বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সরোজ আচার্য
নির্মল বর্মন
"হে ধরণী, কেন প্রতিদিন
তৃপ্তিহীন
একই লিপি পরও ফিরে ফিরে
এ বড় কঠিন প্রশ্ন?
সাহিত্য সমালোচনার সূত্র সন্ধান করতে গিয়ে যুগে যুগে অনেকেই তো লেখা হলো আরো অনেক হবে। তবুও তৃপ্তি নেই। সৃজন রহস্যের সবকিছু জানা হয়েছে। বেশ সাজানো গোছানো সব তৈরি করা গেছে এখন কথা বলবার মতো মূঢ় দু:সাহস নেই"। সরোজ আচার্য
প্রাবন্ধিক সরোজ আচার্য মার্কসীয় রাজনীতি তে বিশ্বাসী, সমাজ মনস্ক ও সাহিত্যিক প্রবন্ধ বহু লিখেছেন । সাহিত্যিক সরোজ আচার্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক নেতা ছিলেন। আচার্য সাহেবের মার্কসীয় দর্শনেও অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল । সরোজ আচার্য ১৯০৬/১৯০৭ এ জন্ম ! অধুনা বাংলাদেশের কুষ্ঠিয়াতে। অল্প বয়স থেকেই রাজনীতিতে আকৃষ্ট এবং রুশ বিপ্লবের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ ঘটেছিল । তাই ব্রিটিশ সরকার সরোজ বাবুকে দুটি বিভিন্ন ধারায় গ্রেপ্তার করার পর বক্সা ও দেউলি শিবিরে আটক করে রাখে। প্রাবন্ধিক সরোজ আচার্য বন্দী জীবনেই ইংরেজি ভাষায় এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন। জেল থেকে
মুক্তি পেয়ে কিছুদিন অধ্যাপনা করেছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে সহ-সম্পাদক হিসেবে 'হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকায় যোগ দেন ও পরে আনন্দবাজার পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক হন।১৯৬৮/১৯৬৯ এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
🍂
প্রাবন্ধিক সরোজ আচার্য'র রচিত গ্রন্থগুলি হল : --
"নব্য রাশিয়া"', "মার্ক্সীয় দর্শন'" , "মার্ক্সীয় যুক্তি বিজ্ঞান" "বইপড়া"' ইত্যাদি।
সাহিত্যিক সরোজ আচার্যের "সাংবাদিকতা ও কিংবদন্তী' প্রবন্ধে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিয়ে যত্নসহকারে লিখেছেন। আচার্য সাহেবের মতে:---
"খবরের কাগজের স্বাধীনতা মানে, সাংবাদিকের, এমন কী সম্পাদকেরও স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার নয়, এই সোজা কথাটা পরিষ্কারভাবে না বোঝার ফলে অনেক ক্ষোভ এবং অভিযোগ জমে উঠেছে। ক্ষোভ সাংবাদিকের মনে, অভিযোগ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।”
সংবাদপত্রের সমকালীন প্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করে সাংবাদিকদের ক্ষোভের কারণ হিসেবে তাদের নিয়োগ কর্তার স্বাধীনতা হরণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। সম্পাদকের স্বাধীনতাও স্বীকৃত হয়নি। কারণ :-- “সম্পাদকের ব্যক্তিগত বিবেক ব্যবহারের কিংবা স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, হয় কর্তাদের নির্দেশে সীমাবদ্ধ নয়তো মারাত্মক রকমের অনিশ্চিত।”
প্রাবন্ধিক সরোজ আচার্য সম্পাদকদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পক্ষাবলম্বন করা সংবাদপত্রের কর্মকর্তার অঙ্গুলি হেলনে নির্দেশেই ঘটে। সেজন্য প্রাবন্ধিকের মত প্রণিধানযোগ্য:-----
“সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কার্যকরী অর্থ হল কাগজের মালিকানা যাঁদের কাগজের মতামত চরিত্র নির্ধারণের স্বাধীনতাও তাঁদের।”
সুতরাং
“সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভীরুতা, কপটাচরণ, দাস-মনোভাব ইত্যাদির অভিযোগ আনবার কোনো অর্থই হয় না। ... কর্তার ইচ্ছায় কর্ম' যেমন কল-কারখানায়, তেমনই খবরের কাগজেও...।”
সাহিত্যিক সরোজ আচার্য'র "‘সমালোচনার সূত্র" প্রবন্ধে সাহিত্য সমালোচনার পদ্ধতি নিয়ে বইস্তঋত করেছেন প্রাবন্ধিক। সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে রসের আস্বাদন এবং উপলব্ধি যে প্রাধান্য পাবে সে বিষয়ে জোরালো অভিমত প্রকাশ করেছেন। বস্তুতঃ সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে সামাজিক তত্ত্ব প্রাধান্য পাবে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন:-----
"শেক্সপীয়র মার্ক্সের কণ্ঠস্থ ছিল; মার্কসের লেখায়ও দেখা যায় শেক্সপীয়র থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি। তা বলে শেক্সপীয়রকে অথবা গায়টেকে কোনো আঁটোসাঁটো সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ছকে ফেলবার চেষ্টা করেননি। এক কথায় বলতে গেলে, সাহিত্য শিল্পকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করতেই হবে, এমন কোনো ইঙ্গিত মার্কস-এঙ্গেল্সের লেখায় পাওয়া যায় না।"
প্রাবন্ধিক সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার উদাহরণ টেনেছেন— “লেনিনের সময় থেকেই সোভিয়েট ইউনিয়নে সাহিত্য এবং শিল্পকলাকে একটা সুনির্দিষ্ট প্রলেটেরিয়ানের ছকে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। তবে লেনিন নিজে একে খুব উৎসাহ দেননি।”
কিন্তু এই প্রয়াসের কারণও আচার্য সাহেব ব্যাখ্যা করেছেন। বিষয়টি হল সাহিত্যকে রাজনৈতিক ও ভাবনৈতিকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ধাঁধা।
ফরাসি সমালোচক টেন কিংবা মার্কস- এর নীতির প্রসঙ্গ এনে সাহিত্যের সমাজতাত্ত্বিক রীতির সীমাবদ্ধতার কথাও বলেছেন। কারণ:----
“সামাজিক প্রতিবেশ, দেশ ও কালের সমালোচনার ভিত্তিভূমি হলেও সাহিত্যের স্বরাজ্য, প্রতিভার স্বকীয়তা এবং শিল্পকর্মের নিজস্ব বহুমুখী রীতিনীতি, এসবই সমালোচনার সূত্র রচনা ও প্রয়োগে একটা প্রধান অংশ দাবি করতে পারে।”
সরোজ আচার্য'র সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টি ও ভাববাদী দৃষ্টি উভয়ই যে পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা নয় তার কারণ টি. এস. এলিয়টের মত উল্লেখ করেছেন এভাবে----
"একটি ঝোঁক হল লেবরটারিতে বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে সাহিত্যের সব কিছুকে খণ্ড খণ্ড করে সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি অথবা ধর্মের মালমশলা আবিষ্কার করা। আর একটি, যাকে বলা যায় লেবু নিংড়ে সবখানি রস বার করার চেষ্টা অর্থাৎ কোনো লেখার ভাবানুবাদ করে রকমারি ব্যাখ্যা এবং ভাষ্যে ভারাক্রান্ত করে সাহিত্যকে জীবন সম্পর্কচ্যুত তত্ত্বসর্বস্ব অথবা ভঙ্গি সর্বস্ব করা।”
প্রাবন্ধিকের অভিমত প্রণিধানযোগ্য: --
"কোনো শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকৃতিই কতকগুলি উপাদানের সুদ্ধমাত্র যোগফল নয়। তার রূপ এবং মর্মর্গত রহস্য এমন জটিল যে উপাদানগুলি ভেঙে ভেঙে বার করলেই সমালোচনার উদ্দেশ্য সফল হয় না।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কিংবা শেলীর ‘ওড টু দি ওয়েস্ট উইণ্ড'-কে ভেঙে ভেঙে ব্যাখ্যা করলে কিংবা সারার্থের সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়ন করলে ঐ দুটি কবিতার সৌন্দর্য শক্তির পরিচয় উপলব্ধি করা যায় না।
সাহিত্যিক সরোজ আচার্য সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে সাহিত্যকে প্রয়োজনের সাহিত্য ও অপ্রয়োজনের সাহিত্য এমন ভাগ করা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন:-
“মানুষ যন্ত্রও নয়, আবার দেহহীন আইডিয়া মাত্রও নয়। তাই মানবিক সত্তার স্থূল সূক্ষ্ম সব প্রয়োজন মিলিয়েই জীবন- প্রবাহ। এই প্রবাহ থেকে যে কোনো একটিমাত্র ধারাকে পৃথক করে নিয়ে বাঁধ দিলে মানবধর্মকে বিকৃত করা হয়।”
প্রবন্ধের উপসংহারে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন,
" “সাহিত্য সামাজিক, রাষ্ট্রিক নয়। সমাজ শ্রেণীবিভক্ত হলেও তার সামগ্রিক মানবিক সত্তা সব শ্রেণীর মানুষই অল্পবিস্তর অনুভব করে" । ‘
রবীন্দ্রনাথের *শেষের কবিতা"'-র কল্পনাময় রসোচ্ছল ভাবানুষঙ্গ অথবা 'হ্যামলেটে’র চিন্তাদ্বন্দ্ব শ্রেণীগত গণ্ডি ছাড়িয়ে মনকে অভিভূত করতে পারে, দল বা দর্শন বা রাষ্ট্রীয় নেতা তা ঠেকাতে পারে না। এর একটি কারণ কতকগুলি মৌলিক মানবীয় অনুভূতি সর্বজনীন, শ্রেণীবিভক্ত সমাজেও সেগুলি একেবারে আলাদা আলাদা শ্রেণীর গণ্ডীতে বাঁধা নয়। তেমনি ভাষাও সামাজিক। তাকে কঠিনভাবে শ্রেণীবিভক্ত করা যায় না, যেমন যায় না প্রকৃতিকে, নিসর্গ সৌন্দর্যকে।”
সুতরাং আধুনিক প্রতীক ও চিত্রকল্প ভাবনার
কবি রেবা সরকার মহোদয়া সরোজ আচার্য'র সম্পর্কে মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য:---
" প্রাবন্ধিক সরোজ আচার্য শান্ত সংযত ও মার্কসীয় ভাবনায় বিশ্বাসী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত গ্ৰন্থ গুলো পড়ার পর ,সত্যি হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি হয়েছিল "!
সুতরাং প্রাবন্ধিক সরোজ আচার্য সাহিত্য সমালোচনায় এ ধরনের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মৌলিকতাকে মেলে ধরতে পেরেছেন। এবং মৌলিকতা ঋণ বহু পঠনের ফলে ও উদারমুক্ত মানসিকতার মূল্যায়নে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হয়েও চিরস্মরণীয় ।
0 Comments