বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে-১
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব /শুরুর আগে
প্রথম পর্ব
একদিন গোলকধামে স্বয়ং শ্রীহরি বিজন অরণ্যে রাসমণ্ডলে বিহার করছিলেন। তিনি হঠাৎ করে শ্রীরাধিকার সঙ্গ ত্যাগ করে অন্য এক গোপিনীর কুঞ্জে চলে গেলেন। তিনিও শ্রীরাধিকার তুল্য সুন্দরী, নাম বিরজা। সেই বিরজার কুঞ্জে যেয়ে শ্রীকৃষ্ণ শৃঙ্গাররসে মত্ত হলেন। এই খবর রাধিকার সখিরা শ্রী রাধিকাকে জানাতে ক্রোধে তাঁর মুখমন্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করল। তিনি সখীদের আদেশ করলেন তাঁকে বিরজার কুঞ্জে নিয়ে যাবার জন্য। রথ নিমেষে তাঁকে নিয়ে গেল বিরজার কুঞ্জে। কিন্তু সেখানে প্রবেশ নিষেধ। দরজায় প্রহরী আছেন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বস্ত সঙ্গী শ্রীদাম। শ্রীরাধিকা প্রবেশ করবার উপক্রম করতে শ্রীদাম বাধা দিয়ে বললেন "প্রভুর আদেশে এই মুহূর্তে প্রবেশ নিষেধ"। শ্রীদামের সঙ্গে শ্রীরাধিকার সখীদের বাকবিতণ্ডার শেষে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো। একসময়ে তারা প্রবলবেগে কুঞ্জে প্রবেশ করলেন শ্রীকৃষ্ণকে হাতেনাতে ধরবেন বলে। চতুর শ্রীকৃষ্ণ সব বুঝতে পেরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন আর বিরজা শ্রীরাধার ভয়ে যোগবলে দেহত্যাগ করে এক বিশাল নদীরূপে গোলকধামকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হতে থাকলেন। শ্রীরাধিকা কুঞ্জে প্রবেশ করে দেখলেন সেখানে বিরজার পরিবর্তে এক বিশাল নদী প্রবাহিত এবং শ্রীকৃষ্ণ সে স্থান থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছেন। কাউকেই ধরতে না পেরে ক্রোধভরে তিনি নিজের কুঞ্জে ফিরে গেলেন।
নিজের কুঞ্জে ফিরে যাবার পূর্বে যোগবলে শ্রীরাধিকা জানতে পারলেন তাঁর ভয়ে বিরজা নদীরূপে বিরাজমান। বিরজারূপী নদীকে তিনি অভিশাপ দিয়ে বললেন "তুমি চিরকাল এইভাবে নদীরূপে প্রবাহিত হবে"। শ্রীরাধিকা ফিরে যাবার পরে শ্যামসুন্দর পুনরায় ফিরে এলেন বিরজা নদী তীরে এবং বিরজাকে স্বশরীরে দেখতে না পেয়ে সেই শোকে তিনি মানুষের মতো উচ্চৈস্বরে কাঁদতে লাগলেন। ভগবানের ক্রন্দন থেকে সৃষ্টি হলো যত কান্নার রাগিনী। শ্যামসুন্দরের ক্রন্দন শুনে নদীরূপ থেকে বিরজা শ্যামসুন্দরের সম্মুখে পুনরায় আবির্ভূতা হয়ে সিক্ত বসনে কুঞ্জে ফিরে এসে পুনরায় রাসমন্ডলে শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলিত হলেন। সেই সময়ে বিরজা তাঁর প্রতি শ্রী রাধিকার অভিশাপের কথা উল্লেখ করে শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করলেন "প্রভু আপনার সাথে আমার পুনরায় মিলন কিভাবে হবে"? শ্রীকৃষ্ণ তার উত্তরে বললেন "তোমার মন খারাপের কোন কারণ নেই। দ্বাপর যুগে তোমার অংশ থেকে পূণ্যসলিলা যমুনার সৃষ্টি হবে। সেই যমুনা ব্রজভূমির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হবে এবং তখন তুমি প্রতিনিয়তই আমার স্পর্শ পাবে"। উল্লেখ করা যেতে পারে যে মথুরায় কংস কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ করার পরে দৈব নির্দেশে বসুদের যখন যমুনা পেরিয়ে গোকুলে যাচ্ছিলেন নন্দগোপের গৃহে শ্রীকৃষ্ণকে রেখে আসার জন্য সেই সময়ে পূর্বের কথা স্মরণ করে নবজাতক কৃষ্ণ খেলার ছলে যমুনার জলে তাঁর চরণ দুটি স্পর্শ করেন। তারপরে যতদিন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ও মথুরাতে ছিলেন সেই সময়ে প্রতিনিয়তই তাঁর বাল্যলীলার সময় কেটেছে যমুনার তীরে।
🍂
আদি বরাহপুরানে যমুনার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে "গঙ্গা শতগুনো প্রোক্তা মথুরে মম মন্ডলে। যমুনা বিশ্রুতা দেবী নাত্র কার্যা বিচারনা।। তত্র তীর্থানি গুহ্যানি ভবিষ্যন্তি মমানঘে। যেসু স্নাতো নর দেবী মমলোকে মহীয়তে"।। অর্থাৎ আমার মথুরা মন্ডলে গঙ্গা অপেক্ষায় যমুনা শতগুণে গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে তর্ক করা বাতুলতা। যমুনাতে আমার গুহ্য তীর্থসকল থাকবে। যমুনাতে যে স্নান করবে আমার ধামে সে সম্মানিত হবে। আবার পদ্মপুরাণ বলছে "রহো মা পরমাধারঃ সচ্চিদানন্দলক্ষনঃ। ব্রহ্মেত্যুপনিষদ গীতঃ স এবং যমুনা স্বয়ম্”।। অর্থাৎ যিনি সমস্ত আধারের কেন্দ্র সচ্চিদানন্দ স্বরূপ রসময় পুরুষ, উপনিষদে ব্রহ্ম বলে উল্লেখিত, সেই স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যমুনা রূপে বিরাজিত"। আবার অন্য এক পৌরাণিক কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই যন্ত্রদেবতা বিশ্বকর্মার সংজ্ঞা নামে এক কন্যা ছিল, সূর্যদেবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের রাতে সূর্যদেবের প্রচন্ড তাপ সহ্য করতে না পেরে সংজ্ঞা চোখ বন্ধ করেন। এতে সূর্য প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে সংজ্ঞাকে অভিশাপ দিয়ে বলেন তাকে দেখে চোখ বন্ধ করেছেন বলে সংজ্ঞার গর্ভে যে পুত্র হবে সে হবে কৃষ্ণবর্ণ। সূর্যের অভিশাপে চঞ্চলা হয়ে ওঠেন সংজ্ঞা, সেই দৃষ্টিতে সূর্যের দিকে তাকাতেই সূর্য পুনরায় অভিশাপ দিলেন তোমার চঞ্চলতার জন্য তোমার গর্ভে যে কন্যাসন্তান জন্ম নেবে সে চঞ্চলা নদী হয়ে জন্মাবে।যথাসময়ে সংজ্ঞার গর্ভে যম ও যমুনার জন্ম হয়। যমুনা পরে নদী হয়ে যায়।
ভৌগোলিক তথ্য অনুযায়ী হিমালয়ের বন্দরপুঞ্ছ পর্বতের পাদদেশে জন্ম নিয়ে হিমালয়ের পার্বত্য প্রদেশের মধ্য দিয়ে বহু পথ পেরিয়ে যমুনা সমতলে এসে নেমেছে। পথে তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে আরো অনেক নদী। দিল্লি হয়ে যমুনা এসেছে কৃষ্ণের লীলাভূমি মথুরা বৃন্দাবনে। বলা হয় গঙ্গার মতই পুণ্যসলিলা যমুনা। অতীতে যমুনা দিয়ে বইত দুকুল ভাসিয়ে দেওয়া জলস্রোত। তার তীরে ছিল কত ঘাট - যুগল ঘাট, বিহার ঘাট, ইমলি ঘাট, শৃঙ্গার ঘাট, চিরঘাট, কেশী ঘাট ইত্যাদি। বড় বড় নৌকা যেত এই যমুনার প্রবাহপথ ধরে। কালের প্রবাহে যমুনা আজ মৃতপ্রায়। সামান্য জল সেটুকুও শহরের নোংরা আবর্জনায় দূষিত। তবুও পুণ্যার্থীরা সেই জলস্পর্শ করেন, স্নান করেন। তাতেই তারা ধন্য হয়ে যান। এই যমুনা তীরে ভগবান কৃষ্ণ ছাড়াও আরো বহু মনীষী, জ্ঞানীগুণী সাধক এসেছেন সাধনা করতে। তাঁদের সাধনার লীলাখেলা বিচিত্র।
এদিকে বিরজা ও শ্যামসুন্দরের মিলনের খবর পুনরায় শ্রীরাধিকার কাছে চলে গেল। শ্রীরাধিকা ক্রোধে আরক্তিম হয়ে নিজের কুঞ্জে যেয়ে শয়ন করলেন। শ্রীকৃষ্ণের কাছে সেই খবর পৌঁছাতে তিনি শ্রীরাধিকার মানভঞ্জন করার জন্য শ্রীদামকে নিয়ে রাধিকার কাছে যেতে তিনি অভিমান করে বললেন " হরে, এই গোলোকে আমার চেয়ে তোমার অনেক সুন্দরী কান্তা আছে। তুমি আমাকে ছেড়ে তাদের কাছে যাও। আমার কাছে তোমার কি প্রয়োজন? আমার ভয়ে তোমার প্রিয়তমা কান্তা বিরজা নদীরূপে দ্রব হয়ে যেতে তুমি তার কাছে পুনরায় গেলে। বেশতো নদীর সাথে নদের উত্তম মিলন হবে। অতএব তুমি নদ হয়ে তার সাথে কেলি কর। হে শঠচূড়ামনি কৃষ্ণ, অবিরত তুমি মানবী সংস্পর্শে আনন্দ লাভ কর। আমার অভিশাপে তুমি গোলোকধাম থেকে পৃথিবীতে যেয়ে মানবযোনিতে জন্মগ্রহণ কর, তোমার মতো ধূর্তের আমার কুঞ্জে আসার কোন প্রয়োজন নেই"।
শ্রীদাম এতক্ষণ কুঞ্জের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে শ্রীরাধিকার অভিশাপ বাণী শুনে উত্তেজিত হয়ে ভাবলেন - কি স্পর্ধা এই নারীর। জগত সৃষ্টিকারী স্রষ্টার স্রষ্টাকে অভিশাপ দিলেন তিনি। শ্রীরাধিকাকে শ্রীদাম বললেন " মা ব্রহ্মা, শঙ্কর, ধর্ম, অনন্তদেবের স্রষ্টা আত্মারাম, পূর্ণব্রহ্ম সেই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তোমার এই আচরণ অত্যন্ত গর্হিত। যাঁর সেবার জন্য তুমি দেবীগনের প্রধানা সেই শ্রীকৃষ্ণকে তুমি আজও চিনতে পারলে না। যিনি নিমেষে তোমার মত কোটি কোটি রাধার সৃষ্টি করতে পারেন, বৈকুন্ঠে স্বয়ং মা লক্ষী যাঁর পদ সেবা করেন, দেবী সরস্বতী যাঁকে স্তবের দ্বারা চতুর্বেদে বন্দনা করেন, চতুর্বেদে যাঁর মহিমা কীর্তন সেই সর্ব কারণের কারণ শ্রীকৃষ্ণকে তোমার এই অবহেলা অমার্জনীয় অপরাধ"।
0 Comments