পর্ব -১০
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
সেই বাড়ির নেই ঠিকানা...
স্বপ্নে প্রায়ই হারিয়ে যায় ঝিনি। কিছুতেই বাড়ি ফেরার রাস্তা খুঁজে পায় না। যেদিকেই ছুটে যায় রাস্তা আটকে দাঁড়ায় বিকট সব ভয়।অন্ধকার ঘন আর শক্ত হয়ে ঘিরে ফেলে। কিংবা উঠে দাঁড়ানোর আগেই থকথকে কাঁদায় হাঁটু অব্দি ডুবে যায় বা জলের ভেতর হঠাৎই মাটি সরে যায় পায়ের তলার। চেনা রাস্তা দুম করে বাঁক নিয়ে শূন্যের দিকে গিয়ে ওঠে।ছাইরঙ পাঁশুটে মস্ত কী একটা চোখ মটকায় ওখানে দাঁড়িয়ে যেন থাবার ভেতর তাকে লুফতে লুফতে সে নিয়ে ফেলবে এক্কেবারে অন্য কোথাও। ভয়ে সিঁটিয়ে যত জোর পারে চেঁচিয়ে ওঠে কিন্তু আওয়াজ বেরোয় না গলা দিয়ে।
নির্ঘাত স্বপ্ন দেখছিস,এই ঝিনি ওঠ ওঠ;পাশ ফিরে শো।গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে মা তাকে নাড়িয়ে দেয়। জেগে উঠেও সেই একলা ছুটে বেড়ানোর আতঙ্ক কাটতে চায় না যেন।ফোঁপানি থামতে সময় লাগে। আগে আগে মাকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ভয় কাটানোর চেষ্টা করত সে।আধো ঘুমে মা বকুনি দিত তাকে।ছাড় ছাড় জ্বালাতন করিস নে।কী ভিতু মেয়ে রে বাবা। রোজ রোজ ঘুমের মধ্যে কেন যে এটাকে বোবায় ধরে!
মাথার ভেতর আবছা হয়ে জেগে উঠত পুকুর...ওল্টানো গাছের ছবি।অবশ্য সকাল হলে ভেসে যাওয়া পাতার মতো আধোডোবা ফিকে সব ভয়ের মুখ ভুলে যেতে সময় লাগত না।
মা বিরক্ত হয় বলে ঘুম ভেঙে সে কান্না চাপার চেষ্টা করে খুব। জাপটে না ধরলেও মায়ের গা ছুঁয়ে মনে মনে স্বপ্ন টাকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে ইদানিং। নিজের মতো ভেবে নেয়;তারপর তো বাপির সাথে দেখা হয়ে গেল। বাবা তাড়িয়ে দিল সব ভয়দের।আর অচেনা রাস্তা দিয়ে বাপির কাঁধে চড়ে তারা কেমন বাড়ি ফিরে এল।
কিংবা বিচ্ছিরি যে লোকটা ধরতে আসছিল পা পিছলে পড়ে পড়ল আর সেও ছুট লাগালো।বা হেম এসে গেল আর রাস্তা দেখিয়ে তাকে নিয়ে এল বাড়ি মোটমাট দুঃস্বপ্নের সমাধান হিসেবে একখানা হ্যাপি এন্ডিং ভেবে টেবে তবেই সে ঘুমিয়ে পড়ে আবার।
আজকাল মাঝেমধ্যেই রাতে সে আবুজিকে নিয়ে হেমের খাটে গিয়ে ওঠে। আবুজির অবশ্য যে কোনো জায়গায় শুতে পেলেই হলো এমনকি তাকে ওর'ম অদ্ভুত নামে ডাকার জন্যও কিছুমাত্র আপত্তি নেই তার কেননা সে হলো ঝিনির পাশবালিশ।সবাই হাসাহাসি করে যদিও তবে বাবা খুব সাপোর্ট দেয়। ডেকে হেঁকে সবাইকে শুনিয়ে বাবা বলে;যার পুতুলের নাম মল্লিকা, বেড়ালের নাম পিয়ালি তার পাশবালিশের নাম আবুজি হতেই হবে এ একেবারে অবশ্যম্ভাবী।এ নিয়ে কারও আপত্তি আমি শুনবো না।রে অরু -মিতু!ফের যদি কেউ হেসেছিস শুনতে পাই! সে পষ্ট দেখে বাবার ধমকেও দাদারা মুখ নামিয়ে হাসি লুকোয়।
গত মাসের শুকতারা আনতে ভুলে গেছো বাপি কেবল চাঁদমামা আর কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান এনেছিলে এ সপ্তায় এনো কিন্তু।বারান্দার চৌকিতে বসে পুরনো সেভিয়েত দেশ পত্রিকার পাতা দিয়ে বইয়ের মলাট দিতে দিতে অরু বলে।
বই ছিঁড়ছিস কেন দানি?কী সুন্দর সব ছবি।দু' বছরের পুরনো তো। বাপির কাছে চেয়ে নিয়েছি। বরফের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে ভালুক পরিবার।হাত দিয়ে পাট পাট করল পাতাটা ঝিনি।আমায় এটা দিবি দানি?।দাদামনি তাকে দিয়ে দিল ছবির পাতাটা।মন্টু বিড়ির সব কিছুতে নাক গলানো চাই! মিতুও তার ছবি সাঁটার খাতায় পত্রিকার পাতা দিয়ে মলাট লাগাচ্ছে।দেব একদিন হাপিস করে ওর সাধের আবুজিকে।করেই দেখো না। বুঝবে মজা বলেই বড় ঘরে ঢুকে পড়ল ঝিনি বলা যায় না ছোড়দা উঠে চড় চাপড় দিতে পারে।
অথচ সত্যিই আবুজি এক সকালে হারিয়ে গেল।মা আর হেম সিনেমায় গেছিল সেবার। তাদের বাড়ি থেকে হল তেমন দূরে নয়।বেলা দশটা নাগাদ সাইকেলে বাঁধা চৌকোনা দরমার গায়ে সিনেমার পোস্টার সেঁটে রোগা মতো টাকমাথার এক মানুষ মাইকে হাঁকতে হাঁকতে যায় বেলগড়িয়া নিত্য গোপাল টকীজে প্রত্যহ চারটে সাতটা,নাচে গানে মাতোয়ারা সম্পূর্ণ রঙিন ছবি ইত্যাদি। আওয়াজ পেলেই পাতলা রঙিন হ্যান্ডবিল কুড়োতে পাড়ার ছোটদের সঙ্গে অরু মিতু ঝিনি দৌড়োয় সাইকেলের পিছু পিছু।
🍂
শো শুরুর মিনিট চল্লিশ আগে রোজ হল থেকে মাইকে গান বাজানো হয়।সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের রোজই সেই আমি তার ছলনায় ভুলবো না, চন্দন পালঙ্কে,ঝাঁক ঝাঁক টিয়া উড়ে যায় আর লতার ওই গাছের পাতায় গানগুলো পাড়ায় সবার মুখস্থ হয়ে গেছে। সেদিন খোকন ওর বাবার কাছে মার খেয়েছে এ কারণে।ঘুড়ির সুতো গোটাতে গোটাতে দরদ দিয়ে যেই গেয়েছে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না ... অমনি গাইবার আর গান পাওনিকো বলে পিঠে জেঠুর চ্যাটালো হাতের এক থাবড়া ! গানের কারণে আষাঢ়ে তালের মতো অকস্মাৎ পিঠের ওপর এই পুরস্কারে খোকন খুবই অসন্তুষ্ট।এ তো সম্পূর্ণ নির্দোষ নিরীহ একখানা গান বই তো কিছু নয় হতো যদি ইঁদুর মারা বিষ তাও নয় একটা কথা ছিল।
ওই নিত্য গোপাল টকীজের লোকটার মতোই সাইকেলে বিষ বেচতে আসে আরও একজন আর এসেই বলে "ওড়ে আর পড়ে/পড়ে আর মরে/এই মরেছে! মশা মাছি ইঁদুরের যম এই বিষ!আসুন দেখুন পরীক্ষা করুন!" তাকে দেখলেই খোকন,তনু, বাবলুরা নাকি সুরে ভ্যাঙায়,এই মরেছে !এই মরেছে! লোকটাও তেড়ে ফুঁড়ে গাল দেয় তোর বাপ মরেছে!বাপের বৌ মরেছে। এবং বাচ্চারা অবধারিত মন্দ কথাগুলো শোনার জন্যই তার জন্য ঢিল রেডি রাখে। উড়ন্ত ঢিল পাটকেলের মধ্যে দিয়ে খুব দ্রুত প্যাডেল দিয়ে পাড়াটা পেরিয়ে যায় লোকটা।এ পাড়ায় তার বিক্রিবাটা কমে গেছে কাকে যেন বলেওছে সে।কাজেই বিষ এসে নালিশ করলে মার খাওয়ার তবু কারণ বোঝা যেত।
রোববার বা ছুটিছাটার দিন মা'র সিনেমা যাওয়া আছে জানলে চন্দন পালঙ্কে শুনতে পেয়েই ঝিনি চেঁচায় ;ওমাআআআ মাইক দিল। সেজেগুজে মা রেডিই থাকে।মাইক শুনেই মাও চটপট রওনা দেয় আর ফেরার সময় লক্ষী হয়ে থাকার শর্তে বাদামের তক্তি বা জিলিপি নিয়ে আসে।
সেদিন মা 'র সাথে হেমও গেছে সিনেমায়।আটা মেখে,রাতের রান্না গুছিয়ে আরাম করে রুবিদিও চাদড় মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।সুযোগ পেয়ে বিস্কিটের কৌটো নামালো মিতু।বেশ কটাতে মন দিয়ে মাখন লাগালো পুরু করে। তারপর চিনি দিয়ে আরাম করে খাচ্ছে দেখে লোভে পড়ে গেল ঝিনি।আমাকেও দে না রে। কিন্তু আধখানা দিয়েই তাকে তাড়িয়ে দিল ছোড়দা। থমথমে মুখে আধখানা বিস্কিট ভরেই পেছন থেকে এসে আবুজিকে দিয়ে ধাঁই ধপাধপ গোটা কয় বাড়ি দিল মিতুর পিঠে।
ছোড়দা কিছুই বলল না দেখে অবাক হলো সে আর পরদিনই আবুজি নিরুদ্দেশ। মল্লিকা আর আবুজি তো পাশাপাশিই শুয়ে ছিল। সক্কাল বেলা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করার মানে টা কী? খুন্তি উঁচিয়ে মা এল। গোটা বাড়ি তোলপাড় করেও পাওয়া যাচ্ছে না যখন মা হাঁক দিল মিতুউউউ। অংক শেষ করে আমি তো ইংরেজি হাতের লেখা করছি। টাস্কই শেষ হয়নি ;বলো কী বলবে?
ঝিনি তখনও হেমের আঁচল ধরে হাউমাউ। অবশেষে অরুই টর্চ মেরে খাটের তলে ঢুকে ট্রাঙ্কের পেছনে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকে থাকা পাশবালিশটা বের করে আনল। মাকড়সার ঝুল আর ধুলো মাখা সেটা দেখে মা কান ধরে মিতুকে তুলে আনল বারান্দার চৌকি থেকে। দেখেশুনে ফরসা বালিশটা ওখানে ঢোকালো কে?বা রে!আমি তার কি জানি ঝিনি নিশ্চয়ই ঘুমের ঘোরে লাথি দিয়ে বালিশটাকে ফেলে দিয়েছে।আর বালিশটা গড়াতে গড়াতে গিয়ে ট্রাঙ্কের ওধারে অত জিনিসপাতির মাঝে বড় হাঁড়ি খুঁজে নিয়ে ঘুচিমুচি হয়ে তার মাঝে শুয়ে পড়েছে আর তুমি কিছুই জানো না তাই তো? মাখনের কৌটোয় খাবলা দেওয়া, বিস্কিটের টিন খালি এসব কে জানে তাইলে?
পুবের ঘরে এখনও তাদের টালির চাল।ওই একখানা ঘর তুলে তিন দিকে বারান্দা ঘিরে দুই মাসি,জেঠতুতো দুই দাদা আর ছোট্ট অরু মিতুকে নিয়ে মা বাপি ভাড়া বাড়ি থেকে এ বাড়িতে উঠেছিল তার জন্মের আগেই।
জেঠতুতো দাদাদের বড়দা মেজদা ডাকতো বলে অরু মিতু তার দাদামনি আর ছোড়দামনি। ক্লাস টেনের পরীক্ষার আগে মা'র স্কুলে বছরখানেক পড়ে ছিল বড়দিভাই।সেজ জ্যাঠামনির ছেলে মেয়ে ছিল বড়দিভাই আর মেজদা এবং যথারীতি দা- কুমড়ো সম্পক্কো ছিল দুজনার। ঘুমন্ত বড়দির বিনুনিতে মরা আরশোলা বাঁধা, ক্লাসের খাতায় বিকট মুখ এঁকে রাখা বা বড়দির জ্যামিতি বাক্স থেকে সিকি আধুলি সরানো মেজদা রেগুলার ডিউটি মনে করত।
কাজেই সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে বড়দিভাইয়ের নালিশ শুনে বাপি হাঁক দিত রে দিলু!আয় দেখি ইদিকে।আর হন্তদন্ত মেজদা উঠোনে এসে দাঁড়াতেই ,আগে কান ধর। পরের দিকে অবশ্য শাস্তিবিধানের পুরোটা আর বলতে হতো না। হাঁক শুনে মেজদা উঠোনে নেমেই সময় নষ্ট না করে কানে ধরে ওঠবস শুরু করে দিত। কেবল জানলা দিয়ে ছোটদের হাসিমুখ উঁকি দিলেই ওঠবসরত মেজদা গলা খাকারি দিত। বাপিও ব্যাস ব্যাস শাস্তি শেষ বলে উঠে যেত খুব গম্ভীর মুখে। কেবল ঝিনির মনে হত বাপিও খুব হাসি চাপার চেষ্টায় আছে।
ফের ছোট কাকা আমায় ডাকলে কাছে পিঠে যদি দেখেছি তোমাদের হাসিতে ফুসকায়িত থোবড়া তো দেখবো ঘুড়ি কে বানায় আর সুপুরি ডেগোর গাড়িতে কে চাপায় তাছাড়া আমি তোমাদের বড় এবং সে সুবাদে গুরুজন। ছোট কাকার কথা শুনতে আমি যেমন বাধ্য তোমাদেরও উচিত আমার কথা শোনা ঠিক কিনা? মেজদার গম্ভীর মুখ দেখে ঢকাঢক তারা মাথা নাড়ে কিছুটা কিল খাবার ভয়ে তাছাড়া ডেগো চড়তেও মজা কিছু কম না।সুপুরির ডাল পড়লেই কুড়িয়ে আনে অরু মিতুরা। তার ওপর মজাসে বসে পাতার ডেগো চেপে ধরো মেজদা সরসর করে টেনে নিয়ে যাবে গাড়ির মতো। মাস কয় হলো মেজদাকে আই টি আই পড়তে হস্টেলে দিয়েছে তাদের বাবা।স্কুলের পরীক্ষা পাস দিয়েই বড়দিভাই বিয়ে হয়ে নাসিকে।বড়দাও কী একটা চাকরি পেয়ে উড়িষ্যা চলে গেছে।
আগে নাকি সেজো আর ছোট একসাথে ছোট ঘরের তক্তপোষে শুতো। কিন্তু ছোটমাসি অঞ্জনার বিয়ে হয়ে গেলে সেজো একাই শোয় এখন। অঞ্জু এলে এখনো সেজদি সেজদি করে বালিশ বুকে হেমের খাটে উপুড় হয়ে কত যে গল্প করে।
কিন্তু আর সব দিন যাই হোক ছোট এলে সেদিন তো ঝিনিকে হেমের কাছে শুতেই হবে।মা গজগজ করে এই গরমে ছোট খাটে এর'ম খেজুর জাগ দেবার মতো চাপাচাপি করে শোবার মানে কী?চল বলছি ঝিনি। চোখ বুজে ঘাপটি মেরে থাকে ঝিনি।আর মা চলে গেলেই সেজো, ছোটর মাঝে ঝিনি আর আবুজি গাদাগাদি করে শুয়ে আহ্লাদে গ্যালগ্যালে হয়ে ছড়া কাটে, "যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় ন'জন "।অমনিই ছোট তার ঝুঁটি নেড়ে বলবে এক নৌকো সুপারি/গুণে দেতো ব্যাপারী ...বল দেখি কীইই?ঝিনি ছোটর গায় পা তুলে দিয়ে বলবে জানি জানি আকাশের তারা...
তুই বল দেখি সবাই তোমায় ছেড়ে গেলেও সে যাবে না ছেড়ে/চেষ্টা করে বলো দেখি উত্তর কে পারে? ...ধাঁধা আর শোলোক শুরু হয় রাতের।
প্রি ইউ পড়েই ছোটর বিয়ে হয়ে গেছে কবে
ঝিনির মনে নেই। কিন্তু বাসে চড়ে মাঝেমধ্যেই যখন মসলন্দপুর ছোট মেসোর বাড়ি থেকে ছোট আসে,তার উচ্ছল হাসি দিয়ে ডালিম পাথর ঝকমক করে।আসলে ডালিম পাথর আছে ছোটর গলায় চৌকোনা পেনডেন্টের মধ্যিখানে আর বাঁ হাতের আংটিতে। অবিকল ডালিম দানার মতোই রঙ। সত্যি বলতে আসল ডালিমের চে 'ঢের সুন্দর তা।
মায়ের মতই চিরুনির ডগায় সিঁদুর নিয়ে সিঁথিতে দিয়ে কপালের মাঝখানে সিঙ্গার কুমকুমের মেরুণ টিপ দিলেই অঞ্জুর কপালটা ঝুরো চুল সমেত নীল আকাশের মতো ফুরফুর করে।সরু একটা চিরুনি দিয়ে সে চোখের কোণে কাজলের টান দেয়। পাহাড় আঁকা নীল আফগান স্নোর শিসি থেকে আঙুলে নিয়ে সারা মুখে লাগায়। পাফ দিয়ে মা'র কিউটিকুরা পাউডার লাগায় বুকে গলায়। লম্বা বিনুনি বেঁধে খোঁপা করে ঝুমুর দেওয়া রুপোর কাঁটা গুঁজতে গুঁজতে বলে ওই যে দেওয়ালে দেখছিস প্লাস্টার অফ প্যারিসে পাহাড় আর সমুদ্দুরের ছবি ওটা আমার প্রাইজ। ইস্কুলে হাঁড়ি ভাঙা খেলায় ফার্স্ট হয়েছিলাম।আর ওই ফুলদানিটা চেয়ার সিটিং খেলায় সেকেন্ড।চ' শ্যামলীদের বাড়ি যাই।
হেমের কোনো বন্ধু নেই কিন্তু বিকেলবেলা সেজেগুজে ঝিনির হাত ধরে ছোট তার বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে যায়।ফেরার পথে তারা দুজন চুপিচুপি কমলাভোগ বা গোলাপি দানাদার খায় আর ভালো মানুষের মতো বাদাম ভাজা কিনে বাড়ি ঢোকে।
এক সাথে খুশি আর মনখারাপ মেশানো ছোট মেয়েদের গলার মতো অবিকল ঝনঝন করে ছোটর কন্ঠস্বর।কলকল করে কথা বলে ,ঝরঝর করে হেসে দেয়, বেশি বকবক করার জন্য মা'র কাছে তার মতোই ধমক খাওয়া ছোটকে তার নিজের বয়সীই লাগে ঝিনির।
হেম আবার ততটাই শান্ত। সে কাছে এলেই আনন্দ না আনন্দ ঠিক না কেমন আশ্বস্ত লাগে ঝিনির।তার প্রশ্নের পর প্রশ্নের যত দৌরাত্ম্যে, বাপি না থাকলে মায়ের ঠেঙানি থেকে বাঁচতে কারণ বা অকারণে যে কোনো আহ্লাদে গলা ধরে ঝুলে পড়তে হেমকে তার চাইই।হেম যখন ইস্কুলে যায়,ডুরে বা একরঙা সরু পাড় তাঁতের শাড়ি, কলার দেওয়া বা এয়ার হোস্টেস ব্লাউজ,কানে দুটো রিং বাঁ হাতে ঘড়ি আর খুব লম্বা একটা বিনুনি দুলিয়ে শান্ত মুখে হেঁটে যায় যেন কী একটা গান মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে অনেক দূরে অথচ তার ইস্কুল তো কাছেই।
কদিন ধরে কিসব বিয়ের বাজার,পাকা কথা
আশীর্বাদ নতুন শাড়ি টাড়ি এসব কথা হচ্ছে বটে মাঝেমধ্যেই আত্মীয় কুটুম নতুন লোকজনও আসছে। হেমের বিয়েটাও সে আশীর্বাদের দিনের মাংস আর দই মিষ্টি খাওয়ার মতোই ভেবেছিল।তাকে ওরকম সাজতেও সে কখনও দেখেনি।
বিয়ের পরদিন সেজ মাসি, তার আদরের সেজো যাকে সে হেম বলেই বেশি চেনে কাঁদতে কাঁদতে তাকে কোলে নিচ্ছে আর হকচকিয়ে ঝিনি তার নতুন শাড়ি গয়নার সাজের মধ্যে ব্রোচটাকেই অবাক হয়ে দেখছিল। জিনিসটা এত অদ্ভুত আঙুল বুলিয়ে ,আঙুল ঘসে কিছুতেই পরখ করা শেষ হচ্ছিল না। সত্যি বলতে বিয়ে জিনিসটা বেশ ভালো।কত লোকজন সাজগোজ খাওয়া দাওয়া। তবে হেম যে কোথাও চলে যেতে পারে এটা সে ভাবতেই পারেনি।
টোপর হাতে টুকটুকে ফর্সা নতুন বর যাকে রাঙা মেসো বলে ডাকতে হচ্ছে খুবই রাগ হতে লাগল তার ওপর। দুপদাপ পা আছড়ে সে ঘোষণাও দিল যে হেম কোথাও যাবে না। তবু চকচকে শাড়ি গয়না পরে কাঁদতে কাঁদতে রাঙা মেসো আর অন্য কাদের সঙ্গে গাড়ি চড়ে সে চলে গেল কোথায়।
একদিন পর কলকাতায় হেমের শ্বশুরবাড়ির রাস্তা দেখে খুবই ভয় লাগল তার। বড় বড় বাড়ি,সরু গলিঘুঁজি, নোংরা খালের কাদাজলে গা ডুবিয়ে আছে খাটালের বিরাট মোষগুলো।ডুমো মাছি ভনভন করে উড়ছে তাদের গায়ে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে মস্ত শিং আর কান নাড়ছে তারা।বিষম অপরিচিত কালো রঙ ওই কাদাজল,অচেনা রাস্তাঘাট কিংবা তারে প্যাচানো আকাশের তলে প্রশস্ত সড়কে অদ্ভুত ট্রামগাড়ি ও দোতলা বাস,ব্যস্ত মানুষের ভিড় বেবাক অচেনা এক পৃথিবীর ইশারায় বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল ঝিনির। অতিকায় লম্বা আর পেটমোটা একটা ড্রাগনের মতো ল্যাজ আছড়ে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলছে ট্রেনটা।লাইনের ব্রিজগুলো গুমগুম করে উঠল যতবার তার বুকের ভেতরও ভয় ভয় প্রতিধ্বনি উঠল। সে খামচে ধরল মায়ের শাড়ি যেন সে হারিয়ে যাবে এক্ষুণি আর কিছুতেই খুঁজে পাবে না বাড়ির কাউকে।
হেমের শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে অবশ্য সবাই খুব আমোদ আহ্লাদ করতে লাগলো। প্যান্ট শার্ট পরা মাজা মাজা গায়ের রং একটা লোক তার গাল টিপে বলল কী খুকি?মিঠাই খাবে? বলে ঘিয়ের গন্ধওলা চমৎকার একটা খাবার তার হাতে দিল।খাওয়া দূরে থাক ঝিনি কোনোদিন তা দেখেইনি আর মিষ্টিকে তারা কেউ মিঠাইও বলে না। নাদুস নুদুস গোলগাল চেহারার তুলনায় খুবই সরু গলায় লোকটা সবাইকে ডেকে হেঁকে কথা বলছিল।
সে নাকি মেসোর ভাই। মিষ্টি যতই ভালো হোক গাল টেপায় ঝিনির ভুরু কুঁচকে ছোটর আড়ালে চলে গেল। ছোট মেসো শান্ত গলায় রাঙা মেসো আর বাবার সঙ্গে কথা বলছিল।ছোট কিন্তু আঁচল উড়িয়ে,পান খেয়ে জিভ পুড়িয়ে হেমের নতুন কুটুমদের সাথে খুব হাসছিল।
নতুন শাড়ি খসখসিয়ে এসে ঝিনিকে জড়িয়ে হেম বললো ইনি তোমার মামা হন আর ভাই রমেন, আমাদের ঝিনি গাল টেপা ঠিক ইয়ে পছন্দ করে না বলে মিষ্টি করে হাসলো। আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি তাই মোতি চুরের লাড্ডু খেয়েও মুখ অমন গোমড়া, মিহি গলায় বলল রমেন মামা।
খুব সুন্দর সাজগোজ করে রুপোলি জরি আর লাল গোলাপ দেওয়া রজনীগন্ধার মালা পরে সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিল হেম।ঝিনির তবু মনে হলো হেমের চোখে কাজলের তলায় দুঃখের মতো কী যেন লেগে আছে। হেম তার একান্ত নিজের, তার সাদামাটা আটপৌরে সাজের সেজো খুব যেন দূরের হয়ে গেছে একদিনের মধ্যে। নতুন শাড়ি আর ফুলের গয়না পরা তাকে কারা সব ও বউমা,ও নতুন মামী,শোনো দেখি ও রাঙাবৌদি বলে ডেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়।তার শাড়ি খামচে ধরেও নাগাল পাচ্ছে না ঝিনি। রাঙা মেসো ধুতি পাঞ্জাবি পরে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে।এই সব অচেনা রাস্তার আলো জ্বলা মোড়ে অচেনা বাড়িতে, অচেনা মানুষজনের হাঁক ডাকের মধ্যে হেম যেন তার হাত ছাড়িয়ে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে তার রাতের ভয় পাওয়া আদ্দেক স্বপ্নের মতোই।
পরদিন শেষতক আম কাঁঠাল পেয়ারা গাছে ঘেরা তাদের গ্ৰামের বাড়িখানায় পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে।রেইন লিলিতে ছেয়ে আছে বাড়ির রাস্তা।ওই তো তাদের পুকুর,ওই যে শরিফখাস আমগাছে টাঙানো দড়ির দোলনা।ওই সে মস্ত ঝাউগাছ বাড়ির সামনে সব গাছ ছাড়িয়ে উঠে গেছে তারাদের কাছে।বাবার লাগানো গোলাপ গাছগুলো দুলছে বাগানে আর হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে নেমে আসছে ঝিরঝির আমলকি পাতারা। কিন্তু সে টের পেল গাছপালা দেওয়া বাড়িটা কেমন নিচু আর নিঝুম হয়ে আছে। হয়তো বাড়িরও হেমের জন্য বড্ডই মন কেমন করছে।
কিছু দিন পর অবশ্য ইস্কুলের দলবল খেলার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আশ্চর্য হেমের ইস্কুলে পড়াতে যাওয়া, ছুটির পর ঘেঁটি ধরে খেলা থেকে ফিরিয়ে হাতপা ধুয়ে,চুল আঁচড়ে ঝুঁটি বেঁধে,ধেবড়ে কাজল পরিয়ে দেওয়া, তার ভালোতো রেঁধে খাওয়ানো ,সন্ধে হলে সব কাজ সেরে নিজের লম্বা বিনুনি বেঁধে সে বসত বারান্দার সিঁড়িতে। নিজের হাত দুখানা কোলে করে কি যেন ভাবত সে। কী করছিস হেম বললেও উত্তর দিত না যেন শুনতেই পেত না।ও হেম ও সেজো বলে ঝাঁকিয়ে দিলে অনেক দূরে থেকে যেন ফিরে আসত সে। কী বলছিস? এইতো শুনছি তো এমন সব ভাসা ভাসা উত্তর দিত। সেই হেমের বিচ্ছেদও আশ্চর্য ফিকে হয়ে এল তবে!
গন্ধ নিয়ে হেম ভারি খুঁতখুঁতে ছিল। সেন্ট পারফিউমের কোনো উগ্ৰ গন্ধে বিরক্ত হতো এমনকি ছাতিম ফুলের তীব্র গন্ধও সে সহ্য করতে পারে না। সে ভালবাসে যুঁই ফুল।কোন ছাত্রীর বাড়ি থেকে এনে বাগানে সে নিজে ওই একটা গাছই বসিয়ে ছিল। বছরের পর বছর তাতে ফুল আসত না বলে বাপি ঠাট্টা করে বলত ভাই সেজো তোর যত্নের ঠেলাতেই বেয়াড়া স্বভাব হয়ে যাচ্ছে লতাটার। আশ্চর্য কাণ্ড দেখো সেবারেই হেমের গাছটায় ঝেঁপে এল ছোট ছোট শাদা ফুল। দূরের কোন আকাশ থেকে অসংখ্য তারাফুল ঝাঁক বেঁধে নেমে এল যেন তার ভিজে সুবাস অবিকল হেমের শান্ত চোখের তারার মতো। ভালবাসা কেউ ভোলে না তাহলে? সাত সতেরো কত কাজ মানুষের। সেই সব অনুষঙ্গে চাপা পড়ে যায় ভালবাসা। বিচ্ছেদ ভুলে যায় মানুষ। না -মানুষের পৃথিবীতে আগড়ুম বাগড়ূম অত কাজ নেই।তারা বোধহয় ভোলে না তাই ।বাসে করে শেয়ালদা। সেখান থেকে ট্রেনে বাঘা যতীন স্টেশনে নেমে রিকশা করে যেতে হবে রাঙা মেসোদের বাড়ি।
অত গাড়ি ঘোড়া চেপে অচেনা কোন ঠিকানায় পৌঁছতে পারবে ফুলের গন্ধ? নাকি খুঁজে খুঁজে এত রাস্তা যেতে যেতে ঠিক ততটাই ফিকে হয়ে যাবে যুঁই ফুলেদের সুবাস যতখানি মৃদু হলে হেম তাদের ভালবাসবে?
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments