জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী /বিংশ পরিচ্ছেদ

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
বিংশ পরিচ্ছেদ

জীবন বহমান, মৃত্যু তবু ধ্রুব।আবেগের আতিশয্যে মোহগ্রস্থ হলেও মানুষকে তা মানতে হয়ই। তবে তার প্রকাশভঙ্গি এক একজনের কাছে এক একরকম। 
 তাই, নবযুগের নবীনা যখন বাইবেলে তার বিভ্রান্তির ব্যাখ্যা খোঁজে, অগ্রজার মনে পড়ে জ্যাঠামশায়ের উচ্চারিত গীতার শ্লোক:
“দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তর প্রাপ্তি ধীরস্তত্র ন মুহাতি”… 
সমষ্টি পেরিয়ে মনে পড়ে সেই সব ব্যক্তিগত ব্যথার আখ্যান। 
সেইবার দেশে গাঁয়ে বৃষ্টি হয়েছিল খুব। ছোটদাদা তার পরিবার নিয়ে যথারীতি কলকাতায়, বড়ো দাদার ছেলেটিও আই.এ.-বি.এ. পাশ করে কলকাতায় ওকালতি কলেজে ভর্তি হয়েছে,বাড়িতে এসেও যখন চশমাপরা চোখে বড় বড় বই খুলে বসে, পিসির মনে বড়ো গর্ব হয়। 
নবযৌবনাগমের সেই সব রিক্ত প্রহরে, সব হারানো বিরজার কোলে বৌদিদি তুলে দিয়েছিল তাদের প্রথম সন্তানটিকে, দাদার ইচ্ছেয় না নিজের ইচ্ছেয় তা জানেনা বিরজা; তবে তাকে বুকে জড়িয়েই যে সে আবার জীবনে ফিরতে পেরেছিল, তা অস্বীকার করার উপায় কই! 
সেই ছেলে ছুটি পেয়ে কদিনের জন্য বাড়ি এসেছে,প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভালোমন্দ বানিয়ে খাওয়ান বিরজা,জ‍্যাঠাইমার কাছ থেকে রান্নাবান্না শিখে তিনি তখন পাক্কা রাঁধুনি।
তো সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল,ভাইপোর আবদারে খিচুড়ি বসিয়েছেন;সারা বাড়ি সোনামুগ ভাজা,ঘি,বাসমতী চালের গন্ধে মধুর।জ‍্যাঠাইমা দাওয়ায় শুয়েছিলেন মাদুর পেতে, বিরজাই জোর করে সকালবেলা শুইয়ে এসেছিল তাঁকে;শরীরটা তাঁর কয়দিন ধরেই ভালো ছিলনা।জ‍্যাঠামশাই একটু দূরে বসে চন্ডীস্তব আওড়াচ্ছেন,
"প্রভাতে য় স্মরে নিত্যম |দুর্গা দুর্গাক্ষর  দ্বয়ম ||
আপদস্তস্য নাশ্যন্তি |তম সূর্যোদয়ে যথা ||”  

হঠাৎ ধুপ করে এক শব্দ…
রান্নাশাল থেকে দেখতে পেলেন বিরজা জ‍্যাঠাইমা ছাঁচতলায় পড়ে গেলেন;সব ফেলে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলেন;চোখ বন্ধ,মুখে ফ‍্যানা উঠছে।
ততক্ষণে বৌদিদিরা,মেজদাদা,ভাইপো সবাই যে যার কাজ ফেলে এসে জুটেছে,জ‍্যাঠামশাইয়ের স্তোত্রপাঠও স্তব্ধ;ভাইপো হাত-পা ঘসছে তার ঠাকুমার;বিরজা আকুলিবিকুলি করছে,বুকে হাত বুলোচ্ছে…
এভাবে খানিক সময় গেল,পরপর তিনটি হিক্কা উঠলো…নিশ্চল হয়ে গেলেন জ‍্যাঠাইমা।মাথার কাছে এসে বসলেন জ‍্যাঠামশাই,মৃদুস্বরে স্তবগুঞ্জন;চারপাশে সবাই বুঝতে পারছে কি সর্বনাশ হয়ে গেল,কিন্তু সবাই নির্বাক।
মৃত্যু এতো নিঃসঙ্গ!মৃত্যু এতো ভয়ানক!
বাইরে তখন ঝেঁপে বৃষ্টি এলো,বর্ষালী হাওয়ার তোড়ে ছাঁচতলার জলের ছাঁট এসে লাগছিল জ‍্যাঠাইমার শরীরে,ওদের সবার শরীরে… মেজবৌদিদি চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করলে,বড়বৌদিদির চোখে নীরব বন‍্যা। 
বিরজা কোন কথা বলতে পারছিল না,ঘরহারা পাখির মতো উদ্ভ্রান্ত লাগছিল নিজেকে;বারবার কেন ওর সঙ্গেই এমন হয়!অভিযোগ করবে কার কাছে?আশ্রয়ই বা চাইবে কোথায়!
কান্নাও যেন বিদায় নিয়েছে লজ্জায়,অনুচ্চার বোবা বেদনায়, 
-’কোথায় গেলে? বলে গেলে না কেন? গেলেই যদি,আমাকে নিয়ে গেলে না কেন?কার কাছে ফেলে গেলে?এতো ভালোবাসতে যে!আমি এখন কি করবো! ’

 জ‍্যাঠাইমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথাই ভাবছিল হয়তো তখন। পরে পরে সবাই তাকে কাঁদাবার বহু চেষ্টা করলেও বিরজা কাঁদতে পারেনি,এক অসহনীয় শূন্যতা যেন গ্রাস করেছিল তাকে।পরের সকালে দাহকার্য মিটিয়ে সবাই যখন ফিরলে,নিমপাতা-লোহা স্পর্শ করিয়ে  জ‍্যাঠামশাইয়ের কাছে গিয়ে বসেছিল,জ‍্যাঠামশাই ওর মাথায় হাত রেখে আওড়ালেন,....
মুণ্ডক উপনিষদের সেই অমোঘ শ্লোক
“সমানে বৃদ্ধ পুরুষো নিমগ্লোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ”


🍂

-এতক্ষণের আটকে রাখা যন্ত্রনা অশ্রু হয়ে ওর চোখে নামালো শ্রাবণ… কানে কানে কে যেন বললে,
-'তারা রে!তোর জ‍্যাঠামশাইকে দেখিস।'
কাঁদতে কাঁদতে ও অস্ফুটে বললে,
-'হ‍্যাঁ জ‍্যাঠাইমা,তুমি শান্তিতে যাও।'
তারপরে, শোকের পাহাড় ঠেলে জ‍্যাঠামশাইকে অবলম্বন করেই বাঁচতে শুরু করে সে। তাঁর সমস্ত দায়িত্ব নিজহাতে সামলেছে,পরমযত্নে।তিনিও যেন ওর কাছে শিশুর মতো আশ্রয়প্রার্থী হয়ে পড়েছিলেন, সম্পর্কও আন্তরিক হয়ে পড়ে বেশ। হয়তো দুটি দুঃখী প্রাণ পরস্পরের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। হাতের কাজ সেরে সন্ধ্যায় তাঁর কাছে এসে বসতো, এটা ওটা কথার ফাঁকে কখনো হয়তো তাঁর কাছে জানতে চাইতো,মরার পরে মানুষ কোথায় যায়?এপারের কথা কি কিছু মনে থাকে?দেখা হয় কি কখনও পরস্পরে!
তিনি নিরুত্তরে হাসতেন।পুরাণের গল্প বলতেন,দূর্গাস্তব জপ করে আত্মাকে মুক্ত ও নির্মোহ করার শিক্ষা দিতেন,বাস্তবকে শান্ত মনে গ্রহণ করার পরামর্শও।

দেহভরা যৌবন নিয়েও নিজেকে ধীরে ধীরে সমাহিত করার সাধনা সবে বছর আটাশের তরুণী বিধবার মননে সঞ্চারিত হতে শুরু হয়েছিল সদ্যই,  জীবন আবারও যে আঘাত শানিয়ে রেখেছে তাঁর জন্য, কল্পনাও করতে পারেননি বিরজা।
শ্রাবণ পেরিয়ে ঋতুর যাত্রা যখন ফাল্গুনের মাঝখানে,এক সন্ধ‍্যায় সন্ধ্যাহ্ণিক সেরে কাশতে শুরু করলেন জ‍্যাঠামশাই।
সে কি কাশি!কী কাশি!
বুকে গরম তেলমালিশ,কর্পূর জলে পুড়িয়ে সে জল খাওয়ানো,আদা-চায়ে মধু মিশিয়ে মুখে ধরা, ধন্বন্তরী পাতা শোঁকানো… কিছুই বাদ রইল না,সবাই মিলে যথাসাধ্য যত্ন করলে সারারাত ধরে। অনেক দূরের গ্রাম থেকে মেজদাদা কবিরাজ মশাইকেও ডেকে আনলেন, খলনুড়ি মাড়িয়ে তাঁর বটিকা জিভের তলায় দেওয়া হলো; তবু শেষরক্ষা হলো না। 
অন্ধকার পেরিয়ে আকাশে নতুন সূর্য উঠলো, চারিদিকে লালের আভা, শেষবারের মতো চোখ খুলে চারিদিক দেখলেন যেন, তারপরেই চোখ বুজে নিশ্বাসটি ফেলে দিলেন জ্যাঠামশাই। কবরেজ মশাই নাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন, কী অনায়াসে জীবন দীপ নিভলোনিভলো! 
ওরা সবাই তাঁকে ঘিরে তাকিয়ে রইলে নির্বিশেষ, কারো মুখে কোন কথা নেই,সবাই নিশ্চুপ।প্রিয়জনের জন্য বিয়োগ ব্যথা অথবা অভিভাবকহীন হওয়ার অসহায়তার যন্ত্রনা উপস্থিত সবাইকে যেন বিমুখী করে দিয়েছিল সে মুহুর্তে। 
পরে পরে আরও অনেক, অনেক আঘাত পেয়েছেন, বড়োদাদা,বড়োবৌদিদি,মেজদাদা,ছোটদাদা একে একে ছেড়ে গেছে, ক্ষয়-লয়-প্রাপ্তি-প্রতিষ্ঠায় জীবন কেটেছে যথারীতি। তবু স্বামীবিয়োগের রাত আর পিতৃসম জ্যাঠামশায়ের চলে যাওয়ার সকালটি আজীবন চির বিচ্ছেদের বেদনা জাগরুক স্মৃতি হিসেবেই রয়ে গেছে। (ক্রমশঃ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments