উদয়ের পথে
মলয় সরকার
সপ্তম পর্ব
আমাদের আজকের গন্তব্য এর পর সুকিজি ফিস মার্কেটে।, যা বিশ্বের এক সেরা মাছের বাজার।
বর্তমানে আরো একটি আধুনিক বিশ্বসেরা মাছের বাজারের জায়গা হয়েছে, তার নাম (Toyosu Market), এটিও টোকিও তে।এখানে অবশ্য সাধারণ মানুষও যেতে পারেন। ২০১১ সালের পর থেকে সাধারণ মানুষের জন্য সুকিজি মার্কেটের মূল অংশে সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।বাইরের অংশে অল্প কিছু দেখার থাকে, আর ভিতরের অংশে বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ মানুষদের ঢুকতে দেওয়া হয়।সাধারণ সময়ে জনসাধারণকে আর ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
ইতিহাস খুঁজতে গেলে , সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্রাটদের মাছের জোগান দিতে এর জন্ম। তার পর বহুবার আগুন, ভূমিকম্পের প্রকোপে অনেক আকার, নাম ও স্থান পরিবর্তন করে শেষে ১১ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩৫ এই বাজার এখানে আসে।এখানে প্রায় নয়শ মত রেজিস্টার্ড দোকান আছে, এবং এখানে ছোট্ট সী উইড থেকে আরম্ভ করে ছোট প্রজাতির তিমি মাছ বা ৩০০ কিলো ওজনের টুনা পর্যন্ত বিক্রী হয়। সর্বোচ্চ ১৬২৮ টন পর্যন্ত মাছ একদিন বিক্রী হতে দেখা গেছে, যার দাম প্রায় ১৪০ লক্ষ USD । এখানে বাজার শুরু হয় রাত ৩টেয়, যখন শয়ে শয়ে ট্রাক, জাহাজ, প্লেন আসতে থাকে। এর মাছের জন্য নিলাম শুরু হয় ভোর ৫.২০ টায়, চলে সকাল ১০ টা পর্যন্ত।অনুমোদিত ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ এখানে কেনাকাটা করতে পারেন না।কাজেই ধারণা করাই যাচ্ছে, কি বিশাল কর্মযজ্ঞ হয় এখানে।
অগত্যা আমাদের এর বাইরেটা দেখেই খুশী থাকতে হল, যেখানে রয়েছে নানারকম রান্নার জিনিসপত্র, নানারকমের হোটেল, কিছু কিছু মাছের খুচরো দোকান,ইত্যাদি। আমি এর আগে আমেরিকার পাইক প্লেসের মাছের বাজার দেখেছি। সেটা দেখেই তখন দারুণ লেগেছিল। তবে এর বিশালত্বের কাছে সে তো নিতান্তই শিশু।তবে এখানে এসেছি আর কিছুই আস্বাদ নেব না তা তো হয় না। বেশ অনেক দোকানেই ডাকাডাকি করছে, তবে একটি দোকানে দেখি লোকে ঢোকার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতএব, ‘ মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন’ লভেছেন খাদ্য লোভনীয়-সেই পথ অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত মনে হল।
সুকিজি মার্কেটে কাটা মাছ
হোটেলটির সামনে দুটি জাপানী মূর্তি করা আছে, যারা মানুষকে আহ্বান করার ভঙ্গীতে, আমাদের এয়ার ইণ্ডিয়ার মহারাজার মত আর কি!। ঢুকে দেখি, ও বাবা! বিশাল ব্যবস্থা। দোতলায় নিয়ে গিয়ে বসালো। প্রত্যেকের বসার সিটেরে পিছনে কোট খুলে রাখার বা লাঠি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।যেতেই, প্রথমে বসিয়েই, ওদের চা দিয়ে গেল। চীন বা জাপানে দেখছি এই রীতি রয়েছে অনেক জায়গাতেই। হোটেলে আগে চা দেয়, এবং তা বেশ বড় পাত্রে। এটা আসলে দামের মধ্যে পড়ে না, এটা আপ্যায়ণ।
🍂
একটি পাত্রে গরম জলে শুধু চা ভেজানো থাকে, খুব হাল্কা লিকারের। তা ওরা , যতবার চাইবে, ততবারই দেয়।এখানে আমরা নিলাম এদের বিখ্যাত সুশি আর সঙ্গে দু একটা , কিছু অক্টোপাস ও সীফুডের পদ । সুশি সম্বন্ধে বোধ হয় আজকাল অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। জাপানী খাবার খাব আর সুশি খাব না ,এ হয় না। আসলে এটি আঠালো ভাতের (Sticky Rice) মোড়কে সাধারণতঃ কাঁচা স্যামন মাছের কুচি দেওয়া থাকে। কোথাও একটা কাঠিতে অনেক গুলো এরকম সুশি টুকরো গাঁথা থাকে, যা লোকে এক এক গ্রাসে, এক একটি খায়। কোথাও কাঠি ছাড়া পর পর সাজিয়ে দেয়। এর সঙ্গে ওয়াসাবি( ওয়াসাবি হল, এক ধরণের ভীষণ ঝাঁজালো সবুজ আদার মত জিনিস) বা ওই ধরণের কিছু থাকে।এর ব্যাখ্যায় আপাততঃ যাচ্ছি না।কারণ আজকাল সুশি এতই জনপ্রিয় হয়ে গেছে যে, তার ব্যাখ্যা দিতে যাওয়া বোকামি। তবে আমি এটা ভালই বাসি। এখানে খেয়ে মন এবং উদর দুটোই ভর্তি হয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে কিছু স্ট্রবেরীর আইসক্রীম নিয়ে মুখ শুদ্ধি করা হল।
সুকিজি মার্কেটের হোটেলে
একটু এগিয়ে দেখি একটা বিশাল বড় মাছ কাটা হচ্ছে মেসিনে। এখানে বড় মাছ সবই মেসিনে কাটা হয়। তাকে পরিচ্ছন্ন করে সুন্দর করে সাজানো। এখানে পরিচ্ছন্নতা একেবারে শহরের গায়ে আঠার মত আটকে আছে সর্বত্র। তার সঙ্গে এদের ভদ্রতাও চোখে পরার মত। দোকানে কিছু কিনতে গেলে ওরা সব সময় দুহাতে দেয় । তাও আবার সঙ্গে থাকে মাথা ঝুঁকিয়ে কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। আমি সব সময় ভেবেই চলেছি, একটা গোটা দেশ কি করে এমন সুন্দর হয়ে উঠতে পারে! এ কি কোন রাজনৈতিক নেতার চাপে , না ধর্মগুরুদের শিক্ষায়, না হলে কি ভাবে!! আমরা কি কখনও এরকম হতে পারব! না কি আমরা শুধু সবার ভালগুলো দেখেই যাব, নিজেরা কখনওই হতে পারব না, অন্ততঃ অনুকরণ করার চেষ্টাও করব না!
এখান থেকে আমরা যাওয়ার প্ল্যান করলাম, আকিহাবারায়। যদিও বুলুর পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ, ও ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে, তবু সাহস দিয়ে বলল, চল, দেখেই যাই।
গেলাম আকিহাবারায়। এটা আসলে একটা বিশাল ইলেক্ট্রনিক্সের বাজার।আসলে জায়গাটার নামকরণ হয়েছে দেবী আকিবার নাম থেকে, যিনি আগুনের দেবী। কারণ এই জায়গাটি ১৮৬৯ সালে এক বিধ্বংসী আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল চতুর্দিকের সমস্ত রাস্তায় খুব উঁচু উঁচু বহুতল বাড়িতে নানা ধরণের আলোকমালায় সাজানো বাজার। ফলে তরুণ প্রজন্ম এখানের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী। প্রতিটি বহুতলই নানা বিজ্ঞাপনের আলোয় একেবারে প্রচণ্ড রকমের আলোকসজ্জায় সজ্জিত।যেন কলকাতার দুর্গাপুজোর থেকেও বেশি আলোকিত।চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শুধু এই আলোই দেখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
হঠাৎ এল বৃষ্টি। সেই একই রকম ঝিরঝিরে বৃষ্টি।কাজেই রাস্তার ফুটপাথে লেগে গেল ভিড়, সবাই চাইছে একটু কোন দোকানের শেডের নীচেটা। আমরা চট করে একটা দোকানের ভিতর ঢুকলাম।
আকিহাবারায় দোকানে
ও বাবা ! এত বড় একটা দোকান , যা একটা বড় মলের মত, আমাদের এখানে পাওয়া মুস্কিল। অবশ্য এটা খুব নামী দোকানগুলোর একটাও নয়।এর প্রতি তলায় এস্ক্যালেটরে যাওয়া যায়। তা ছাড়া এক এক তলায় এক এক ধরণের জিনিসের সম্ভার। ভেবেছিলাম, যে জাপান এতদিন ধরে ইলেক্ট্রনিক্সের বিশ্ববাজার কাঁপিয়ে আসছে। তাকে একটু না দেখে যাই কি করে! তাই এই তাদের রাজধানীতে খোদ ইলেক্ট্রোনিক্সের আড্ডায় পদার্পণ করার ইচ্ছা।এখানে ছোট দোকান থেকে শুরু করে কত শয়ে শয়ে দোকান আছে বলা মুস্কিল। এখানে সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই জ্বলে ওঠে নানা রঙে রঙীন এনিমেটেড বিলবোর্ড, নিয়ন সাইনের পসরা। ভিডিও গেম, নানা রকমের আওয়াজ, গান আলোর ঝলকানিতে জমজমাট হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। Chuo dori হল এখানকার প্রধান রাস্তা, যেখানে সমস্ত দোকান থাকায় ভীড় প্রচণ্ড। বড় দোকানের মধ্যে Sofmap,Laox, Akky, Yodobashi electronic Store বেশ নামী দোকান। সেই ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি ইয়াশিকা ক্যামেরা, নিকন ক্যামেরার কথা, এছাড়া আরও কত শত জাপানী ইলেক্ট্রনিক জিনিষের কথা। তার উৎসে কখনও পৌঁছাব জীবনেও ভাবিনি। রাত্রিবেলা এই সব দেখে মনে হল, এক স্বপ্নপুরীতে এসেছি। ভাবলাম কিছু কিনে নিয়ে যাই। কিন্তু এত রকমের জিনিসের মাঝে খেই হারিয়ে কিছুই না কিনে বেরিয়ে এলাম।
চলুন যাব, এর পরে কি দেখা যায়–
0 Comments