জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ৮/স্বপন কুমার দে

চিত্র - শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৮

স্বপন কুমার দে

মল্লিকার ফাইনাল সেমিস্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছে। মল্লিকার রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে। এবার সে এম এস সি করতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো সব হয় না। অনেক চাওয়া, না পাওয়ার ঘরে আটকা পড়ে। কত স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। বিশেষত মল্লিকার মতো অতি সাধারণ দরিদ্র অবলম্বনহীন মানুষের ক্ষেত্রে তো বটেই। তাই ভাবনার পাহাড় চেপে বসে মল্লিকার মাথায়।

সেদিন রাত্রিবেলায় খাওয়া দাওয়ার পরে বাপ- বেটিতে মিলে কত কথা, কত পুরানো স্মৃতিচারণা হল। মনে পড়ল মায়ের কথা। ছোট্ট একরত্তি মেয়েটাকে নিয়ে কত স্বপ্ন, কত আশা ছিল তাঁর। সবদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়া,নিয়ে আসা,সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসানো-- সবেতেই মা।আজ মল্লিকা একটা মাইল ফলক পেরোতে পেরেছে। নিজেকে সকলের কাছে চিনিয়েছে মেধা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে। কিন্তু এই সাফল্যের সর্বাংশ জুড়ে রয়েছে তার মা।
" আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকত...."
বাবা ও মেয়ে দু'জনের চোখ জলে ভরে যায়। ভাঙা গলায় কথা বলতে গিয়েও শেষ করতে পারে না। শুধু একদৃষ্টে দেওয়ালে টাঙানো মল্লিকার মায়ের ফটোটার দিকে চেয়ে থাকে। আজ তার মেয়ে বাজার থেকে রজনীগন্ধার একটা মালা কিনে এনে মায়ের ফটোতে পরিয়ে দিয়েছে।
একে একে অনেক কথা এসে যায়। বাবা কিছুটা চিন্তাগ্রস্ত হয়," কিন্তু এরপর কী হবে মা? তোকে তো এবার থামতে হবে। আমিই বা আর ক'দিন? এবার তো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।"
" তার মানে?" আকাশ থেকে পড়ে মল্লিকা।আমি এত পরিশ্রম করে যে অনার্স পাশ করলাম, তার পুরস্কার হল এই। আমাকে বিয়ে করতে হবে। এতদূর পড়াশোনা করার কোনও দামই রইল না।"
" পড়াশোনার দাম বলতে তুই বলতে চাইছিস, চাকরি। কিন্তু তার জন্য দরকার আরও অনেক সময়, ধৈর্য্য, পরিশ্রম। তারপরেও যে সফল হবি, তার গ্যারান্টি কোথায়? ততদিনে তো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তার মধ্যে আমার কিছু একটা যদি ঘটে যায় তখন তোর কী হবে? একা একা মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়? ভেবে ভেবে অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুম আসে না। তোকে এবার একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে মা।"

বাবার নিদ্রাহীন চোখের অস্থিরতা মেয়ের মনে উদ্বেগের জন্ম দেয়। বাবা যে কথাগুলো বলছে সেগুলো তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করবার জন্য।  প্রত্যেক বাবা মা-ই চান ,মেয়ের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়, যার ছায়ায় সে সুখী ও সম্পদশালী হয়ে উঠবে।

কিন্তু মল্লিকা ভাবল তার নিজের কথা। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই মনের মধ্যে একটা স্বপ্নকে সে লালন করেছে। স্বপ্ন সবাই দেখে একটা সুখ, সমৃদ্ধশালী জীবনের। কিন্তু সেই স্বপ্ন  সত্য করার জন্য যে আগুন দরকার সেই আগুন সবার ভেতরে থাকে না। মল্লিকার আছে। সেই আগুন বুকের ভেতর অহরহ জ্বলছে। এই আগুন জ্বালিয়ে ছিল তার মা। বলেছিল," মেয়েদের নিজেদের একটা পরিচয় দরকার। সে কারো মেয়ে, কারো স্ত্রী, কারো মা হতেই পারে কিন্তু সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। নিজস্ব পরিচয় হল আলাদা সম্মান। তার নামেই সকলে চিনবে। তার পরিচয়ে বাবা, স্বামী অথবা সন্তান গর্বিত হবে।তবেই তার আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ। আর রোজগারের একটা ভদ্র জায়গা দরকার। কারো দয়া বা অনুগ্রহ নয়। মাথা উঁচু করে বাঁচবে নিজের রোজগারে।"
🍂

স্বপ্নটা তখন থেকেই তার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে রয়েছে। আজ মাঝপথে রণে ভঙ্গ দিলে অপমৃত্যু ঘটবে তার স্বপ্নের। আর স্বপ্নের মৃত্যু মানে তো নিজের অস্তিত্বের মৃত্যু।
কিন্তু উপায় কী? পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার খরচ সে কিভাবে চালাবে? পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশনে অ্যাডমিশন ফি তো দশ হাজার টাকারও বেশি। সে কোথায় পাবে? কার কাছে ধার চাইবে? চিন্তার পাহাড় তার মাথার ওপর চেপে বসে।
তাহলে কি সে হার মেনে নেবে? বাবার কথা মতো কোনো অর্ধ শিক্ষিত বা অশিক্ষিতের সঙ্গেই বাকি জীবনটা জড়িয়ে নেবে? অসম্ভব। ভাবতে ভাবতেই শেষ রাতে ঘুম এসে যায়।

সকাবেলায় পাড়ার লোকের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল বাপ বেটির। আজ টিউশনগুলোকে ছুটি দিয়েছে। তাই ভেবেছিল একটু দেরিতে উঠবে। কিন্তু বাইরের ডাকাডাকিটা এত জোরালো ছিল যে বাবা-মেয়ে দু'জনেরই ঘুম ভেঙে গেল। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে দরজা খুলে দেখলো ফুল্লরা জেঠিমা, মনসা কাকিমা আর একটু দূরে পাড়ার কাকু নিতাই বোড়েল এবং বীরেন পাল দাঁড়িয়ে আছে। এই বীরেন ঘোষ এ পাড়ার লোক নন।তিনি পার্টির লোক, অবিনাশবাবুর ঘনিষ্ট। মাঝেমাঝেই অবিনাশবাবুর পাশে পাশে তাকে দেখা যায়। কতকগুলো কৌতূহলী লোক অবাক চোখে তাদের দেখছিল। সাত সকালে তাদের বাড়ির সামনে এতগুলো লোক দেখে মল্লিকা প্রথমটা ঘাবড়ে যায়। পাশের কাকিমাদের জিজ্ঞেস করে, ব্যাপারটা কী? ওরাই দেখিয়ে দেয় যে বীরেনবাবু মল্লিকার খোঁজে এসেছেন।
" কেন, আমার খোঁজে কেন? আমি কী করেছি ?"
"তুমি কী করোনি?" এবার কথা শুরু করলেন বীরেনবাবু। " তুমি আমাদের এলাকার নাম উজ্জ্বল করেছো। আমাদের পার্টির নাম উজ্জ্বল করেছো। তোমরা আমাদের পার্টির সমর্থক। তাই পার্টিও তোমাদের পাশে আছে। অবিনাশবাবু ঠিক করেছেন, জাঁকজমকভাবে তোমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। সেখানে তোমার সাফল্যের জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে।" একটু দম নিয়ে আবার বলতে থাকেন," একটু পরেই তোমাকে নিয়ে শোভাযাত্রা বেরোবে। অবিনাশবাবু নিজে তোমার সঙ্গে হাঁটবেন। তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমরা একটু পরেই বেরোবো।"

এতগুলো কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মল্লিকা। খুব মৃদুস্বরে অথচ দৃঢ়ভাবে বলে," শুনুন, আজ না আমার হবে না। রেজাল্ট আনতে কলেজ যেতে হবে।"
" বেশ তো, আজ না হলে, কাল হবে।"
" আমি মিছিলে হাঁটতে পারবো না। মাফ করবেন।"
" আর সাহায্য? সেটাও তো তোমার দরকার আছে?"
" না, আসলে মানে এইভাবে সম্বর্ধনা বা পুরস্কার নিতে পারবো না। আমাকে মাফ করবেন।"
" আরে না, না।" বলতে বলতে প্রায় ছুটে আসে মল্লিকার বাবা, " ওকে আমি একদিন অবিনাশবাবুর কাছে নিয়ে যাবো। আপনারা যে আমার মেয়ের কথা ভেবেছেন, এজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। অবিনাশবাবু খুব ভালো মানুষ। আমরা নিশ্চয় ওনার কাছে যাবো। "
মল্লিকা ততক্ষণে বাড়ির ভেতর চলে গেছে সকালের বাসি কাজ পড়ে আছে। ধুরন্ধর বীরেন পাল এবার আরও একটু এগিয়ে এসে বলেন, " শুধু অবিনাশবাবু একা নন, তার ছেলে সুজনও মল্লিকার এই রেজাল্ট দেখে খুব খুশি। সে আপনার মেয়ের পড়াশোনার সব দায়িত্ব নিতে চায়।"
বেচারা দিনু সামন্ত যেন হাতে চাঁদ পায়। গদগদ কণ্ঠে বলে," সে তো খুব ভালো কথা। আমরা দু'জনেই কাল অবিনাশবাবুর সঙ্গে দেখা করবো।
বীরেনবাবু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বিদায় হলেন। পাড়ার লোক দুটো বিষয় বুঝে গেল।এক,- পাড়ার মেয়ে মল্লিকা খুব বড় একটা পাশ করেছে।দুই,- মল্লিকাদের পরিবার এবার থেকে অবিনাশবাবুর কাছের লোক হয়ে গেল। দ্বিতীয় বিষয়টিতে তাদের মনে ঈর্ষা জাগল।

দিনুর মনে চিন্তা হল। একদিকে অর্থের লোভ, অন্যদিকে মেয়ের একরোখা মনোভাব। যেমন করেই হোক, মেয়েকে বোঝাতে হবে। কতটুকুই বা বয়স ওর ? নিজের ভালোমন্দ বুঝবে কী করে? কিন্তু বাবা হিসেবে সম্পূর্ণ দায়িত্ব আছে দিনুর। ওকে একটু বোঝাতে পারলে মেয়েটার অনেক লাভ হবে। কাজেই দিনুকে চেষ্টা করতে হবেই। তবে চট করে কিছু করা যাবে না। তাতে বিগড়ে যেতে পারে। সময় বুঝে এগোতে হবে। আবার মল্লিকার মায়ের কথা মনে পড়ল। যদি এখন ওর মা থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতো।

মল্লিকা বাবার হাবভাব মতিগতি লক্ষ্য করছিল। বুঝতে পারছিল, বাবা কিছু একটা বলতে চায়। অনুমান করল। কিন্তু আমল দিল না। পরের অনুগ্রহ সে চায় না, বিশেষত অবিনাশবাবুর মতো ধূর্ত কারো কাছ থেকে। যারা মানুষকে সাহায্য করার নাম করে নিজেদের বড় করে প্রচার করে, সাংবাদিক ডেকে ছবি তোলে তাদের সে মনে মনে ঘৃণা করে। তাই ভেতরে ভেতরে কঠোর হয় বাবা যাই বলুক, এ দান সে নেবে না।

Post a Comment

0 Comments