বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৮৮
প্রথম মহিলা বাঙালি পদার্থবিদ ড. বিভা চৌধুরী
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
হাফটোন আর ফুলটোন-এর মধ্যে পার্থক্য কত? শুধু কি শূন্য দশমিক পাঁচ (০.৫) তফাৎ? আসলে হাফটোন আর ফুলটোন-এর মধ্যে পার্থক্য কেবল মাত্র অর্ধেক (০.৫) নয়; আস্ত একখানা গোটা নোবেল পদকের সমান তফাৎ। হ্যাঁ, বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরীর নোবেল পুরস্কার পাওয়া আর না পাওয়ার মাঝে গোটা একটা বিশ্বযুদ্ধ এবং হাফটোন - ফুলটোন ফটোগ্রাফিক প্লেটের গঠনগত ত্রুটি অনেকাংশে দায়ী ছিল। বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিদেশ বিভুঁই থেকে ফুলটোন ফটোগ্রাফিক প্লেট সংগ্রহে ভাটা পড়ে যাওয়াই কাল হল। ফুলটোন প্লেটের অপর্যাপ্ত জোগানের দরুন হাতছাড়া হয়ে যায় নোবেল পদক। অথচ সাত বছর বাদে গবেষণা শুরু করে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী সেসিল পাওয়েল ফুলটোন ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার সহ আরও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে বিভা চৌধুরীর দেখানো পথে পাই-মেসন ও মিউয়ন পার্টিক্যালের ভর, আধান, বেগ ইত্যাদি তথ্য আবিষ্কার করে ১৯৫০ সালে ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
ফুলটোন ফটোগ্রাফিক প্লেট অপ্রাপ্তির সঙ্গে উপরি পাওনা বিভা দেবীর জীবনে যুক্ত হয়েছিল আর এক মনখারাপের গল্প। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ। দীর্ঘ সাত বছরের বেশি সময়। এত সময় বসু বিজ্ঞান মন্দিরে বৈজ্ঞানিক অধ্যাপক ড. দেবেন্দ্রমোহন বসু'র অধীনে তাঁর গবেষণা! তারপরেও অধরা রইল বিভা চৌধুরীর সাধের ডক্টরেট ডিগ্রি। কারণ আজও ঘন মেঘে ঢাকা। কালো মেঘ সরিয়ে সত্যিকারের চাঁদের আলো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঘন কুয়াশায় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সে-ইতিহাস। অগত্যা উপায় কী? সহজ সমাধান – একজন নারীকে স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি দিতে হল পাশ্চাত্য দেশে। এমনই ছিল বিভা দেবীর আকাশ। তাঁর অনভিপ্রেত কর্মফল।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ। সদ্য বিশ্বযুদ্ধের যবনিকাপাত ঘটেছে। সাময়িক শান্ত হয়েছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবী। শান্তির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে দিকভ্রষ্ট মানুষ-দেশ-জাতি-সমাজ। দলে দলে ঘরে ফিরছে সৈনিক। অপরদিকে, বিভা চৌধুরীর লক্ষ্য স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট-এর মহাজাগতিক রশ্মি গবেষণাগার। ল্যাবটি গ্রেট ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে শহরে অবস্থিত। সেবছর বিভা দেবী ম্যানচেস্টার শহরে চলে এলেন। সেখানে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে কসমিক রশ্মি নিয়ে গবেষণারত স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট (১৮৯৭ – ১৯৭৪)-এর অধীনে কাজ শুরু করলেন তিনি। বিস্তৃত বায়ু ঝর্ণা (Extensive Air Showers) নিয়ে গবেষণায় ডুবে গেলেন গভীর ভাবে। তাঁর রিসার্চের গাইড তখন স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট। স্যার প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট এক নতুন ধরনের মেঘকক্ষ বা ক্লাউড চেম্বার উদ্ভাবন করেছেন। সেই মেঘকক্ষে রয়েছে বিশেষ ধরনের একটি গিগার কাউন্টার, যা স্বতন্ত্র কণিকার প্রতি অত্যন্ত বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল। এ হেন মেঘকক্ষ ব্যবহার করে বিভা দেবী লিখলেন একখানা জবরদস্ত রিসার্চ থিসিস। গবেষণা পত্রের শিরোনাম "অনুপ্রবেশকারী পার্টিক্যালের সঙ্গে যুক্ত বিস্তৃত বায়ু ঝর্ণা" (Extensive Air Showers associated with Penetrating Particles)। সময়টা ছিল ১৯৪৯ সালে গোড়ার দিককার ঘটনা। গবেষণা পত্রটি ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির রিসার্চ সেকশনে জমা করে দেশের বিমান ধরলেন তিনি। স্বদেশে ফিরে এসে তাঁর নিস্তার নেই।
হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা (১৯০৯ – ১৯৬৬) সেই যে বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এলেন, যুদ্ধের কারণে তাঁর আর ইউরোপে ফেরা হলো না। রয়ে গেলেন স্বদেশে। স্বদেশে শুরু হল তাঁর স্বপ্নের উড়ান। দেশ গড়ার ভাবনা। স্বাধীনতা পরবর্তী দাঙ্গা বিধ্বস্ত দেশে বিজ্ঞান গবেষণার জোয়ার শুরু মূলত তাঁর হাত ধরেই। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান (Tata Institute of Fundamental Research)। সংক্ষেপে, TIFR। সেসময় TIFR-এর জন্য তিনি তরুণ বিজ্ঞানী খুঁজছেন। অনুসন্ধান চালিয়ে ড. জন জি. উইলসন-এর দ্বারস্থ হলেন হোমি ভাবা। উইলসন-এর নিকট তরুণী গবেষক বিভা চৌধুরীর খোঁজ পেলেন। বিশেষ করে বিভা চৌধুরীর আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে মতামত জানতে চেয়েছিলেন তিনি। আসলে জন উইলসন ছিলেন বিভা চৌধুরীর ডক্টরেট পেপারের পরীক্ষক। তাঁর ছিল জহুরীর চোখ। ভবিষ্যতের সত্যিকারের উজ্জ্বল তারাকে চিনে নিতে ভুল করেনি তাঁর তীক্ষ্ম দৃষ্টি। জন উইলসন-ই মূলত হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা'কে পরামর্শ দেন TIFR-এ বিভা চৌধুরীকে নিয়োগ করতে।
হায়রে নিয়তি! একজন নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কী যন্ত্রণা! জীবন সংগ্রামে প্রত্যক্ষ হল ঘোর যুদ্ধফল। অন্যের সুপারিশের উপর নির্ভর করতে হয় একজন মহিলা বৈজ্ঞানিককে, তাঁর মানদণ্ড নির্ধারণে।
দুই
ব্রিটেন ফেরত বিভা দেবী ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে যোগদান করলেন টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর সেখানেই কর্মরত ছিলেন। টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে তিনিই সবার প্রথম মহিলা গবেষক। TIFR-এ তিনি মুক্তির স্বাদ পেলেন প্রথম বার। একক স্বাধীন গবেষণার অধিকার। এ হেন মৌলিক দায়িত্ব একজন নারী গবেষকের জীবনে বিরল অভিজ্ঞতা। তাঁর মুক্ত চিন্তার খরস্রোতা নদী আপন নিয়মে বইতে শুরু করল TIFR-এ। তাঁর একক উদ্ভাবনী ক্ষমতা গবেষণা ফিল্ডে এক অনন্য নজির গড়ল। একজন নারীর উচ্চ শিক্ষায় তাঁর কীর্তি এক অসাধারণ মাইলস্টোন। তিনি একের পর এক কৃতিত্ব অর্জন করে দেখালেন TIFR-এ।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ। কাউন্টার হডোস্কোপ ব্যবস্থার দ্বারা বিভা দেবী এমন কণার অস্তিত্ব টের পেলেন যে ওই কণিকা দুই বা তার বেশি বায়ু ঝর্ণা তৈরি করতে সক্ষম। তাঁর এই গবেষণার ফলাফল ক্লাউড চেম্বার অথবা মেঘকক্ষ ব্যবহার করে অন্যান্য বিজ্ঞানী পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত করেছেন।
এত সব পরীক্ষা নিরীক্ষার মাঝে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ভাবনা উদাস হয়। মনখারাপের কারণ তখনও অধরা ডক্টরেট ডিগ্রি। রিসার্চ থিসিস জমা পড়েছে সেই বছর তিনেক আগে। এখনও অব্দি তার খবর নেই। কবে আসবে সুখবর? শেষমেশ এল সেই ক্ষণ। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি এল শুভ সংবাদ। ডক্টরেট উপাধি লাভ করলেন বিভা চৌধুরী। আজ থেকে তাঁর নামের আগে জুড়বে 'ডক্টর'। ড. বিভা চৌধুরী। সেবছর আরও এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। আমেরিকার ম্যানচেস্টেরে একটি স্থানীয় পত্রিকা "দ্য ম্যানচেস্টের হেরাল্ড"। এ হেন পত্রিকায় ছাপা হল তাঁর গবেষণা কর্ম ও একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল "Meet India's New Scientist — She has an eye for cosmic rays"। সাক্ষাৎকারের বিষয় ছিল সমসাময়িক সময়ে মেয়েদের বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা। সেই সম্পর্কে আলোচনা সারতে গিয়ে বিভা দেবী মন্তব্য করেন –
"মেয়েরা পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে আতঙ্কিত – এটাই সমস্যা। এটি খুবই দুঃখজনক যে আজ আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক মহিলা পদার্থবিজ্ঞানী রয়েছেন।"
তিনি আরও যোগ করেন — "ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডে যে কয়েকজন পদার্থ বিজ্ঞানবিদ আছেন এক হাতের আঙ্গুলে তাহা গণনা করা যায়। নারীরা রসায়ন শাস্ত্রের প্রতি বেশী ঝুঁকিয়া পড়েন। পদার্থবিজ্ঞানের জন্য অঙ্ক শাস্ত্রের উচ্চতর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সম্ভবতঃ এই কারণেই পা বাড়ান না এবং এই জন্যই নারীরা পদার্থবিজ্ঞানে ভয় করিয়া থাকেন।"
টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকাকালে বিদেশ ভ্রমন করেছেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একজন পরিদর্শন প্রভাষক হিসেবেও তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল। পরের বছর ইতালির পিসা'য় অনুষ্ঠিত হয় প্রাথমিক কণিকা সম্পর্কিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সেই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন ড. বিভা চৌধুরী এবং প্রফেসর সুকুমার বিশ্বাস। ১৯৫৭ সালে টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিভা দেবীর সম্পর্ক ছিন্ন হল। সেবার TIFR অবসর নিয়ে অল্প সময়ের জন্য তিনি কলকাতায় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে গবেষণা শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি আমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে গবেষণার জন্য চলে এসেছিলেন। সেসময় ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিরং ডিরেক্টর ছিলেন ভারতের মহাকাশ গবেষণার পথিকৃৎ বিক্রম সারাভাই। মূলত তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেন বিভা দেবী। (চলবে...)
🍂
0 Comments