জ্বলদর্চি

তালগাছ /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১০
তালগাছ

ভাস্করব্রত পতি

জটি পিসিমা সামনেই দাঁড়িয়ে। তিনি গ্রামের নটবর মুখুজ্যের স্ত্রী, ভালো নাম হরিমতী; গ্রামসুদ্ধ ছেলে মেয়ে তাঁকে ডাকে জটি পিসিমা।
পিসিমা বললেন, “কীরে"?
“তাল নেবে পিসিমা"?
“হ্যাঁ, নেব বই কী। আমাদের তো দরকার হবে মঙ্গলবার।”
ঠিক এই সময় দাদার পিছু পিছু গোপালও এসে দাঁড়িয়েছে। জটি পিসিমা বললেন, “পেছনে কে রে? গোপাল? তা সন্ধেবেলা দুই ভায়ে গিয়েছিলি কোথায়?”
নেপাল সলজ্জমুখে বললে, “মাছ ধরতে"।
“পেলি"?
“ওই দুটো পুঁটি আর একটা ছোটো বেলে… তাহলে যাই পিসিমা"?
“আচ্ছা এসোগে বাবা, সন্ধে হয়ে গেল; অন্ধকারে চলাফেরা করা ভালো নয় বর্ষাকালে।”
জটি পিসিমা তাল সম্বন্ধে আর কোনো আগ্রহ দেখালেন না বা তালনবমীর ব্রত উপলক্ষ্যে তাদের নিমন্ত্রণ করার উল্লেখও করলেন না,— যদিও দুজনেরই আশা ছিল হয়তো জটি পিসিমা তাদের দেখলেই নিমন্ত্রণ করবেন এখন। দরজার কাছে গিয়ে নেপাল আবার পেছন ফিরে জিগ্যেস করলে, “তাল নেবেন তাহলে”? 
কাঁসাই নদীর বুকে দোকাণ্ডা গ্রামে গাঁদা ফুলের জমিতে বিখ্যাত চারটি তালগাছ

মনে পড়ে এই গল্পের কথা? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুন্দর একটি গল্প 'তালনবমী'র কাহিনী পল্লবিত হয়েছে 'তালনবমী' নামক একটি লৌকিক উৎসবকে প্রাধান্য দিয়ে। এই তালনবমী লৌকিক উৎসব পালনের জন্য প্রয়োজন হয় ঘট, কলসী, ধূপ, দীপ, ফুল, নৈবেদ্য, ৯ ধরনের ফল ও নানা রকমের মিষ্টান্ন। এই ব্রতে তালফল দান করাই প্রধান কর্তব্য। এছাড়া খেজুর, এলাচি, হরিতকি, নারিকেল, সুপারি, কাঁঠালি কলা, ডালিম, তাল নিয়ে নয় প্রকার ফলদান করা হয়। এটি উদ্‌যাপনের সময় ব্রাহ্মণকে একখানি নতুন কাপড় ও ১ টি টাকা দক্ষিণা দিতে হয়। 'ভারতকোষ'তে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখেছেন, "কোনও কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তালের ব্যবহার দেখা যায়। ভাদ্র মাসের শুক্লা নবমীতে তালনবমী ব্রতের ব্যবস্থা আছে। এই ব্রতের প্রধান উপকরণ তাল। ইহাতে তালের উপরেই পূজা করা লৌকিক ব্যবহার। এই ব্রত উপলক্ষে দেবতাকে তাল ও তালের পিঠা দেওয়া হয় এবং ব্রাহ্মণকে তাল দান করা হয়। জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব উপলক্ষে তালের বড়া খাওয়ার রীতি আছে। ভাদ্র মাসে দেবতাকে তাল দেওয়ার নিয়ম আছে। অথচ, এই সময়ে তাল খাওয়া অনেকে বৈধ বলিয়া বিবেচনা করেন না"। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বর্ষাকালের চারমাসকে বলা হয় 'চাতুর্মাস্য'। এই সময় মানুষকে নানাবিধ নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং অনেক কিছু খাওয়ার জিনিস ত্যাগ করার বিধান রয়েছে। চিন্তাহরণ চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন, "সাধারণ নিয়ম এই যে এই কালের রুচিকর ফলমূল ত্যাগ করিতে হইবে। বিশেষ করিয়া শ্রাবণ মাসে শাক, ভাদ্রে দধি, আশ্বিনে দুগ্ধ ও কার্তিকে আমিষ বর্জনীয়। পটোল, বেগুন ও কলমীশাকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কোনও কোনও বিধবা এই সময়ে তাল ভক্ষণ করেন না"। 
পাকা তাল

একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নেওয়া হয় প্রথমে। সেখানে মণ্ডপ তৈরি করে সুচারু হাতে আলপনা দেওয়া হয়। ঐ আলপনার ওপর ঘট বসিয়ে লক্ষ্মী নারায়ণের পুজো হয়। তালের পাঁকি (রস) দিয়ে পিঠে তৈরি করে সকালে নারায়ণের প্রসাদ বা ভোগ নিবেদন করা হয়। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তাঁর 'তালনবমী' গল্পে উল্লেখ করেছেন এই 'তালের বড়া'র কথা। এই গল্পে ক্ষুদিরামের বড় ছেলে 'নেপাল' তাঁর ভাই 'গোপাল'কে বলতে শোনা যাচ্ছে, "তালনবমীর বের্তোয় তালের বড়া করে তুই জানিস"?
তালের রস

এরপর ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর রীতি প্রচলিত। সারাদিন উপোস থেকে সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার পর এই উপোস ভঙ্গ করতে হয়। এই সময় এয়োস্ত্রীরা তাঁদের স্বামীকে ঐ প্রসাদ ভোগ খাইয়ে ব্রাম্ভণ বা ব্রাহ্মণীকে পিঠা ভোজন করাবে।  সবশেষে স্বামীর এঁটো পাতে নিজে আহার করবে। এটি টানা নয় বছর ধরে করতে হয়। এটি পালন করলে এয়োস্ত্রীদের কোনো দুঃখ কষ্ট থাকে না এবং তাঁরা সবসময় স্বামী সোহাগী হয়ে থাকে। এছাড়াও পুত্রলাভ হয় এবং স্বর্গবাসের সুযোগ মেলে। সঞ্চিত পাপরাশি বিলুপ্ত হয়। 
তালের গুলগুলি

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "ভাদ্রমাসে শুক্লা নবমী তিথিতে অনেক মহিলাকে "তালনবমী' ব্রত করতে শুনেছি। এটি মূলত লক্ষ্মী নারায়ণের পুজো আর তাল ফলটি নারায়ণকে দান করে তবেই খাওয়ার রীতি। তালের পিঠে, তালক্ষীর ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। এই তালনবমীর ব্রতকথা যেন আজকের দিনের টেলিভিশনের মেগা সিরিয়ালের মত‌ই। শুধু কুশীলব হলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আর তাঁর দুই প্রিয়তমা সপত্নী... সত্যভামা ও রুক্মিণী। দুই সতীনের মন কষাকষি, স্বামীকে একান্তে না পাওয়া নিয়ে। কৃষ্ণের প্রতি কার অধিকার বেশী তাই নিয়ে। অবশেষে এক ঋষির পরামর্শে সেই সতীন কাঁটা দূর করে এই তাল নামক ফলটি। ঋষির আদেশ মাথায় নিয়ে সত্যভামা পরপর ন'টা বছর ধরে এই তালনবমী ব্রত পালন করে স্বামীকে পেয়েছিলেন নিজের করে। মানে আর কি তালের রসে বশীকরণ।  স্বামীকে নিজের হাতে তালের পিঠে ইত্যাদি সুস্বাদু রেঁধে খাইয়ে তবে বশ করতে হয়েছিল বলে এই ব্রতের নাম 'তালনবমী'। ঐ আর পাঁচটা ব্রতের মত‌ই এর সুফল হল সৌভাগ্য লাভ, সুখবৃদ্ধির মত‌ই। তবে এয়োস্ত্রীরাই কেবল করতে পারবেন কেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয়। জগত সংসারে কি তবে যত দুঃখ এদেরই থাকবে? বাকী সব মেয়েরা মানে আইবুড়ো, বিধবা কিম্বা নিঃসন্তান অথবা সিঙ্গল মাদার কি বানের জলে ভেসে এল না কি এদের সুখ, সৌভাগ্যের প্রয়োজন নেই"?
শাখাতাল

এই তালকে আমরা চিনি দীর্ঘপত্র, লেখ্যপত্র, গুচ্ছপত্র, তরুরাজ, দীর্ঘপাদপ, তুনরাজ, ধ্বজা, মদাঢ্য, মধুরস, তৃণরাজ, দীর্ঘস্কন্ধ, চিরায়ু, মহােন্নত নাম। এছাড়া ওড়িয়াতে তাড়, তামিলে পনম, ফারসিতে তাল, অসমীয়া তার, হিন্দিতে তাড় নামে ডাকা হয় কবিগুরুর সেই বিখ্যাত— ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে'। তাল নিয়ে একটি কুসংস্কারের দরুণ (তাল তেঁতুল কূল / তিনে বংশ করে নির্মূল) অনেক লােকজন অবশ্য বংশনাশের ভয়ে তালগাছ লাগায়না'!

'তালনবমী' কিভাবে চালু হল? তা নিয়ে একটা সুন্দর কাহিনীর সন্ধান মেলে। সেটা ছিল দ্বাপর যুগের সময়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রুক্মিণী এবং সত্যভামা নামে দুই স্ত্রী ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য রুক্মিণীকেই বেশি ভালবাসতেন। তাই সত্যভামার মনে সবসময় দুঃখ ছিল। মনোকষ্টে সত্যভামা একদিন তপোবনে গিয়ে একজন তপস্বীকে নিজের দুঃখের কথা নিবেদন করলেন। কী উপায়ে তাঁর এই মনোকষ্টের উপশম হবে তার পথ বাতলে দিতে অনুরোধ করলেন। তপস্বী তখন বললেন, “শোনো মা, তুমি যে কোনও একটি ব্রত সঠিকভাবে পালন কর। এতে তোমার মনে আর কোনো দুঃখ কষ্ট স্থান পাবে না”। সত্যভামা তখন জানতে চাইলেন সেই ব্রতের নাম। তিনি আস্বস্ত করলেন যে সেই ব্রতের নিয়ম জানতে পারলে তারপর থেকে তিনি সেই ব্রত পালন করবেন সুদৃঢ়ভাবে।
 
তপস্বী জানালেন, “এই ব্রতটির নাম তালনবমী। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্মী নারায়ণের পুজো করতে হয়। এই তালনবমীতে অবশ্যই তাল ফল দদান করতে হবে। এটাই বিধান। এটি পালনের উপচার হিসেবে সধবা স্ত্রীলোকেরা প্রথমে নিজের স্বামীকে খুব যত্নের সঙ্গে পিঠে তৈরি করে খাওয়াবে। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর পর শেষকালে নিজেরাও খাবে। যদি ন’বছর ধরে ঠিক নিয়ম এবং নিষ্ঠার সঙ্গে এই ব্রত পালন করে উদ্‌যাপন করা যায়, তবে ছেলে নাতি নাতনী ও প্রচুর ধন সম্পত্তি বৃদ্ধি হবেই। সৌভাগ্য উপচে পড়বে বাড়িতে"। 

সবকিছু জানার পর সত্যভামা বাড়িতে ফিরে এলো। উপচারের বিধান মতো ন'বছর ধরে একটানা তাল নবমীর ব্রত উদযাপন করলেন। একসময় সন্তুষ্ট হয়ে নারায়ণ তাঁর কাছে না এসে পারলেন না। সত্যভামাকে বললেন, “এবার তোমার দুর্ভাগ্যের দিন শেষ। তোমার মনকষ্ট এবার আর থাকবে না। আমি বর এবং অভয় দিচ্ছি যে তুমি সৌভাগ্যবতী হয়ে খুব সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারবে”। 

সেই থেকে সত্যভামার মনে আর কোনো দুঃখ থাকলো না। শ্রীকৃষ্ণের নিপাট প্রেম ভালবাসা এবং আদর পেয়ে মধুর অনুভূতি নিয়ে তিনি দিন এবং রাতের আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। আর জগৎ সংসারে চালু হল তালনবমী। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে এই উৎসব পালন করতে হয়। এটি একটি শাস্ত্রীয় ব্রত বা পৌরাণিক ব্রত। 

'পামি' গােত্রের BORASUS FLABELIFER বা তাল বেশ জনপ্রিয় গাছ। হরিবংশের কাহিনীতে মেলে ভারত ছিল ব্রম্ভাবর্ত দেশেরই একটা অংশ। আর তালজঙ্ঘ দেশের প্রজামাত্রের নাম ছিল তালজঙ্ঘি। একসময় সগর রাজা মহাবিক্রমে এই তালজঙ্ঘ এবং শক সেনাদের নিপাত করেন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই তাল নামটি কি বৈদিক যুগ থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে? অথর্ববেদের বৈদ্যকল্পতে পাওয়া যায় তালের নাম। সেখানে তাল হল প্রাণ সঞ্জীবনী সুধা। অনেকেই তালরস পান করেন সুরা হিসেবে। গ্রামবাংলায় একে বলে 'তাড়ি'। চরক শুশ্রুতের সংহিতাগুলিতেও মেলে এই তালরসের কথা। বৈদিক সূক্তিতে বলা হয়েছে তালবৃক্ষের রসই সুরা বা মদ্য। তবে এই রসে যতক্ষণ সূর্যের আলো না পড়বে ততক্ষণ এটি সুরা হিসেবে পরিগণিত হয়না। অথর্ববেদের বৈদ্যকল্পের ৫৫/১৬২/৭০ নং সূক্তে আমরা পাই --
“যত্তে সোম দিবি শিখা যৎ পৃথিব্যাং যদুরবেন্তরিক্ষে। তেনাস্মৈ তর্পয়তি প্রাণং তলস্তং চক্ষুর্মে তপয়তি প্রজাম্"॥
এই সূক্তটির মহীধর ভাষ্য করা হয়েছে -- "তলস্তু উপরি প্রতিষ্ঠা, তস্যৈব পূষোদরাদিত্বাৎ পর্ব্বাগমঃ তাল ইতি। যদা সুরাঃ সুরা ইতি মদ্যং তেজঃ বলং যেষাংতে, তেষাং সুরাণাং বলাধানপ্রিয়ত্বাৎ তর্পণাত্মকং তদেব তালরসং উপনিরীক্ষ্য দেবা ব্রবন্তি, হে তল! তব শিখা দিবি দ্যুলোকে, তব যংতেজঃ ঊরৌ বিস্তীর্ণং অন্তরিক্ষে শরীর রক্ষণং তদাখ্যেন পৃথিব্যাং এব তিষ্ঠতি। তেন তেজসা তপয়তি প্রাণং, তপয়তি প্রজাং চক্ষুশ্চ অস্মাকমিতি"।এটির বঙ্গানুবাদ করেছেন আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর 'চিরঞ্জীব বনৌষধি' গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, "তল শব্দ থেকে তাল। তলের অর্থ উপরিভাগে প্রতিষ্ঠা। পূষোদরাদিত্বে অ স্থানে আ। সেই তল বা তাল বৃক্ষের প্রশস্তি ক'রেছেন দেববৃন্দ। ওহে তল! তোমার উপরিভাগে অর্থাৎ দ্যুলোকে প্রতিষ্ঠা। তাই তোমার শিখা উপরিভাগে। তোমার তেজ পৃথিবীর অভ্যন্তরে তাই সেই তেজ তোমার ঊরদেশে এবং শিখায় ও অন্তরিক্ষে ধারণ ক'রে আছ। তোমার সেই তেজ আমাদের বলরক্ষণ করে। তোমার তেজ আমাদের প্রাণ, চক্ষু ও প্রজাকে তর্পিত করে"।

বহু মানুষের রুজিরুটি নির্ভর করে তালপাতার হাতপাখা এবং গেখুয়া বা মাথালি বিক্রি করে। তালের রস থেকে গুড় তৈরিতেও যুক্ত অনেকে। এই রস গেঁজিয়ে বানানাে তাল তাড়ি নেশাখােরদের পরম উপাদেয় দ্রব্য। এরাজ্যের বহু জায়গায় উৎকল ব্রাহ্মণ এবং ওডিশা প্রদেশের লােকজনের বসবাস রয়েছে। তাই এখানে তালের রস (কথ্য ভাষায় বলে 'পাঁকি') দিয়ে নানারকম পিঠে তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। যেমন পােড়া পিঠে, তালের বড়া, তালের রুটি, গুলগুলি ইত্যাদি। সূর্যকান্ত মাহাতো জঙ্গলবাসী মানুষজনের রুচিতে তালের অনুপ্রবেশ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, "জঙ্গলমহলবাসীদের আরও একটি পছন্দ হল, তালের 'পাতা সেদ্ধ'। শাল পাতা, টগর পাতা, কাঁঠাল পাতা, কলা পাতা ছাড়াও অন্য পাতা ব্যবহার করা হয় তালের এই পাতা সেদ্ধ পিঠে বানাতে"। এছাড়াও তাল থেকে তৈরি হয় নানা রকমারি পদ, যেমন -- তালের খাগরা, তালের রসবড়া, তালের পায়েস, তালের বোঁদে, তালের সিঙাড়া, তালক্ষীর, তালের বরফি, তালের মালপোয়া, তালের মাতির হিঙ্গি, তালের লুচি, তালের পেঁড়া, তালের কেক, কচুরি, মোমো ইত্যাদি। এখন দক্ষিণ ভারতের ত্রিবান্দ্রমে মেলে তালের জেলি। ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ কমিউনিকেশন অ্যাণ্ড সার্ভিসেস সেন্টার (DRCSC) কলকাতার বুকে শুধুমাত্র তালকে কাজে লাগিয়ে রকমারি খাদ্য তৈরি ও বিক্রির আয়োজন করেছিল 'তাল উৎসব' নামে। 

একসময় পড়ুয়ারা তালপাতাতেই লিখত। তাঁদের অক্ষরজ্ঞান এতেই হত। ছড়ায় আছে --
"লিখছে যাঁরা তালপাতাতে
খাগের কলম বাগিয়ে হাতে
তালবড়া দাও তাঁদের পাতে.... "
তালপাতার পুঁথির কথাও আমরা জানি। যা আজও সমান আকর্ষণীয় গবেষকদের কাছে। আর তীব্র গরমে গ্রামবাংলার মানুষের হাতিয়ার এখনও রয়েছে এই তালপাতার পাখা। এই 'বাতাসিয়া' যন্ত্রটির নানা আদুরে নাম লক্ষ্য করা যায়। যেমন -- চন্দ্রমুখী, সূর্যমুখী, গোলাপবালা, বাতাস রাণি ইত্যাদি। শুধু মানুষ নয়, পবনদেবের এই বাহনরাণিকে দেবদেবীর পূজাতেও তাঁদের বাতাস করার জন্য কাজে লাগানো হয়। একসময়কার 'রাজপাখা' র কথা তো ভুলে গেলে চলবে না। তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘর আজও বহু মানুষের মাথাচ্ছাদনের অন্যতম সামগ্রী। তালের গুঁড়ি কুঁদে কুঁদে চেঁছে তৈরি তেলোডোঙা গ্রামবাংলার অন্যতম জলযান। একসময় মাটির বাড়ি তৈরির জন্য কড়ি বরগা হিসেবে বেছে নেওয়া হত তালের কাঠ। খুব মজবুত হত ঘরের পক্ষে। পাকা তালের রসের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কাঁচা অবস্থায় তালের শাঁস বেশ উপাদেয় খাদ্য। গরমের সময় এটি যেন উষ্ণতা নিরোধক। এই কচি তাল শাঁসের মতো বাজারে মিষ্টি দোকানে মেলে জলভরা তালশাঁস সন্দেশ। পাকা তাল খেয়ে নেওয়ার পর তালের আঁটি মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। কিছুদিন পরে ঐ আঁটি থেকে শেকড় গজায়। তখন ঐ আঁটিকে কাটারি দিয়ে চিরে ভেতর থেকে বের করা হয় সাদা নরম 'গজড়' বা 'কলাটি'। এটি বিভিন্ন পূজোয় নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। বাংলার বেশকিছু লোকোপচারে এই গজড়ের ব্যবহার দেখা যায়। তালশাঁস বেশ উপকারী। পিত্তনাশ করে। হেঁচকি ওঠা বন্ধ করে। এটি বাতঘ্ন। অর্থাৎ, বাত কমিয়ে দেয়। কফ নাশ করে। শরীর ঠাণ্ডা করে। তালে রয়েছে ভিটামিন সি। মুত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। 

পরিবেশ বাঁচাতে আমাদের প্রয়োজন বিভিন্ন খোলা জায়গায় তালগাছ লাগানো। নদীর ধারে, জমির আলে, পোড়ো জায়গায় লাগালে ভূমিক্ষয় রোধ হয়। আর তালগাছ তো বাবুইয়ের বাসা বাঁধার আস্তানা। তালগাছের অভাবে বাবুইদের অস্তিত্বেও মহা সংকট তৈরি হয়েছে। 
মেদিনীপুরের বহু বাড়িতেই ঘটা করে পালিত হয় 'তালনবমী' ব্রত। বিভূতিভূষণের তালনবমী গল্পের জটি পিসিমা যেন আরও জনপ্রিয় করে তুলেছেন এই লৌকিক উৎসবটিকে ---
গোপাল বললে, “কোথায় যাচ্ছিস তোরা”? 
“জটি পিসিমাদের বাড়ি তালনবমীর নেমন্তন্ন খেতে। করেনি তোদের? ওরা বেছে বেছে বলেছে কিনা, সবাইকে তো বলেনি…”। 
গোপাল হঠাৎ রাগে, অভিমানে যেন দিশেহারা হয়ে গেল। রেগে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “কেন করবে না আমাদের নেমন্তন্ন? আমরা এর পরে যাব…”। 
রাগ করবার মতো কী কথা সে বলেচে বুঝতে না পেরে কুড়োরাম অবাক হয়ে বললে, “বা রে! তা অত রাগ করিস কেন? কী হয়েছে”? 
ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গোপালের চোখে জল এসে পড়ল — বোধ হয় সংসারের অবিচার দেখেই। পথ চেয়ে সে বসে আছে ক'দিন থেকে। কিন্তু তার কেবল পথ চাওয়াই সার হল! তার সজল ঝাপসা দৃষ্টির সামনে পাড়ার হারু, হিতেন, দেবেন, গুটকে তাদের বাপ কাকাদের সঙ্গে একে একে তার বাড়ির সামনে দিয়ে জটি পিসিমাদের বাড়ির দিকে চলে গেল…....!

🍂

Post a Comment

0 Comments