জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে/সপ্তবিংশতি পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
সপ্তবিংশতি পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল 

           
নাটমন্দির থেকে নেমে আমরা মন্দির কার্যালয়ের অফিসে গিয়ে যিনি সেক্রেটারি আছেন তার সাথে আলাপ করার পরে আমরা মন্দিরের ইতিহাস জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন "স্কন্দপুরাণের পাতাল খন্ডে একশো কুড়ি অধ্যায়ে বলা আছে মহিষাসুর নামে এক দানব ব্রহ্মার তপস্যা বলে বলীয়ান হয়ে দেবতাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে ত্রিভুবন অধিকার করে। তারপর ত্রিভুবনে সে অত্যাচার শুরু করে। তার অত্যাচারে দেবতারা স্বর্গভ্রষ্ট হলেন। তাঁরা মহিষাসুরকে কোন উপায়ে বধ করতে না পেরে অত্যন্ত কুপিতে হওয়ার ফলে তাঁদের কপোল থেকে স্বেদবিন্দু নির্গত হতে লাগলো। এদিকে নারদের মুখে মহিষাসুরের অত্যাচার বৃত্তান্ত শ্রবণ করে দেব সেনাপতি কার্তিকেয় অত্যন্ত কুপিত হবার পরে তাঁর কপোল থেকেও স্বেদবিন্দু নির্গত হল। দেবগন ও কার্তিকেয়র মিলিত স্বেদবিন্দু একত্রিত হতে এক কুমারী কন্যার জন্ম লাভ হয়। এই কুমারী কন্যা দেবগন এবং কার্তিকেয়র কোপসম্ভূতা বলে ওই দেবীর নাম হয় কাত্যায়নী। তিনি দেবগনের আদেশে মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং মহিষাসুরকে যুদ্ধে বধ করে দেব ও ত্রিজগতকে শান্তি প্রদান করেন। 
আবার অন্য এক পুরানে বলা হয়েছে প্রজাপতি দক্ষ একবার এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন।

🍂

 সেই যজ্ঞে তিনি সমস্ত মুণি, ঋষি এবং তাঁর সমস্ত জামাতাদেরকে নিমন্ত্রিত করেছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র দেবাদিদেব মহাদেবকে নিমন্ত্রণ করেননি। মহাদেব সেই জন্য সতীদেবীকে সেই মহাদেবহীন যজ্ঞে পাঠাতে চান নি। সতী ক্ষিপ্ত হয়ে মহাদেবের অনুমতি আদায় করার জন্য তাঁর দশমহাবিদ্যার রূপ দর্শন করিয়ে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে যজ্ঞস্থলে যান। সেখানে প্রজাপতি দক্ষের মুখে স্বামীনিন্দা শুনে তা সহ্য করতে না পেরে সতী সেই যজ্ঞ স্থলে প্রাণ ত্যাগ করেন। সতীর মৃত্যুর খবর পেয়ে মহাদেব ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তাঁর মস্তক থেকে একগুচ্ছ কেশ নির্গত করে মাটিতে নিক্ষেপ করার পরে বীরভদ্র নামে এক দেবতার আবির্ভাব হয়। মহাদেবের নির্দেশে বীরভদ্র এবং শিবের অনুচরেরা দক্ষ প্রজাপতির যজ্ঞস্থলে যেয়ে যজ্ঞ পণ্ড করে দক্ষ প্রজাপতির শরীর থেকে মস্তক ছিড়ে নেয়। মহাদেব সতীর মৃতদেহ নিজ স্ক‌্ন্ধে তুলে নিয়ে উন্মত্তের ন্যায় প্রলয় নৃত্য শুরু করলেন। তাঁর এই প্রলয় নৃত্যের ফলে ত্রিভুবন ধ্বংসের উপক্রম হয়। তখন সকল দেবতার অনুরোধে নারায়ণ সতীর দেহ সুদর্শন চক্রে খন্ডন করে ত্রিভুবনে ছড়িয়ে দেন। সেই খন্ডগুলি যেখানে যেখানে পতিত হয়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ গড়ে ওঠে। বৃন্দাবনের এই স্থলে সতীর কেশপাশ পতিত হয়। কাচ ঢাকা বেদীর উপরে কাঁচঢাকা বাক্সে রয়েছে সেই প্রস্তরীভূত কেশপাশ। পূর্বেই উল্লেখ করেছি বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা কাত্যায়নী"। মা কাত্যায়নীর ব্রত পালন করে বৃন্দাবনের গোপ বালিকারা তাদের পতিরূপে শ্রীকৃষ্ণকে পেয়েছিলেন। বৃন্দাবনে যমুনা কিনারে কদম্বঘাটে শ্রীকৃষ্ণ তাদের মনষ্কামনা পূর্ণ করেছিলেন। তিনি আমাদেরকে একখানি হিন্দিতে লেখা পত্রিকা দিলেন তাতে আরো লেখা আছে যে কেশবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে একজন বাঙালি সাধক এই দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি হাওড়ার এক ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি ব্রহ্মচারী হন এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করে বৃন্দাবনে আসেন। এখানে তিনি নিজের সাধনা এবং প্রচেষ্টায় এই মন্দির নির্মাণ এবং এই তীর্থস্থানের সংস্কার সাধন করেছিলেন। 
মন্দির থেকে বেরিয়ে আবার ডানদিকে যেয়ে পুনরায় বাঁদিকে যাবার পরে ৬৪ মোহান্তের সমাধি মন্দির দেখতে পেলাম। রাস্তার ডান দিকে সমাধি মন্দিরের দরজা। ভেতরে সারি সারি গাছপালা এবং তার মাঝে ছোট ছোট মন্দির তুলসী মঞ্চের মত সাজানো। খুব শান্ত পরিবেশ। দরজার বাঁদিকে একপাশে মন্দির কর্তৃপক্ষের কার্যালয়। তার সামনে দিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো সরু পথ গোল হয়ে মন্দিরগুলি পরিক্রমা করে গেছে কতকগুলি সমাধি মন্দিরকে মাঝখানে রেখে। আমরা ওই রাস্তা ধরে যাবার সময়ে দেখলাম মন্দিরগুলি। সবগুলি মন্দিরই বৈষ্ণব মহন্তদের স্মৃতি মন্দির। অদ্ভূত শান্ত পরিবেশ। মন্দিরগুলির গায়ে বৈষ্ণব মোহন্তদের নাম, তাঁদের আবির্ভাব ও তিরোভাবের সময় মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ করা আছে। সমস্ত বাগানটি গোল হয়ে ঘুরে, আমরা পুনরায় সেই কার্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে যিনি পূজারী ছিলেন তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলার পরে তিনি আমাদের হাতে বাংলায় লেখা ছোট্ট একখানি ছাপা কাগজ দিলেন যাতে সমস্ত মোহন্তদের বংশপরম্পরা লেখা আছে। 
মা কাত্যায়নীর মন্দির ও ৬৪ মোহান্তের সমাধি মন্দির দেখে আশ্রমে ফিরতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যা ৭ টা বেজে গেল। আমাদের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম।আজ রাত্রি পৌনে এগারোটায় আমাদের ট্রেন। রাত্রি সাড়ে আটটায় আশ্রমের উল্টোদিকে রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানের গেট থেকে মথুরাগামী একটি নগর পরিক্রমাকারী বাস ধরে মথুরাতে যেয়ে পৌছালাম। এখান থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল নৈমিষারণ্য তীর্থ। নৈমিষারণ্য ভ্রমণের বিস্তৃত বিবরণ অন্য একটি নিবন্ধে জানাব।
                                         পরবর্তী অংশ অষ্টবিংশতি পর্বে…………..

Post a Comment

0 Comments