পর্ব-১৭
স্বপন কুমার দে
জ্বরটা ছাড়লেও শরীরে খুব একটা জোর পাচ্ছে না দিননাথ। মুখে রুচিটাও নেই, দেহের গাঁটে গাঁটে ব্যথা। চলাফেরা করতে গিয়ে বুঝতে পারল হাত পা গুলো একটু ফোলা ফোলা লাগছে।
ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুম গিয়ে, ফিরে এসে আবার বিছানায় বসল। তারপর কী মনে করে মেয়ের রুমে গেল। দেখল, মেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘুমন্ত মেয়েকে দেখে খুব মায়া হল দিননাথের। কখনও কখনও নির্জন দুপুরের স্তব্ধতা মনের মধ্যে বিষাদের যে সুর ছড়িয়ে দেয়, একাকীত্বের শূন্যতা মনকে চেপে ধরে ঠিক সেই রকম একটা অনুভূতি দিননাথের মধ্যে চেপে বসছিল। খুব ইচ্ছা করছিল, মেয়ের সঙ্গে কথা বলে একাকীত্বের ভয়ানক দৈত্যটাকে খেদিয়ে দিতে। কিন্তু না, মল্লিকাকে ডাকল না। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, একটু ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, উঠলেই তো শুধু কাজ আর কাজ। এতটুকু বিশ্রাম পায় না। গরিবের মেয়ে, ভালো খাবারটুকুও পায় না। এরকম হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও এতটুকু বিরক্তি নেই। দিননাথের নিজেকে অসহায়, দুর্ভাগা এক বাবা মনে হল। মেয়ের এত দুঃখ কষ্টের জন্য সে নিজেকেই দায়ী করল।
খুব সন্তর্পণে একটা চাদর টেনে নিয়ে মেয়ের গায়ে ঢাকা দিয়ে মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এল দিননাথ। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ রাখল। অন্ধকার কিছুটা পাতলা হয়ে এসেছে। এত ভোরেও দু'একজন মানুষকে এদিক ওদিক দেখতে পাওয়া গেল। কেউ কেউ খুব সকালেই কাজে বেরিয়ে পড়ে, কাজেই তাদের রাত থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। তাদের চলাফেরা, কথাবার্তার আওয়াজ অস্ফুট স্বরে শোনা যাচ্ছিল। সেখানে সে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। কোমরের পেছন দিকে একটা ব্যথা চাগাড় দিয়ে উঠছে। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, বুঝতেও পারেনি। ঘুম ভাঙল লোকের চিৎকারে। রাস্তার কলে জল এসেছে, তাই চিৎকার। মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখল,মেয়ে বিছানায় নেই। ঘরের সদর দরজাটা ভেজানো রয়েছে। একটু পরেই মেয়ে দু'বালতি জল নিয়ে ঘরে ঢুকল। বাথরুমের বালতিতে জল ঢেলে দিয়েই আবার বেরিয়ে গেল। এইভাবে সকালে দশ বারো বালতি জল তুলে আনতে হয়।
বাবাকে খেতে দিয়ে মল্লিকা আবিষ্কার করল যে, তার বাবার পুরো শরীরটাই একটু একটু ফুলে গেছে। মনে চিন্তা হল তার। ভেবে নিল, সময় করে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে। বাবাকে খাবার খাইয়ে, ওষুধ খাইয়ে তখনকার মত টিউশনে বেরিয়ে পড়ল মল্লিকা। যাবার সময় বলে গেল, " বাড়ির ভেতরেই একটু ঘোরাঘুরি করবে, বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ফোলাটা যদি না কমে, তাহলে কাল একবার হাসপাতালের আউটডোরে দেখিয়ে নিয়ে আসবো।"
🍂
পরদিন সকালে আউট ডোরের টিকিট কেটে নিয়ে এল মল্লিকা। আজ আর ইউনিভার্সিটি যেতে পারবে না সে। একটা সেমিনার ছিল ডিপার্টমেন্টে। বাইরের ইউনিভার্সিটির প্রফেসররা আসবেন। মল্লিকার ইচ্ছা ছিল সেমিনারটা অ্যাটেন্ড করার,কিন্তু এখন উপায় নেই। আগে বাবাকে ডাক্তার দেখানো দরকার, তারপর অন্য কিছু। মনটা খুব উতলা, একটা টেনশন বুকের মধ্যে চেপে বসেছে,তাই তো কী হয়, ডাক্তার কী বলে? বাবার যদি কিছু বাড়াবাড়ি হয়, তখন সে কী করবে? কিন্তু না, মনকে দুর্বল করলে চলবে না, শক্ত হতে হবে। তাদের আর কেউ নেই। যা করার তাকেই করতে হবে। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। হারার আগে হারবে না।
হাসপাতালে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এইসব ভাবছিল, সে সময় দিননাথের ডাক পড়ল। বাবা মেয়ে দু'জনেই ডাক্তারবাবুর কাছে গেল। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু কয়েকটি টেষ্ট করতে লিখলেন। হাসপাতালেই হয়ে যাবে। টেস্টের রিপোর্টগুলো পেয়ে গেলে কাল একবার দেখাতে বললেন।
সেখান থেকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন সহ বাবাকে প্যাথলজি, রেডিওলজি, সব জায়গায় পরীক্ষা করিয়ে দুপুর একটা নাগাদ বাড়ি ফিরল। স্নান, রান্না, খাওয়া দাওয়া করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আবার ছুটল হাসপাতাল, এবার মল্লিকা একা। সব রিপোর্ট নিল। রিপোর্ট দেখে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারল না। বাড়ি ফিরে বাবাকে সান্ত্বনা দিল, " সব রিপোর্টই মোটামুটি ভালো, কেবলমাত্র একটা, রিপোর্ট ঠিক বুঝতে পারলাম না। দেখি, কাল একবার ডাক্তারের কাছে যাই।" মাথার মধ্যে একরাশ চিন্তা নিয়ে মল্লিকার রাত কাটল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে দেখে খুব কষ্ট হল। শরীরটা আরও বেশি বেশি ফুলে গেছে, বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বাবাকে ধরে নিয়ে ধীরে ধীরে বাথরুম নিয়ে গেল, আবার শুইয়ে দিল। খেতে রুচি নেই, মুখ চোখ ফ্যাকাশে। বুকের ভেতরটা যেন এক অদৃশ্য সংকেতে ভীত সন্ত্রস্ত। হাফ গ্লাস ও আর এস মুখের সামনে ধরল মল্লিকা।সেটা মুখে দেওয়ার আগেই বাবার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল। গ্লাসে মুখ ঠেকিয়েই একটু খেয়েই মুখ সরিয়ে নিল।
" বাবা, তোমার কিচ্ছু হয়নি। সেরে যাবে, ভয় নেই। এখন যদি না খেয়ে খেয়ে শরীরটাকে দুর্বল করে তোলো, তাহলে আমি কী করে লড়াই করি বলো দেখি? এইটুকু জল খেয়ে নাও।"
" খেতে পারছি নারে মা, শরীরে খুব কষ্ট।"
" আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। যদি তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, তো তাই হবে। তোমাকে ভালো হতে হবে। তুমি যে আমার লড়াইয়ের প্রধান শক্তি।তুমি সুস্থ না হলে, আমি যে বল পাবো না। "
" বোধহয়, আমি আর সুস্থ হবো না রে মা। তুই লড়াই চালিয়ে যা মা, কখনও হারবি না, কারও কাছে মাথা নোয়াবি না। আমি আর তোর মা সবসময় তোর কাছে কাছেই থাকবো।"
" একদম চুপ করো বাবা, ওইসব কথা কখনও বলবে না আমি তোমাকে সুস্থ করবই।" মেয়ের কথায় দিননাথ মৃদু হাসল। সে হাসির মধ্যে উচ্ছ্বাস ছিল না, বুকের ভেতরের নিংড়ানো কান্না যেন বিপরীত অবয়বে বেরিয়ে আসছিল। ভাগ্য তাড়িত অসহায় সন্তানকে এতটুকু সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি সে খুঁজে পেল না। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ভেতরে ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ বাইরে এসে বায়ুসমুদ্রে মিশে গেল।
রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু বললেন," অবস্থা মোটেও ভালো নয়। পেশেন্টকে এক্ষুনি ভর্তি করতে হবে। আমি লিখে দিচ্ছি। তুমি অ্যাডমিশন সেকশনে তোমার বাবাকে নিয়ে চলে যাও, ওরা ভর্তি করে নেবে।"
বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করে এসে মল্লিকা বাড়িতে যখন ঢুকল, তখন চারপাশটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগল। বাবা হয়তো কোনো কাজ করতে পারত না, কিন্তু চোখের সামনে বাবাকে অন্তত দেখতে পেত। কখনও চুপচাপ বসে থাকে তো কখনও মেয়ের সঙ্গে গল্প গুজব করে। বড় ভরসার জায়গা হল বাবা, আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত নির্ভরতার জায়গা হল বাবা।আজ বাবা হাসপাতালে। মল্লিকাকে একাই থাকতে হবে বাড়িতে। এই প্রথম তার মনে ভয় করতে শুরু করল।
পাঁচদিন ধরে বাড়ি আর হাসপাতাল। ছোটাছুটি, টেনশন, রাতজাগা। ছ'দিনের দিন দিননাথ সামন্ত এ সংসারের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে মেয়েকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিল। মাতৃহারা মল্লিকা এবার পিতৃহারা হয়ে স্নেহ ভালোবাসার শেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে ফেলল। শোক দুঃখের সাথে নিষ্ঠুর কর্তব্য পালনের মত বাধ্যবাধকতার জ্বলন্ত উত্তাপ মল্লিকাকে সহ্য করতে হল। না আছে আত্মীয়, না আছে দরদি পড়শি। কর্তব্য তাকে শোক প্রকাশের সময়টুকুও দিতে রাজি নয়।
নিমাইকাকু খবর পেয়ে এসেছে। মল্লিকার হাতে নিজের জমানো দুশো টাকা তুলে দিয়ে বলল," না করিস না মা, এই সময় তোর অনেক টাকার দরকার। কাকুর কাছ থেকে এই ক'টা টাকা যেন ফিরিয়ে দিস না।"
আর এসেছে অভিরূপ। সে এর আগেও দু'দিন এসেছিল, আজ একেবারে মল্লিকার পাশে পাশে রয়েছে। অফিসিয়াল ফর্মালিটি সম্পন্ন করতে মল্লিকাকে সাহায্য করেছে। তারপর মল্লিকার বাবার মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য মিউনিসিপ্যালিটি যেতে হয়েছে। সবশেষে শ্মশানযাত্রার আগে মল্লিকাই তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে। পাড়ার দশবারোজন ছেলে এসেছিল, তারাই শ্মশানসঙ্গী।
বাবার শেষ যাত্রায় পিছু পিছু চলেছে মল্লিকা।নিমাইকাকু সবসময় কাছে কাছে রয়েছে। এই সময় তার পাশে দাঁড়ানোর, তাকে শক্তি যোগানোর জন্য কারও দরকার। সংসারে সব হারিয়ে মল্লিকা আজ অনাথ হয়ে গেল। এই অবস্থায় যেকোনো আঘাতে সে বেসামাল হয়ে যেতে পারে। নিমাইয়ের আর ক্ষমতা কতটুকু? অধিকারই বা কতটা? তার ওপর এতবড় শিক্ষিতা মেয়েকে সে কীই বা সান্ত্বনা দিতে পারে?
শ্মশানে মৃতদেহটা নামানো হল। মল্লিকা বাবার চোখে তুলসি পাতা দিল, শরীরে ফুল ছড়িয়ে দিল।নিজের দু'হাতে বাবার মুখটা জড়িয়ে ধরল। দু'চোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যেতে লাগল। শেষবারের মত বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার পায়ে মাথা ঠেকাল। এরপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।
মেয়ের চোখের জলে শেষ বিদায় নিল দিননাথ সামন্ত। শোকের আঘাতে মল্লিকার দেহ মন একেবারে শক্তিহীন। লড়াই করা তো দূর অস্ত উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments