জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সুশোভন সরকার /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সুশোভন সরকার
নির্মল বর্মন 

ভারতের ভারতীয় বাঙালি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও ইতিহাসের কিংবদন্তি অধ্যাপক সুশোভন সরকার মহোদয়ের খ্যাতি, যশ, ও শ্রদ্ধা বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখির জন্য। কিংবদন্তি পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলান বিশের কনিষ্ঠ ভগিনী রেবা সরকারের সঙ্গে সুশোভনের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলশ্রুতি স্বরূপ কন্যা শিপ্রা সরকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পুত্র সুমিত সরকার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ।
প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য সম্পন্ন ঐতিহাসিক হিসেবে অধ্যাপক সুশোভন সরকার উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগসূত্র বিশ্লেষণাত্মক  দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে বাংলা তথা সারা বিশ্বে  সাড়া ফেলেছিলেন।
       প্রাবন্ধিক সুশোভন সরকারের পিতা সুরেশ চন্দ্র সরকার বিহার উড়িষ্যার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সময় পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে ১৯০০ সালের ১৯শে আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। যদিও আসল বাড়ি দক্ষিণ 24 পরগনার ডায়মন্ড হারবারের সরিষাতে। অধ্যাপক সরকার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাস বিষয়ে বি.এ ও এম.এ পাশ  করে ১৯২৩-২৫ এ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯২৫ শে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক(লেকচারার )হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯২৯ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার পদে নিযুক্ত হন । ১৯৩৩ এ প্রেসিডেন্সি কলেজে  আসেন। ১৯৫৬ তে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর 1956 থেকে 1961 যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯২৬ থেকে১৯ ৩৬ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। প্রাবন্ধিক সুশোভন সরকার ৮২ বছর বয়সে ১৯৮২ সালের ২৬ শে আগস্ট কলকাতাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
            প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সুশোভন সরকার পরিচয় পত্রিকাগোষ্ঠীর বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। "বিজন রায়" ছদ্মনামে শুশোভন বাবু, প্রথম সংখ্যা থেকে লেখেন 'রুশ বিপ্লবের পটভূমিকা'। অসিত সেন ছদ্মনামে "নোটস অন দ্যা বেঙ্গল রেনেসাঁস", "বাংলার ইতিহাসের ধারা" ইত্যাদি লিখেছেন। এছাড়াও প্রাবন্ধিকের রচিত গ্রন্থ হল:-
   "প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ , ইতিহাসের কথা, বিখ্যাত।

              অধ্যাপক সুশোভন সরকার মহোদয়ের 'ইতিহাসের কথা' গ্রন্থের অন্যতম প্রবন্ধ 'আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার'। এই প্রবন্ধে দেশের রাষ্ট্রনৈতিক চেতনার স্বরূপ কেমন সে বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। পরাধীন  ভারতের রাষ্ট্রিক চেতনার নতুন ধারা যেভাবে বিকশিত হচ্ছে -- তার চারটি মূল আদর্শের প্রতি প্রাবন্ধিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন -- উদাহরণস্বরূপ 'ফ্যাসিস্ট বিরোধী মনোভাব', 'সমাজবাদ', 'ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা', 'সমস্ত ভারতীয় জনগণের স্বাধীনভাবে নিজেদের সংগঠিত করবার অধিকার' ও 'আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার'।
🍂

       প্রাবন্ধিক সুশোভন সরকার ভারতবর্ষে একজাতীয়ত্ব ও বহুজাতীয়ত্ব বিষয়ে নিম্নলিখিত আলোচনার ক্রম বিবেচ্য:--
এক. 'অনেকে মনে করে যে, একজাতীয়ত্বের  আদর্শ ছিল প্রগতির কথা, আর বহুজাতীয়ত্বের ধারণা হবে প্রতিক্রিয়ার বাহন। আমার মনে হয়, এই বিশ্বাসের মূলে আছে চারটি অমূলক ভয়'-এক.--- "ভারতবর্ষে এক নেশন বলে গণ্য না হলে স্বাধীনতা আসবে না"। দুই. ---- "স্বাধীন ভারতবর্ষ খন্ড খন্ড হয়ে আর্থিক ও সামরিক শক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়বে"। তিন. --- "ভারতীয় ফেডারেশন স্থাপিত হলেও দুর্বল হয়ে পড়বে"।
চার.--- "দেশের কোনো কোনো অংশ বিদেশীদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে পারে"।
দুই. এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক সুশোভন সরকারের যুক্তিনিষ্ঠ  অভিমত হলো--
১."হিন্দু-মুসলমান সমস্যা আমাদের উদভ্রান্ত করে, কিন্তু ভারতের সকল জাতির সমানভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নিলে হিন্দু মুসলমান সমস্যার সমাধান অনেক সহজ হয়ে আসবে"।
২."অখন্ড ভারতের যুক্তি যেমন অচল, খন্ডিত ভারতের চিন্তন অটল আদর্শও তেমনি দুর্বল"।
৩."জাতির বর্তমান কর্তব্য নির্ধারণ, ভবিষ্যতে  তার পথ নির্দেশ, জাতির স্বাধীনতা ইচ্ছা এবং তার নিজস্ব বিচারবুদ্ধির উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত । আত্ম- নিয়ন্ত্রণের অধিকারের মূল কথা হলো এই"
৪. তাই প্রাবন্ধিকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত--
      " রুশ দেশে যেমন জাতি-  সমস্যার এইভাবে সমাধান এসেছে, এদেশেও তেমন সমাধান সম্ভব মনে করা অসঙ্গত নয়"।
প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সুশোভন সরকার মহোদয়ের প্রবন্ধের ঠাসবুননের মাধ্যমে যুক্তি, উদাহরণপ্রবণতা,ইতিহাস সচেতনতা এবং সর্বোপরি ভারত ইতিহাসের সম্ভাবনা সম্বন্ধে অধ্যাপক সরকারের বক্তব্য প্রবন্ধ তথা ভারতবাসীকে দিয়েছে আস্বাদ্যমানতা।

Post a Comment

0 Comments