত 'নেচার' পত্রিকায় একই শিরোনামে ১৯৪১ এবং ১৯৪২ সালে পরপর দুবছর দুটি আলাদা প্রবন্ধে‌ প্রকাশিত হয়। দার্জিলিং, সান্দাকফু ও ফারি জং পর্বতে ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলো আলাদা আলাদা উচ্চতায় রেখে যথাক্রমে পাই-মেসন ও মিউয়ন কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা। যদিও হাফটোন ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করায় ওই কণাগুলির ভর নির্ণয়ে সামান্য ত্রুটি ছিল। কিন্তু ওই সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ফুলটোন প্লেট সংগ্রহ করার অবকাশ রইল না। সেজন্য ফুলটোন ফটোগ্রাফিক প্লেট সংগ্রহ করে দ্বিতীয় বার নিঁখুতভাবে পরীক্ষা করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। অথচ, তাঁদের দেখানো পথ ধরে ওই গবেষণার প্রায় সাত বছর পরে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ড. সিসিল পাওয়েল (১৯০৩ – ১৯৬৯) উন্নত মানের প্লেট ব্যবহার করে পাই-মেসন ও মিউয়ন কণা আবিষ্কার করেন এবং নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ১৯৫০ সালে। ফলে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানীর বহু আগে এই গবেষণার প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ করেও বিভা চৌধুরী কোনোরকম স্বীকৃতি পাননি। যদিও পাওয়েলের নির্ণীত ভরের সঙ্গে বিভা চৌধুরী ও দেবেন্দ্র মোহন বসুর গবেষণা লব্ধ ভরের অনেক মিল ছিল। তা সত্ত্বেও সম্মান বা স্বীকৃতির কণাটুকু মেলেনি দুজনের ভাগ্যে। (চলবে)

Post a Comment

0 Comments