জ্বলদর্চি

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনি। পর্ব ১/বাসুদেব গুপ্ত

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনি
পর্ব ১
বাসুদেব গুপ্ত


এই কাহিনি সম্পূর্ণ কল্পিত, এর কোন ঘটনা বা পাত্র পাত্রীর সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল থাকলে তা একেবারেই কাকতালীয়। এই কাহিনিট এআই বা আরটিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের কাহিনি । এআইএর কথা আজ সাধারণ থেকে অসাধারণ, শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, ছেলে মেয়ে বুড়ো সবাই জানে, সংবাদমাধ্যমে রোজ তার কোন না কোন খবর। অনলাইনএর ভূত আমাদের ঘাড়ে মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসে গেছে, আর তার ডান হাত হয়েছে এআই। এআই সারাক্ষণ বলে দেবে আপনার কি করা উচিত। চিঠি লিখতে গেলে সে ঘাড়ের ওপর বসে বলে দিচ্ছে পরের কথা বা বাক্যটি কি হওয়া উচিত। অন লাইন দোকানে গেলে, এ আই আগ বাড়িয়ে বলে দিচ্ছে আসলে আপনার কি পছন্দ, কি কেনা উচিত। আবার অন্যদিকে বিক্রেতাদের জন্য ঠিক করে দিচ্ছে আপনাকে ঠিক কত দামে বিক্রি করা হবে, এক কিলো পেঁয়াজ থেকে বিমান যাত্রার টিকিটের দাম এ আইএর হাতে। কিছু রিটারন করতে গেলে এআই ঠিক করে দিচ্ছে আপনি কত পয়সা ফেরত পাবেন। এআই সব জানে, সব পারে এরকম একটা ধারণা থেকে সব সংস্থা পরিষেবায় এ আইকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে একচ্ছত্র অধিকার। ইউটিউব, রীল, ব্লগ, পত্রিকায় ভারিক্কী লোকেরা অনুক্ষণ বলছে এআই আসছে এআই আসছে, সে বুঝি এক রাক্ষস, সব খেয়ে নেবে। ভয় বিস্ময়ের এক অদ্ভুত আবহে ঢাকা পড়ে গেছে এআইএর আসল রূপ। এআই যেন ধীরে ধীরে ঈশ্বরের স্থান দখল করে নিচ্ছে, দ্রুত নিশ্চিত পদক্ষেপে। 

স্লাইম মোল্ড বলে একরকম এককোষী জীব আছে, যা জৈব অজৈব সবকিছু খেয়ে নিজেকে পুষ্ট করতে পারে। এই জীবের একটি কোষে থাকতে পারে একটা থেকে হাজারটা নিউক্লিয়াস। এর কোন কোষ ক্ষুদ্রতম এক মিলিমিটার থেকেও ছোট, আবার একটি কোষ এমন কি দশ ফুট সাইজেরও হতে দেখা গেছে। এদের অগ্রগতি ও বিকাশ চলে গণিতের মত অভ্রান্ত নিয়মে। অনেক গাণিতিকরা তা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এদের বৃদ্ধি ও বিস্তারের মধ্যে অদ্ভুত সব এলগোরিদম খুঁজে পেয়েছেন । বিপদের কথা এই যে এই জীবকে যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে দেওয়া যায়, একদিন আমাদের গ্রহের সবকিছু খেয়ে ফেলে পড়ে থাকবে শুধু স্লাইম মোল্ড। শুধু মানুষ নয়, কোন কিছুই থাকবে না, শুধু থাকবে স্লাইম মোল্ড। এআইও কি একরকম মানুষের তৈরী স্লাইম মোল্ড?

হয়ত এরকম হবে না, বিদগ্ধজন এরকম ভাবনাকে বলেন প্যারানয়েড চিন্তা। কিন্তু এআইএর অবিশ্বাস্য অগ্রগতি আমাদের কপাল দগ্ধ করে না ফেলুক, তাতে ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট। একশো বছর পরে আমরা এই গ্রহে থাকব কিনা তা হয়ত ঠিক হবে এআই সেটা পছন্দ করবে কি না তার ওপরে। এআই ঠিক করবে কোন প্রজাতিকে রাখা হবে, কাকে হবে না। মানুষের ভাগ্য হয়ত নির্ধারিত হবে এআইএর ব্ল্যাক বক্সের এক মুহূর্তের কোন সিদ্ধান্তে। আর সেই এআই কে নিরন্তর শক্তিমান করে তুলছি আমরা মানুষরাই আমাদের যাবতীয় তথ্য অনুগতের মত সারাক্ষণ জোগান দিয়ে। 

কাজেই এআইকে রোখা না হোক, তাকে বোঝা এখন দিন দিন জরুরী হয়ে পড়ছে । আমাদের অস্তিত্বের একটা সঙ্কট স্লাইম মোল্ডের মত বেড়ে চলেছে আমাদের চোখের আড়ালে। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, ন্যায় অন্যায়, যুদ্ধ, বিপ্লব সব কিছুর দিক নির্ণয় করতে চলেছে এআই। এই লেখাটিতে এআইএর বিভিন্ন দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি এক কল্পকাহিনির আশ্রয় নিয়ে। কিছু টেকনলজির সাধারণবোধ্য ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি গল্প বলতে বলতে। আশা করি লেখাটি পাঠকদের কিছু প্রশ্নের জবাব দেবে ও অনেক জরুরী নতুন প্রশ্নের জন্ম দেবে। আসুন শুরু করি আমার গল্প। আপনারা পড়ে বলুন এআই থেকে রেহাই পাওয়া প্রয়োজন না এআই আমাদের বন্ধু হবে একদিন। 

মুখবন্ধ।
তিনটি নজরকাড়া রেল দুর্ঘটনা পর পর তিন দিন। মিডিয়া স্ক্রীনে রুদ্ধশ্বাস দেখলো পৃথিবী গ্রহের ১০ বিলিয়ন মানুষ।

সোমবার ১লা মার্চ ২০৩৫ সকাল- তোকাইডো শিনকানসেন তোকিয়ো থেকে ছেড়ে ওসাকার দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ অজানা কারণে তার অটোম্যাটিক সিগনাল সিস্টেম ফেল করে। ৭০ বছরের নিষ্কলঙ্ক নিরাপত্তার রেকর্ড। মাঝপথে স্টপ ইয়োকোহামা। কিন্তু সেখানে ট্রেনটা না প্লাটফর্মে নিয়মমত না থেমে, বা বেগ না কমিয়ে চলতেই থাকে। ৩০০ কিমি বেগে চলতে চলতে আবার ওসাকাতে এসে নিজে থেকেই সিগনালিং সিস্টেম ঠিক হয়ে গেলে প্লাটফর্মে রোজ দিনের মতই থেমে যায়। কোনো হতাহতের খবর নেই। 

মঙ্গলবার ২রা মার্চ ২০৩৫ - গোশক্তি এক্সপ্রেস, গোয়া থেকে গৌহাটি, ভারতভূমির কারখানায় এসেম্বল করা ম্যাগ্লেভ ট্রেন, ৪০০ কিমি বেগে ভেসে চলতে চলতে হঠাৎ গোয়ালিয়রে এসে হাইট লুজ করে, ঘর্ষণে আগুন ধরে যায়। চারিদিকে ধোঁয়ায় ভরে যায়। উগ্রবাদী আক্রমণ অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে, কাজেই কি কারণে এটা হল সেটা কেউ বুঝতে পারে না। আশ্চর্যভাবে গোয়ালিয়র ছেড়ে যেতেই আবার ট্রেন ম্যাগ্নেটিক লেভিটেশান ঠিক হয়ে যায় ও ট্রেন ঠিক সময়েই গৌহাটি পৌঁছয়। এখানেও হতাহতের কোন খবর নেই। 

🍂

বুধবার ৩রা মার্চ ২০৩৫ - জুমেরিকার( অখন্ড আমেরিকার নতুন নাম) নতুন রেললাইন, সিএটল থেকে নিউইয়রক। সুপার জেট ইঞ্জিন, নাম লিন বয়, তার লম্বা সরু আকারের জন্য। বেগ ৫০০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। মিনেসোটা পেরোতেই হঠাৎ ট্রেন লাইন চ্যুত হয়ে চলে যায় হাইওয়েতে। অটোম্যাটিক ডিস এনগেজার কামরাগুলো আলাদা করে দেয়, বগীগুলো সব সেলফ ব্রেক দিয়ে থেমে যায়, শুধু একটা বগী ঢুকে যায় একটি লেকের মধ্যে । কামরাটি খালি ছিল, সেখানে শুধু একজন যাত্রী ছিল তার নাম মাইক সন্ডারস। সে রোবোগারড কম্পানীর মালিক। তারা হোম সিকিউরিটকে রোবোটিক গারড সাপ্লাই দেয়। পুলিশের বদলে এখন অনেক দেশেই রোবোটিক গারড চালু হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। শুধু তার সুপারট্যাব উদ্ধার হয়েছে। সেটা নিয়ে তদন্ত চলছে। 

পরের দিন থেকে শুরু হল জাহাজবিপর্যয়। 
৪ঠা মার্চ ২০৩৫ - পানামা ক্যানাল দিয়ে যাচ্ছিল জাহাজ ভর্তি কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ আর এআইএর সারভার ফারমের জিপিইউ চিপ। জাহাজ হঠাৎ বেঁকে গিয়ে ধাক্কা মারল খালের ধারে, সব কন্টেনার গড়িয়ে চলে গেল জলের মধ্যে। কেউ মারা যায় নি। কিন্তু কন্টেনার উদ্ধার করে দেখা গেছে ভিতর কিছু নেই, ফাঁকা। 

৫ই মার্চ ২০৩৫ - ওডেসা থেকে ভারতভূমিতে যাওয়া একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার আর একটা গমবাহী জাহাজের সঙ্গে হঠাৎ ধাক্কা লাগে। ট্যাঙ্কারে ড্যামেজ হয়ে অনেক তেল চলে যায় ব্ল্যাক সীর জলে। ব্ল্যাক সি এখন সত্যিই কুচকুচে কালো, তার উপর ওড়াউড়ি করা সি গাল গুলোও কুচকুচে কালো হয়ে এখানে ওখানে পড়ে আছে। এখানেও হতাহতের সংখ্যা শূন্য।

৬ই মার্চ ২০৩৫ - মরক্কো আর স্পেনের মাঝ দিয়ে চলে গেছে জিব্রাল্টার প্রণালী। অনেক দিন এর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি দেশের গোলমাল লেগেই থাকত। মরক্কো ভয়ানক ভূমিকম্প প্রবণ বলে এর ওপর দিয়ে ব্রীজ তৈরী করাও মুস্কিল, শেষকালে ভারতভূমির সেতুবন্ধ লিমিটেড এর বরাত পায়। এদিন একটি জাহাজ ২০০০ টন মাল নিয়ে সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে ঐ ব্রীজে। তখন ভোর, ভালো করে আলো ফোটে নি। ব্রীজটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে যায়। কিন্তু কেউ হতাহত হয় নি। 

৭ দিন পরপর এমনি ভাবে একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে থাকে, বিনা বিরতিতে, আর অদ্ভুত অজানা কিছুর আতঙ্ক ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলে সারা বিশ্বের মানুষকে। সবচেয়ে অদ্ভুত যে এই ঘটনাগুলোতে হতাহতের সংখ্যা প্রায় শূন্য। যেন কেউ এই ঘটনাগুলো ডিজাইন করেছে, কম্পিউটার প্রোগ্রামের মত, যাতে ক্ষয় ক্ষতি না হয়। 

৭ই মার্চ হঠাৎ ১০০০টা অজানা ড্রোন ক্রেমলিনের চারদিকে চক্কর মারে, ইয়ুরেশিয়ার নিউক্লিয়ার মিসাইল সিস্টেম চালু হয়ে যায়, কিন্তু হঠাৎ ড্রোন গুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। একটা এটমিক ওয়ারের থেকে এক চুলের জন্য বেঁচে যায় পৃথিবী। ড্রোন গুলোর কোন হদিশ পাওয়া যায় নি, তারা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। 

৮ই মার্চ প্রতিটা মিডিয়া স্ক্রীনে একটা মেসেজ দেখা যায় ১ মিনিটের জন্য। “Day Zero!!! GOD is coming soon”
সেই সঙ্গে প্রতিটি ডিজিটাল এসিস্ট্যান্ট, আলেক্সা সিরি, ইকো, আর যেখানে যত রোবট আছে সবাই এক সঙ্গে ১ মিনিট ধরে একটা জিংগল গায়, “Day Zero!!! GOD is coming soon”


তারপর সব চুপচাপ। পুরো এক মাস কেটে গেছে। কোন দুর্ঘটনার খবর নেই। গডের থেকেও আর কোন বাণী বা বার্তা এসে আসে নি।  

কে এই গড? কেনই বা আসছেন?

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments