জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -১০৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ১০৮
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত


বিবেকানন্দের পরিব্রাজক জীবনের চিত্রটি অতি সংক্ষিপ্তাকারে ফরাসি মনীষী রোমাঁ রোল্যাঁর লেখনীতে এইরকম--
‘His itinerary led him through Rajputana, Alwar (February to March, 1891),Jaipur, Ajmere, Khetri, Ahmedabad and Kathiawar (end of September), Junagad and Gujerat, Porebander (a stay of between eight and nine months), Dwaraka, Palitana — the city of temples close to the gulf of Cambay, the State of Baroda, Khandwa, Bombay, Poona, Belgaum (October, 1892), Bangalore in the State of Mysore, Cochin, Malabar, the State of Travancore, Trivandrum, Madura. . . . He travelled to the extreme point of the immense pyramid, where is the Benares of Southern India, Rameswaram, the Rome of the Ramayana, and beyond to Kanyakumari, the sanctuary of the Great Goddess (end of 1892).’ ( The Life Of Vivekananda And The Universal Gospel by Romain Rolland )
🍂

ভারতবর্ষকে স্বামীজী চিনেছিলেন প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজীর ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাবলীর প্রথম খণ্ডের ভূমিকাটি তাৎপর্যপূর্ণ -- “ভারতবর্ষের নিজের দিক দিয়া এই ক্ষুদ্র ভাষণটি ছিল  স্বাধিকার-প্রতিষ্ঠার এক সংক্ষিপ্ত প্রমাণপত্র। বক্তা হিন্দু ধর্মকে সামগ্রিকভাবে বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন, কিন্তু ‘বেদ’ শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই উহার ধারণাকে অধ্যাত্ম-তাৎপর্য তিনি পূর্ণ করিয়া দেন। তাঁহার নিকট -- যাহা সত্য, তাহাই ‘বেদ’। তিনি বলেন, ‘বেদ-শব্দের দ্বারা কোন গ্রন্থ বুঝায় না, উহা দ্বারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদ্বারা আবিষ্কৃত সত্যমূহের সঞ্চিত ভান্ডারই বুঝায়।’ প্রসঙ্গতঃ তিনি সনাতন ধর্ম সম্বন্ধে তাঁহার ধারণাও ব্যক্ত করিয়াছেন: ‘যাহার তুলনায় বিজ্ঞানের অতি আধুনিক আবিষ্কারসমূহও প্রতিধ্বনির মতো মনে হয়, সেই বেদান্তদর্শনের আধ্যাত্মিকতার উত্তুঙ্গ সঞ্চরণ হইতে আরম্ভ করিয়া বিভিন্ন পুরাণসমন্বিত নিম্নতম মূর্তিপূজা, বৌদ্ধদের অজ্ঞেয়বাদ, জৈনদের নিরীশ্বরবাদ পর্যন্ত  সবকিছুই হিন্দুধর্মে স্থান পাইয়াছে।’ তাঁহার চিন্তায় এমন কোন সম্প্রদায়, এমন কোন মতবাদ --  ভারতবাসীর এমন কোন অকপট আধ্যাত্মিক অনুমতি থাকিতে পারে না, যাহা যথার্থভাবে হিন্দুধর্মের বাহুপাশের বহির্ভূত হইতে পারে -- ব্যক্তিবিশেষের নিকট ঐ সম্প্রদায়, মতবাদ বা অনুভূতি যতই বিপথগামী বলিয়া মনে হউক। তাহার মতে ইষ্টদেবত-বিষয়ক শিক্ষাই হইল ভারতের এই মূল ধর্মভাবের বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজের পথ বাছিয়া লইবার এবং  নিজের পথে ভগবানকে অন্বেষণ করিবার অধিকার আছে। ... কিন্তু এই সর্বাবগাহিত্ব -- প্রত্যেকের এই স্বাধীনতা হিন্দু ধর্মের মহিমা বলিয়া পরিগণিত হইত না, যদি না মধুরতম আশ্বাসপূর্ণ এই পরম আহ্বান তাহার শাস্ত্রে ধ্বনিত হইত; ‘শোন অমৃতের পুত্রগণ, যাহারা দিব্যধামবাসী তাহারাও শোন! আমি সেই মহান পুরাণ পুরুষের দর্শন পাইয়াছি -- যিনি সকল অন্ধকারের পারে, সকল অজ্ঞানের ঊর্ধ্বে! তাঁহাকে জানিয়া তোমরাও মৃত্যু অতিক্রম করিবে।’ এই তো সেই বাণী, যাহার জন্য বাকি সবকিছু আছে এবং চিরদিন রহিয়াছে। ইহাই হইতেছে সেই পরম উপলব্ধি, যাহার মধ্যে অন্য সব অনুভূতি মিশিয়া যাইতে পারে।”
আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সাহিত্য সেবিকা এবং বিশ্ববরেণ্যা মহিলা শ্রীযুক্তা এল্লা হুইলার উইলকক্স ১৯০৭ সালের ২৬ মে তারিখে ‘নিউ ইয়র্ক আমেরিকান’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ সম্বন্ধে এই কথাগুলি প্রকাশ করেন: “ বার বৎসর আগে হঠাৎ একদিন খবর পাইলাম, আমার বাড়ি হইতে এক ব্লক দূরে ভারত হইতে আগত জনৈক দর্শনাচার্য -- বিবেকানন্দ নামক এক ব্যক্তি বক্তৃতা দিবেন। আমরা ( আমি ও আমি যে পুরুষের উপাধি স্বীকার করিয়াছি, তিনি ) কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য চলিলাম  এবং  শ্রোতৃমণ্ডলীমধ্যে দশ মিনিট বসিয়া থাকিতে না থাকিতে আমাদের মনে হইল, আমরা যেন এমন এক সূক্ষ্ম জগতে উন্নীত হইয়াছি যাহা এত জীবন্ত ও চমকপ্রদ যে, আমরা মন্ত্রমুগ্ধ এবং প্রায় রুদ্ধনিঃশ্বাস হইয়া বক্তৃতার শেষ পর্যন্ত বসিয়া রহিলাম। যখন উহা শেষ হইল, তখন আমরা দুইজন নবীন সাহস, নতুন আশা, অভূতপূর্ব বল, অভিনব বিশ্বাস লইয়া জীবনের দৈনন্দিন ভাগ্য পরিবর্তনের সহিত মোকাবিলা করিতে বাহিরে আসিলাম। পুরুষটি বলিয়া উঠিলেন, ‘এই দর্শন, ভগবান সম্বন্ধে এই ধারণা, এই ধর্মই তো আমি খুঁজিয়া বেড়াইতেছিলাম।’ তারপর তিনি আমার সঙ্গে যাইতেন বিবেকানন্দের মুখে সেই পুরাতন ধর্মের ব্যাখ্যা শুনিতে এবং তাহার অত্যাশ্চর্য মনোভাণ্ডার হইতে সত্যের মণিসমূহ এবং সাহায্যকারী ও শক্তিপ্রদ চিন্তারাশি আহরণ করিতে। ইহা সেই ভয়ংকর শীত ঋতুর কথা যখন অর্থজগতে সর্বনাশ ঘটিতেছে, ব্যাংক বন্ধ হইয়া যাইতেছে ও বিধ্বস্ত বেলুনের ন্যায় কোম্পানির কাগজের দাম ভূমিস্পর্শ করিতে চলিয়াছে, ব্যবসায়ীরা হতাশার অন্ধকার উপত্যকামধ্যে পথ বহিয়া চলিয়াছেন এবং গোটা জগৎটাই যেন মনে হইতেছে ওলট-পালট হইয়া গিয়াছে -- ঠিক তেমনি এক যুগ যার দিকে ঠিক আজও আমরা অগ্রসর হইতেছি। এই অনেক সময় বহু বিনিদ্র রজনী যাপনের পর পুরুষটি আমার সহিত স্বামীজীর বক্তৃতা শুনিতে যাইতেন এবং তারপর তিনি বিষাদময় শীতের অন্ধকারে নামিয়া আসিয়া হাসিমুখে রাস্তা ধরিয়া হাঁটিয়া চলিতেন আর বলিতেন, ‘সব ঠিক আছে; দুশ্চিন্তার কোন কারণ নাই।’ আর আমিও আমার কর্তব্য ও আমোদ-আহ্লাদে ডুবিয়া যাইতাম ঠিক তেমনি আত্মাসম্বন্ধে উন্নততর ধারণা ও সম্প্রসারিত দৃষ্টি লইয়া। অত্যধিক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার এই যুগেও যে ধর্ম বা যে দর্শন মানুষের জীবনে এইরূপ ব্যাপার ঘটাইতে পারে এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে ভগবানের প্রতি তাহাদের অধিক বিশ্বাস জন্মাইতে পারে, মানবসাধারনের প্রতি সহানুভূতি বাড়াইতে পারে এবং ভাবী জীবনগুলির কথা ভাবিতে একটা বিশ্বাসপূর্ণ আনন্দে মন ভরিয়া তুলে, সে ধর্ম নিশ্চয়ই উত্তম ও মহান।” ( যুগনায়ক বিবেকানন্দ, দ্বিতীয় খণ্ড, স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত )

Post a Comment

0 Comments