জ্বলদর্চি

বাজরার রুটি /সৌমেন রায়

 

চিত্র-অসিত কুমার সেনাপতি

বাজরার রুটি 

 সৌমেন রায়  

মর্নিং স্কুলটা ছোটনের বেশ আনন্দের সময়। স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমের ভান করলেই মা চলে যায় অন্য ঘরে। তারপর পুরো দুপুর সে নিজেই নিজের রাজা। সেদিনও ঘুমের ভান করে পড়েছিল। হঠাৎ চোখ গেল ছোটকা'র রেখে যাওয়া যন্ত্রটার দিকে।দূর সম্পর্কের ছোটকা’র কথায় সে ছিল প্রফেসর শঙ্কুর অ্যাসিস্ট্যান্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট।  ওসব সত্য না মিথ্যা সে নিয়ে  ছোটন মাথা ঘামায় না।তবে সে পড়ার বইয়ের ফাঁকে শঙ্কু সমগ্র বার দুই পড়ে ফেলেছে। ছোটকা কলেজের এক্সারশন থেকে ফিরে ফিরে এসে ছোটনকে যন্ত্রটার মধ্যে ঢুকিয়ে ম্যাজিক দেখাবে বলে গেছে। ছোটনের মনে হল একবার ঢুকেই দেখি না কি ম্যাজিক! যেই বলা সেই কাজ। যন্ত্রটার মধ্যে ঢুকে ঢাকাটা নামিয়ে দিল ছোটন। তারপরে একটা  বিকট শব্দ। ছোটন তো ভয়ে অস্থির।কিছুক্ষন পর শব্দ বন্ধ হতে ঢাকা খুলে নেমে এলো সে।

            নেমে জায়গাটা একটু চেনা চেনা লাগলো কিন্তু পুরো চিনতেও পারল না। লোকজনকে দেখল সবার কোমরে একটা লুঙ্গির মতো ,আর গায়ে একটা আলখাল্লা মত পরে আছে। সব সাদা, কোন রং নেই। সব ঘরগুলোর দেওয়াল গাছপালা তে ভর্তি। বইতে যেমন ভার্টিক্যাল গার্ডেনের কথা পড়েছে ঠিক তেমন। সব বাড়ির ছাদে গাছ। সব বাড়ির সামনে একটা করে ছোট ডোবা। যেমন সে মামা ঘর গিয়ে দেখেছিল ঠিক তেমন। একজনকে জিজ্ঞাসা করল এটা কোন জায়গা? সে পাত্তাই দিলনা। যেন  কিছুই শোনেনি। আরো দু একজনকে জিজ্ঞাসার পর বুঝতে পারল তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।খিদে পাচ্ছে, কি করা যায়? এমন সময় দেখল একটা লোক ঘর থেকে বের হচ্ছে।সুযোগ বুঝে সে ফাঁক গলে  ঢুকে গেল। উপরে উঠে দেখল তারই বয়সী একটা ছেলের বায়নাক্কা চলছে। 

ছেলে : বাজরার রুটি আমি খাব না। ভাত হয়নি কেন? দুদিন আগেই বললে সামনের সপ্তাহে চিকেন করবে। চিকেন কই?

 মা:  তোমাকে বললাম তো এ সপ্তাহে রেশনে মাংস, চাল, দুধ কিছুই দেয়নি। যা পাচ্ছো খেয়ে নাও।

ছোটন অবাক হয়ে বাড়িটা দেখল। রেশনে চাল নিয়ে খাওয়ার মত অবস্থা তো এদের নয়।

 ছেলে:  একটু মাখন অন্তত দাও রুটিতে!

মা:  দুধই দেয়নি  তার আবার মাখন!  ছোটন দেখল ফলের ঝুড়িতে পেয়ারা আর পেঁপে। কোনটাই তার পছন্দ না। আপেল, আঙ্গুর কিছু নেই কেন ? যাই হোক আগে একটু জল খেয়ে পেয়ারাই খাবে একটা। জলের বোতল নিয়ে খেতে গিয়ে দেখল জল পড়ছে    ফোঁটা ফোঁটা করে। রাগ হয়ে গেল ছোটনের। একটা পেয়ারা নিয়ে বিরস বদনে খাচ্ছে এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল।একটা ইউনিফর্ম পরা লোক ঘরে ঢুকলো। সে নাকি ছাদ বাগান আর কি একটা ট্যাংকের ইন্সপেকশন  করতে এসেছে। ওদের পিছনে পিছনে ছাদে গেল ছোটন।দেখল গোটা পনের বিভিন্ন রকমের গাছ ছাদে। এখন নাকি মাথাপিছু অন্তত তিনটি করে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক। ছাদের একদিকে একটা ট্যাংকে লেখা আছে ইউজড ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাংক। লাস্ট ইন্সপেক্টটেড 1.1.2059.সব দেখে শুনে  লোকটা বলল গাছগুলোর যত্ন নিতে।আর ইন্সপেকশন ডেটটা চেঞ্জ করে দিয়ে গেল। হঠাৎ মায়ের ডাকে ছোটনের ঘুম ভেঙে গেল,দেখল বিকেল হয়ে গেছে।

                         সত্য কথা 

        উপরের কথাগুলি একেবারেই গল্পকথা। তবে আজ যা গল্পকথা অচিরেই তা হয়ে যেতে পারে সত্য কথা। কারণ জলের মত সহজ, জল সংকটের জন্য। সংকটের একটি রূপরেখা না দিলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। প্রথমে দেখে নেওয়া যাক আমাদের গোটা বিশ্বের জলছবির কিছু টুকরো কথা।

  # বর্তমান জল উত্তোলন হার অব্যাহত থাকলে 2030 সালে 40 শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত পানের জল পাবে না।

#  230 মিলিয়ন মানুষ জলের অভাবে ভুগছে # বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বছরে একমাস তীব্র জলকষ্টে  থাকে।

# 2030 এর মধ্যে 700  মিলিয়ন মানুষ অভিবাসী হবে জলের জন্য।

# বিশুদ্ধ জলের অভাবে প্রতিদিন ২১৯৫ জন শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটে।

                 ভারতের জলছবির এক টুকরো

# 50 শতাংশ কৃষক জল সমস্যায় আছে

# বছরে আড়াই লক্ষ লোকের জলঘটিত রোগে মৃত্যু ঘটে। 

# ২০৫০ সাল নাগাদ জিডিপির 6 পার্সেন্ট হ্রাস পাবে জল সংকটের জন্য।

# পৃথিবীর জনসংখ্যার 17 শতাংশ বাস করে ভারতে কিন্তু বিশুদ্ধে জল আছে মাত্রই ৪ শতাংশ।

# গত 30 বছরে শুধুমাত্র কলকাতাতেই জলাভূমি কমেছে 5000 টি।

🍂

                                   কারও  মনে হতেই পারে পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। তাহলে এত চিন্তা কিসের? চিন্তার কারণ জলের পরিমাণ নয়, বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ। বিশুদ্ধ পানীয় জল মোট জলের মোটামুটি এক শতাংশ মতো। এবার নিশ্চয় আন্দাজ করা যায় সমস্যাটা কত গভীর। শুধুমাত্র জল সংকটের কারণে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তবে তার আগে কিভাবে  আমাদের তিনটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভ্যাস পাল্টাতে হবে সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। 

                            বাসস্থান

       শেষ থেকে শুরু হোক। প্রথমে আসা যাক বাসস্থানের কথায়। অচিরেই হয়তো জলাভূমি, নিম্নভূমি গুলি বুজিয়ে শহর মুখী  বহুতল অভিবাসন বন্ধ করতে হবে তীব্র জল কষ্টের কারণে। হয়তো উল্টো অভিবাসন শুরু হবে , গ্রামমুখী অভিবাসন। শহরের কংক্রিট আর আসফেলট আস্তরণে জল তো মাটির স্পর্শ পায়না। সব ধারাপাত নর্দমা বাহিত হয়ে নদী, নদী বাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। গ্রামের মতো কংক্রিট বিহীন  কর্দমাক্ত উঠোন , এক কোণে থাকা ডোবা এমন আশ্রয়ে হয়তো ফিরে আসতে হবে বহুতলের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত নিবাস ত্যাগ করে।অবিকল গল্পের মত। কারণ এমন নিরাভরণ ভূমিই বসুন্ধরার গর্ভে ভরে দেয় অমৃত ধারা।মার্বেল শোভিত হর্মগুলি হয়তো সভ্যতার ধ্বংস স্তুপ হিসাবে গণ্য হবে অদূর ভবিষ্যতে।সাম্প্রতিক ব্যাঙ্গালোরের জল সংকট তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছে।জলের পরম্পরাগত উৎস গুলি ছেড়ে আমাদের’ নলপানী ‘ নির্ভরতা এর কারণ।এখন গ্রামাঞ্চলের পুকুরগুলো পর্যন্ত মজে গেছে।বালক বালিকারা এখন স্বাভাবিক ভাবে সাঁতার পর্যন্ত শেখেনা।

                 

 পোশাক

 ফ্যাশনেবল জামা কাপড় পরার দিন হয়তো যাবে কয়েক দশক পরে।দুবেলা দুটি ফ্যাশনেবল জামার পরিবর্তে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের মতো দুটো শার্ট, দুটো ধুতি বা ছোটবেলার রবীন্দ্রনাথের মতো দুটো প্যান্ট ,আর দুটো পকেটবিহীন জামাতেই কাটাতে হবে গোটা বছর। তাও সেসব হবে রঙ বিহীন,নেহাত খেলো। গল্পে যেমন বলা হয়েছে তেমনিই। কারণ তুলা খুব তৃষ্ণার্ত ফসল । এক কেজি তুলা তৈরি করতে জল লাগে প্রায় ২৫০০ লিটার,  একটা শার্ট তৈরি করতে খরচ হয় ২৭০০  লিটার জল।যা একজনের আড়াই বছরের পানীয় জলের সমান। তারপর সে  জামাকাপড় ডাই করতে লাগে প্রচুর জল। সুতো তৈরি পর এক পাউন্ড ড্রাই করতে এক থেকে পঁয়ত্রিশ গ্যালন জলের দরকার হয়। 20% ওয়াটার পলিউশন হয় জামা কাপড় ডাই এবং প্রিন্টিং এর জন্য। পোশাক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিবছর ব্যবহৃত হয় 79 ট্রিলিয়ন লিটার জল।তাই হয়ত জামাকাপড়ের বহর কমে হয়ে যাবে সবাই সমান।তাও টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ব্যাবহার করে মাত্র 2.1% জল। থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এ লাগে প্রায় 78% জল।যদিও সে জল পানীয় জল নয়।তবু নদী গুলির অবস্থা দেখলে বোঝা যায় যে অচিরেই আমাদের বিদ্যুৎ রেশনিং চালু করতে হতে পারে । মানে রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় পর আলো বন্ধ করা বাধ্যতামূলক হয়ে যেতে পারে। সূর্যালোক কাজে লাগাতে ভোর ভোর উঠেপড়তে হতে পারে।


              খাদ্য

এইবার আসা যাক খাদ্যের কথায়। ভাত খাওয়ার প্রচলন কমবেশি গোটা বিশ্বে আছে । তবে আমরা বাঙালিরা একটু বেশি ভাত খাই, তাই আমাদের বদনাম ভেতো বাঙালি বলে।ভাত খেয়ে ভাতঘুমের অভ্যাস ছাড়তে হবে হয়তো অচিরে। কারণ ধান উৎপাদন করতে জলের খরচ হয় অনেক বেশি। এক কেজি ধান উৎপাদনে জল লাগে প্রায় 2500 লিটার। গমে 1500 লিটার। জোয়ার, বাজরা, রাগী জাতীয় শস্য উৎপাদনে খরচ হয় খুব কম। কখনও বা 500 লিটারের কম। মনে রাখতে হবে একবার মাত্র ধান চাষ হয় বর্ষাকালে। বাকি দুবার ভূগর্ভস্থ জল তুলে।জলের ক্রাইসিস হয়তো আমাদের বাধ্য করবে বাজরার মত কম তৃষ্ণার্ত শস্য চাষ করতে। শুধু তাই নয় মাংস, দুধ, মাখনের মতো খাবারও টাকা থাকলেই কেনা যাবেনা। দেওয়া হবে রেশনে।ঠিক গল্পটির মত। কারণ এক কেজি রেডমিট তৈরিতে খরচ হয় 15145 লিটার জল। ঠিকই পড়েছেন,15000 লিটার এর বেশি। এক কেজি চিকেন তৈরিতে 4325 লিটার , এক কেজি বাটারে 5538 লিটার জল ।এক লিটার দুধ তৈরিতে 1000 লিটার, একটা ডিম তৈরিতে 196 লিটার, চকলেট তৈরিতে 7196 লিটার জল লাগে। এখানে গরু বা মুরগি পালনে শুধু নয় তারা যে খাদ্য গ্রহণ করে তা উৎপাদনে কতটা জল লাগে তার হিসাবও ধরা আছে ।খাবারের বিশ্বজনীনতাও হয়তো ঘুচে যাবে।খেতে হবে স্থানীয় খাবার।  কারণ পরিবহন যতদূর সম্ভব কমাতে হবে,দূষণের দিকে তাকিয়ে।তখন ফল হিসাবে আপেল,আঙ্গুর জুটবে না।ঠিক গল্পটির মত।

                            

কল্পকথা 

আসলে এইসব নিয়ন্ত্রণ  করে আমরা আরো কিছুদিন এই গ্রহটিতে বেঁচে থাকতে পারি।বাস্তবে এত সব কিছু হবেই না হয়তো । কারণ এই সব ফালতু ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় কোথায় রাষ্ট্রনায়কদের?  যে কোন ক্ষমতাসীন সরকার  অন্তত আমাদের দেশে শুধুমাত্র ক্ষমতাটুকু বাঁচিয়ে রাখতে তার সর্বশক্তি ব্যয় করে। পরিবেশের দিকে তাকানোর সময় তার নেই। পরিবেশপ্রেমীরা খুব চাপাচাপি করলে তারা দু একটা কাগজ টুকরোর অর্ডার বা নীতি ধরিয়ে দিতে পারে।জল সংরক্ষণ উৎসব করে দিতে পারে।কিন্তু সত্যি সংরক্ষণ?তাহলে তরজা করবে কখন? জল সংরক্ষণ দিয়ে মাতিয়ে রাখা যাবে কর্মীদের?জল সংরক্ষণ করতে হবে,করতে হবে স্লোগান দিলে মিছিল জমবে? ও সব করবে কতকগুলো পাগল পরিবেশপ্রেমী বা ছাত্রছাত্রীরা।একটা সমস্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে জনগণ আবার অন্য সমস্যা নিয়েও কথা বলবে।সে তো মহা সমস্যার ব্যাপার।তাছাড়া এই সব করলে অর্থনীতির কি হবে সেটাও একটা চিন্তার ব্যাপার অবশ্যই।          

অতঃপর  জেলিফিসের গল্প। এ গল্প কার লেখা জানিনা। সমুদ্রে অনেকগুলো জেলিফিস জেলেদের জালে ধরা পড়েছে। তারা সমুদ্রের কিনারে তাদের ফেলে দিয়েছে । জনৈক ব্যক্তি  একটি একটি করে জেলিফিস তুলে সমুদ্রে ফেলছে।পাস দিয়ে পেরিয়ে যেতে যেতে আর এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন  তুলে ফেলছেন কেন ? ওদের সবাইকে আপনি বাঁচাতে পারবেন?  সেই ব্যক্তি উত্তর দেন সবাইকে বাঁচাতে পারবো না এটা ঠিক। কিন্তু যে জেলি ফিসটা  জলে ফেললাম সে তো বেঁচে গেল। আসুন আমরা বালতি- মগে স্নান করি,ছাদের জল মাটির নিচে পাঠানোর সোক পিট বানাই,জল নষ্ট করা বন্ধ করি।সর্বোপরি জলা ভূমি,নিম্ন ভূমি  বোজানোর বেআইনি করবার বন্ধ করি। দু একটা জেলিফিস অন্তত বাঁচাই। তাতে যদি ধরিত্রী মায়ের ঋন একটু শোধ হয়! 

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments