মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭৯
অহিভূষণ পাত্র (শিক্ষক, সম্পাদক, লেখক, পাঁশকুড়া)
ভাস্করব্রত পতি
তিনি ছিলেন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মধ্যে কুইজ বই এর প্রথম লেখক। আজ জেলা জুড়ে কুইজ নিয়ে যে অপরিসীম চর্চা শুরু হয়েছে, তা তখন ছিল না। সেসময় না ছিল কম্পিউটারের বহুল ব্যবহার। না ছিল ইন্টারনেট কানেকশন। ছিল না মোবাইল। আর সোশ্যাল মিডিয়ার কথা তখনও পৃথিবীতে আসেনি। এমতবস্থায় ছাত্র ছাত্রীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে শিক্ষক অহিভূষন পাত্র লিখেছিলেন কুইজের বই। তাঁর লেখা সেই বই দীর্ঘদিন বিভিন্ন স্কুলের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের বিশেষ পাঠ্য ছিল। একসময় তাঁর লেখা বই পড়ে যাঁরা জানা অজানার নানা তথ্য পেয়েছে, আজ তাঁদের ছেলে মেয়েরা গুগল খুলে সেইসব তথ্য জানতে পারছে।
১৯৫৫ সালের ১ লা জুলাই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ময়না থানার চংরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রয়াত ভূপতিচরন পাত্র ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা কৌশল্যা পাত্র সাধারণ গৃহবধু। মোট আট ভাই বোনের মধ্যে অহিভূষন পাত্র মেজছেলে। ময়না পূর্ণানন্দ বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মহিষাদল রাজ কলেজ থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক অর্জন করেন। এরপর রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন পি.জি.বি.টি. কলেজ থেকে পি.জি.বি.টি. ডিগ্রি লাভ করেন। পরে বিনায়ক মিশন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
একসময় এই মানুষটি পাঁশকুড়ার কুমরপুর হটেশ্বর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যের প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন। প্রায় দুবছর (২০০২ - ২০০৪) এই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী তাঁর হাতে জীবনের চলার পথ খুঁজে পেয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনস্ক নাগরিক। ১৯৮১ থেকে পাঁশকুড়ার হাউর অঞ্চলের প্রত্যন্ত এক গ্রামে শিক্ষক হিসেবে থেকেও সারা জেলা জুড়ে নিজেকে পরিচিত করতে পেরেছেন নিজের দক্ষতায়। নিজের ক্যারিশ্মায়। আজ তিনি জেলার একজন পরিপূর্ণ সাহিত্যিক, গবেষক এবং লেখক।
কবি, ছড়াকার, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক অহিভূষন পাত্রের প্রথম লেখালেখির ক্ষেত্রভূমি মহিষাদল রাজ কলেজ। এখানে পড়ার সময়ে তাঁর মননে বীজ প্রোথিত হয় সৃষ্টিশীল ভাবনার। তখন কলেজের অধ্যাপক সুশীল কুমার চক্রবর্ত্তী সম্পাদনা করতেন ‘ল্যাকেটু' পত্রিকা। সেখানেই লিখতে শুরু করেন। এরপর নিজের বড়দাদা ফনিভূষন পাত্র সম্পাদিত পাক্ষিক সংবাদপত্র ‘ধানক্ষেত' পত্রিকাতে লাগাতার লিখতে থাকেন। তবে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। তিনি নিজেও ভালোই কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ লিখতেন। ফলে ছেলেকে অনুপ্রাণিত করতে সচেষ্ট ছিলেন প্রথম থেকেই।
একসময় বিভিন্ন গন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পাঁশকুড়া জোনের সভাপতি, পাঁশকুড়া সাহিত্য সংস্কৃতি আকাডেমির সহ সভাপতি, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রেস ক্লাবের সদস্য, ওয়েষ্ট বেঙ্গল ইউনিয়ন অব জার্নালিষ্ট এর সদস্য ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ লেখক শিল্পী সংঘের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে এখনও কাজ করে চলেছেন।
২০০২ থেকে ‘জন্মভূমি' নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করতেন। পরবর্তীতে তা পাক্ষিক হলেও বড় সংবাদপত্র গুলির রমরমাতে এই ছোট ছোট পত্রিকার গুরুত্ব কমে যেতে থাকে। তখন তিনি বাধ্য হন তা বন্ধ করে দিতে। এই পত্রিকায় বহু নামকরা মানুষ লিখতেন। সর্বোপরি গ্রামীণ সাংবাদিকতার উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন একসময়। অনেকের লেখালেখির প্রথম সোপান ছিল 'জন্মভূমি'। সারা মেদিনীপুর জেলা জুড়ে পত্রিকার সুগন্ধ প্রচারিত হত বোদ্ধা মহলে। সাংবাদিক হিসেব জেলায় সমীহ আদায় করেছেন সকলের কাছে। সাংবাদিকতা, লেখকসত্বা এবং গবেষণা ধর্মী কাজের জন্য অহিভূষন পাত্র পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মান ও পুরস্কার। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্মান হল 'অরুনা বর্ধন স্মৃতি পুরস্কার (২০০৫), কুইজ ডট্ কম পুরস্কার (২০১২) ইত্যাদি। অহিভূষন পাত্র নিজেও অনান্য কৃতি মানুষজনদের সম্মাননা দিতেন প্রতিবছর। তিনি বিশ্বাস করতেন যোগ্য মানুষদের সম্মানিত করলে আখেরে সমাজের উপকার হয়। তাই তিনি তাঁর সম্পাদিত 'জন্মভূমি' পত্রিকার উদ্যোগে 'জন্মভূমি দেশরত্ন সম্মান” দিতেন জেলা এবং রাজ্যের বহু মানুষকে। কালীপদ চৌধুরী, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, ড. অমরেন্দ্রনাথ বর্দ্ধন সহ বহু মানুষকে সেসময় দেওয়া হয়েছে এই সম্মান।
এ পর্যন্ত বেশ কিছু গ্রন্থের লেখক হিসেবে মেদিনীপুরবাসী তাঁকে পেয়েছে। যা সাহিত্যপ্রেমীদের মনের খোরাক মিটিয়েছে বহুলাংশে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল 'উড়ুৎ ফুড়ুৎ' (২০০৯)। লিখেছেন প্রবন্ধ সংকলন ‘মুক্তমনের আলো' (২০১২) এবং ছোট গল্প সংকলন ‘সোনা রোদের গান' (২০১৩)। ভ্রমণপিপাসু এই মানুষটি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন। ফলে সেই সব অজানা অচেনা দেশের অকথিত কাহিনী নিয়েও তিনি লিখেছেন ‘ইউরোপের স্মৃতি’ (ইংল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড)। আরও নানা ধরনের বই প্রকাশের অপেক্ষায়।
পরিবার নিয়ে অহিভূষণ পাত্র
তাঁর লেখা অসংখ্য ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কৃতি মানুষদের জীবনী প্রকাশিত হয়েছে এ রাজ্যের বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। আলোর ছটা, উপত্যকা, কথামেঘ, আপনজন, মেদিনীপুরের গ্রামের কথা, যুগান্তর, সিগন্যাল, কালান্তর, পরিবর্তন, জোনাকী, আর্বত, শুক্লপক্ষ, এপার ওপার, পূর্বাচল, ধানক্ষেত, ল্যাকেটুতে ধারাবাহিকভাবে এখনও লিখে চলেছেন মেদিনীপুর জেলার সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সাহিত্যরস নিয়ে। এহেন মানুষটি প্রচারের আড়ালে থেকে নীরবে নিভৃতে সাহিত্য সেবা করে চলেছেন। মেদিনীপুরের মানুষ রতন হয়েই বেঁচে থাকবেন সকলের মননে।
🍂
0 Comments