জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৮ / সালেহা খাতুন

স্যার ও অপ্রতিমদার সঙ্গে আমরা বন্ধুরা


শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৮ / সালেহা খাতুন 

প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের পত্রিকায় চৈতালীর কবিতা ছাপা হয়েছিল। আজও যার কিছুটা মনে আছে – “ বন্ধ চোখে রইলে তুমি / চোখ মেলে তো দেখলে না / চোখ খুললে দেখতে পেতে/ রঙ বেরঙের আলপনা।” “আমি এক রিকশাওয়ালা” নামে আমিও একটি কবিতা জমা দিয়েছিলাম কিন্তু প্রকাশ পায়নি। লিখেছিলাম – আমি এক রিকশাওয়ালা / যাত্রীর আশায় বসে আছি সারাবেলা / মাঝে মাঝে ভাবি,/ আমার অবস্থা কী দুঃসহ;/ যাত্রীর আশায় কাটছে অহরহ..। 
তবে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে দেওয়াল পত্রিকায় 
“আজকের যুব সম্প্রদায়” নামে আমার একটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছিল। চৈতালীকে নিয়ে একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম সেসময়, যার শুরুটা ছিল – হে বন্ধু তোমার উচ্চ শির / শত বিপদেও থাকে উন্নত, / গোপন রহস্যে হৃদয় তোমার / পূর্ণ হয়েছে অবিরত।

     চৈতালীর গুণের শেষ নেই ও ভালো নাচতেও পারতো। আমাদের এক বন্ধু বৈশাখীর বিয়েতে ও দুর্দান্ত নেচেছিল। নিজের ড্রেস নিজে ডিজাইন করতো। আর বৈশাখীর সন্দেশকে “সোন্দেশ” উচ্চারণ স্যার সংশোধন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কলেজের বন্ধু ছাড়াও আমাদের বন্ধুতালিকা দীর্ঘ হয় স্যারের বাড়িতে। 

হাওড়া গার্লস কলেজ, নরসিংহ দত্ত কলেজে যারা পড়তো তারা অনেকেই এক হয়ে গেলাম। আর সেটাকে আরো দৃঢ় করে দিলেন স্যার ও অপ্রতিমদা। আমাদের নিয়ে পিকনিকে গেলেন ফুলেশ্বর বাংলোয়। নৌকাবিহারও হলো। বন্ধুদের মধ্যে শোভন ছিল “সবে ধন নীলমণি”। বাংলোর একটি বড়ো গোল টেবিলে মুড়ি ঢেলে ব্রেকফাস্ট হলো আমাদের। নিজেরা সবজি কাটাকুটি করলাম। অপ্রতিমদা রান্না করলেন। 
🍂
অপ্রতিমদার কাছেও পড়াশোনা করতাম আমরা। দাদার বাড়িতে রবিবার সকালে টিভিতে রঙ্গোলি দেখে তবে আমাদের পড়াশোনা শুরু হতো। অপ্রতিমদাও মুখে মুখে আমাদের নাম নিয়ে মজার সব ছড়া বানাতেন। বর্ণালীর নাম নিয়ে শুরু করলেন, “ নাম তার বর নালী / বড়ো নালী নয়” অথবা দেবযানীকে নিয়ে বলতেন “দেবী জানি নও”।

ঐ পিকনিকে স্যারের এক বন্ধু গিয়েছিলেন। তাঁর ক্যামেরায় আমাদের সেই ভ্রমণের অমূল্য সব স্মৃতি ধরা আছে। স্যারের হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে আমাদের পায়ের দিকে খেয়াল ছিল না। স্যারের পা ঢুকে গেল মানুষের তৈরি করে রাখা গর্তে। পিকনিক করতে এসে ভাতের ফ্যান ফেলার জন্য অনেকে গর্ত খুঁড়ে ফ্যান ফেলে গেছে। আমরা জগে করে জল এনে স্যারের পা ধুয়ে দিলাম। স্যারের বন্ধু অনেক আশীর্বাদ করলেন আর আমাদের অজান্তে সেই মুহূর্তটিকে ফ্রেমবন্দী করে গুরু বন্দনার অন্যতম একটি নিদর্শন স্বরূপ আমাদের উপহার দিলেন।
কিশোর ভারতীর সেই চিঠি

তিরানব্বই সালটা বিভিন্ন ঘটনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। অবাক বিস্ময়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে নিজেদের নির্মাণ পর্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ সব ঘটনা অবলম্বনে যে মালা গেঁথে চলেছি তাতে কেউ বলতেই পারেন কী হবে এসব জেনে। বৃহত্তর জনগণের এতে কী লাভ? আসলে আমরা সবাই চাই আমি কী ভেবেছিলাম, আমি বা আমরা কেমন ছিলাম পরবর্তী প্রজন্ম জানুক। মানুক বা মানুক অন্তত এটা তো জানবে একদিনে কিছু হয় না। জীবন নির্মাণের পথের কোনো শর্টকার্ট হয় না। সে জীবনে সুখ দুঃখ আনন্দ বিষাদ হতাশা বিস্ময় সব থাকে। শুধু অতিক্রম করে যাওয়া শিখতে হয়। ঐ বছরই আমাকে অবাক করে আমার নামে কিশোর ভারতীর একটি সংখ্যা ও একটি চিঠি আসে। ছোটোবেলায় বাবা আমাদের জন্য সোভিয়েত দেশ পত্রিকা নিত। কিন্তু পোস্টে সেটা তো বাবার নামেই আসতো। সরাসরি আমার নামে!!! বিস্ময় বিস্ময় বিস্ময়। লাফাতে লাফাতে তিরানব্বইযের চোদ্দোই জুন নিজের খুশি প্রকাশের সব থেকে বড়ো মাধ্যম যে কবিতা তা লিখে ফেললাম। কবিতা হলো কি হলো না সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল না রেখেই। আমার বন্ধু অনিতা বলে আমি নাকি স্বভাবকবি।
ফুলেশ্বর বাংলোয় চৈতালীর নেতৃত্বে নৃত্য

 ‘কিশোর ভারতী’ শিরোনামায় লিখলাম – 

আজকে আমি দারুণ খুশি
ভাবছে সবাই একি!!
বোনকে বলি ভাইকে বলি
কী পেয়েছি দেখ দিকি।
কিশোর ভারতী নিজে 
এসেছে পথ চিনে।
তাইতো আজ এতো আনন্দ
জেগেছে আমার প্রাণে।
এতে আছে কত শত গল্প
কবিতা আর ছড়া,
পড়ার ইচ্ছা আরও বাড়ে 
যতই হোক পড়া।

সাহিত্যপাঠ, বইমেলায় যাওয়া (তখন বইমেলা কলকাতা ময়দানে হতো), বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া, সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া আর প্রথম হলে সিনেমা দেখা সব কিছু মিলে তিরানব্বই ছিল ব্যষ্টি ও সমষ্টির স্মৃতির মিউজিয়ামে অনায়াস গতায়াতের অফুরন্ত ভাণ্ডার।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments