দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
আজ ১২ ই জুন "বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস"। এই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, শিশু শ্রম কি?
শিশুদের দ্বারা করা সমস্ত কাজকে শিশুশ্রম হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা উচিত নয়, যা তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় ,তাই শিশু শ্রমের মধ্যে পড়ে।
কিশোর-কিশোরীদের কাজে অংশগ্রহণ, যা তাদের স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত বিকাশকে প্রভাবিত করে, বা তাদের স্কুল যাওয়া থেকে বিরত করে, তা শিশু শ্রমের মধ্যে পড়ে ।
শিশুশ্রম (নিষিদ্ধকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮৬ সালে শুরু হয়।
একটি "শিশু" কে ১৪ বছরের কম বয়সী কোন ব্যক্তি হিসাবে মানা হয় তাহলে ,CLPR আইন শিশুকে যে কোন চাকরিতে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ, বা যে কোন কাজে নিয়োগ করাকে নিষেধ করে।
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শিশুশ্রম হলো, এমন কোনো কাজে শিশুদের নিয়োগ করা, যা শিশুদের শৈশব থেকে বঞ্চিত করে, তাদের নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং যা তাদের মানসিক, শারীরিক, সামাজিক বা নৈতিকভাবে ক্ষতিকর।
শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস, যা প্রতিবছর ১২ই জুন তারিখে পালিত হয়, সারা বিশ্বে। শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন কে সক্রিয় ও উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই দিনটি পালিত হয়।
শিশু শ্রমের বিরুদ্ধ দিবসটি একটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ILO অনুমোদিত দিবস,যা ২০০২ সালে চালু হয়েছিল।
🍂
বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবসের ইতিহাস খানিকটা এইরকম ছিলো।১৯১৯ সালে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রচার এবং আন্তর্জাতিক শ্রম মান স্থাপনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ILO এর ১৮৭টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র টোঙ্গা রাজ্য, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার( ILO) ১৮৭তম সদস্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারপর থেকে,ILO বিশ্বজুড়ে শ্রমের অবস্থার উন্নতির জন্য বেশ কয়েকটি কনভেনশন পাস করেছে। শুধু তাই নয়, মজুরি, কর্মঘণ্টা, অনুকূল পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়েও নির্দেশিকা প্রদান করে।
১৯৭৩ সালে, ILO কনভেনশন নম্বর গৃহীত হয়েছিল এবং চাকরির জন্য ন্যূনতম বয়সের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল। এই সদস্য রাষ্ট্রগুলির লক্ষ্য হলো, কর্মসংস্থানের ন্যূনতম বয়স বাড়ানো এবং শিশুশ্রম রোধ করা। ১৯৯৯ সালে ILO কনভেনশন নম্বর (১৮২) গৃহীত হয়েছিল এবং এটি "শিশু শ্রম কনভেনশনের সবচেয়ে খারাপ ফর্ম" হিসাবেও পরিচিত ছিল। এই দিবসের লক্ষ্য হলো,শিশু শ্রমের সবচেয়ে খারাপ রূপটি দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) মতে, শিশুশ্রম হলো "এমন কাজ, যা শিশুদের শৈশব, তাদের সম্ভাবনা এবং তাদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে, এবং যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর"। এটি এমন ধরনের কাজ, যা শিশুদের শিক্ষা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ILO আরও বলে যে, শিশুশ্রম হলো,এমন ধরনের কাজ, যা শিশুদের উপর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রভাব ফেলে এবং কোনো না কোনোভাবে তাদের ক্ষতি করে। প্রকৃতপক্ষে, যে কোনো ধরনের কাজ, যা শিশুদের স্কুল শিক্ষা গ্রহণে বাধা দেয়, তাও শিশুশ্রমের মধ্যে পড়ে।
এটিকে মূলত তিনটি রূপে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে,
যেমন,
১.এমন কাজ যা শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে।
২.এমন কাজ, যা একটি শিশুকে অল্প বয়সে স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ্য
৩.এবং এমন কাজ, যার জন্য শিশুদের স্কুলে যেতে হয়, অথচ ভারী কাজের চাপ থাকে।
বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবসের তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনেক।এই দিনটি প্রধানত, শিশুদের বিকাশের উপর ফোকাস করে এবং এটি শিশুদের জন্য শিক্ষা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার রক্ষা করে,সুতরাং বলা যেতে পারে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রচারিত ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে। বিভিন্ন সংস্থা,ILO ইত্যাদি শিশুশ্রম রোধে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আমাদেরও সচেতন হওয়া উচিত এবং শিশুশ্রম দূরীকরণে সাহায্য করার জন্য আমাদের দায়িত্ব পালন করা উচিত। এখানে সঠিকভাবে বলা হয়েছে যে, শিশু শ্রম থেকে বেরিয়ে আসা শিশু তার সম্ভাবনা এবং আত্ম-মূল্য সম্পর্কে জানতে পারে। তারা, নিজের জীবন, মানবাধিকার এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন উপভোগ করতে শুরু করে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের শিশুরা দেশের তথা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতিতেও অবদান রাখবে। শিশুরা্ই তো দেশের ভবিষ্যৎ।
শিশু শ্রম সম্পর্কে জাতিসংঘের মতে, কিছু তথ্য তুলে ধরলাম,৫-১৭ বছর বয়সী প্রায় ১৬০ মিলিয়ন শিশু শিশুশ্রমে ছিলো,এবং তাদের প্রায় অর্ধেক যা প্রায় ৭৩ মিলিয়ন বিপজ্জনক শিশুশ্রমে রয়েছে।
প্রত্যেকটা দিবসের একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় বা থীম থাকে।বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস ২০২৩ থিম ছিলো,
*"সকলের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার। শিশুশ্রমের অবসান হোক!*
এই বছরের থিমটি নির্দেশ করে যে, শিশু শ্রমের অবসান ঘটতে পারে, যদি মূল কারণগুলি সমাধান করা হয় এবং এটি প্রত্যেকের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা দাবি করে। জাতিসংঘের মতে, "বিশ্বব্যাপী শুধুমাত্র ২৬.৮% শিশু সামাজিক সুরক্ষা নগদ সুবিধা পায়"। সামাজিক সুরক্ষা ভিত্তি তৈরি করার পরিকল্পনা, যা শিশুদের, শিশুশ্রম থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করতে পারে।
প্রায় ১৬০ মিলিয়ন শিশু এখনও শিশুশ্রমে রয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে যে, "আফ্রিকা,এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একত্রে বিশ্বব্যাপী প্রতি দশজন শিশুর মধ্যে নয়টি শিশু, শিশু শ্রমিক হিসেবে জীবনযাপন করছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) শিশু শ্রম বিরোধী দিবসের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং শিশুদের জন্য শালীন কাজ প্রচারের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের ২০২৩ সালের ১১১তম অধিবেশন উদযাপন করে।
এই সংস্থার লক্ষ্য ছিলো,শিশু শ্রম রোধে সচেতনতা ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি করা। এটি ILOকনভেনশন নং ১৩৮ অনুমোদনের মাধ্যমে চাকরির জন্য সর্বনিম্ন বয়স এবং ILO কনভেনশন নং ১৮২ মাধ্যমে শিশু শ্রমের সবচেয়ে খারাপ ধরনটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
ILO এর মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫২ মিলিয়ন শিশু, শিশুশ্রমে নিয়োজিত, যা ভাবতে অবাক এবং লজ্জা লাগে। এদের মধ্যে আবার ৭২ মিলিয়ন শিশু বেশ বিপদজনক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে। ২০০০ সালের পর থেকে শিশু শ্রমে প্রায় চার মিলিয়ন শিশু শ্রমিক হ্রাস পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই হ্রাসের হার দুই তৃতীয়াংশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং জাতিসংঘের সংস্থা, যা কাজের জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টায় বিশ্ববাসীর মনোযোগ আনতে এবং বিশ্ববাসীর অংশগ্রহণের জন্য ২০০২ সালে বিশ্ব শিশু শ্রম বিরুদ্ধ দিবস চালু করে।
এই দিনটি সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষিত সমাজ, আন্তর্জাতিক শ্রমিক এবং নিয়োগকারী সংস্থাগুলিকে একত্রিত করে, শিশু শ্রমের সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে এবং শিশু শ্রমিকদের সাহায্য করার জন্য নির্দেশিকা নির্ধারণ করে।ILO এর তথ্য অনুসারে সারা বিশ্বের লক্ষ, লক্ষ মেয়ে এবং ছেলে এমন কাজে জড়িত, যা তাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবসর এবং মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে,আর এইভাবেই তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। এই শিশুদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু শ্রমের নিকৃষ্ট কাজের মুখোমুখি হয়। তাদের বিপজ্জনক পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের কাজ, দাসত্ব বা জোরপূর্বক শ্রম, মাদক পাচার ও পতিতাবৃত্তির মতো অবৈধ কার্যকলাপের পাশাপাশি স্বশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পর্যন্ত পড়তে বাধ্য হয়।
কোভিড নাইনটিন মহামারীর পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা এবং শ্রমবাজারের ধাক্কা অনেকের জীবন ও জীবিকার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই সংকট লক্ষ, লক্ষ শিশুকে শিশু শ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যাইহোক, আমাদের সচেতন অভিভাবক ও নাগরিক হতে হবে এবং বুঝতে হবে, এই শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যতের নাগরিক, তাদের জীবন যাতে উজ্জ্বল ,সরল-স্বাভাবিক হয়, সেই জন্য আমাদের প্রত্যেককে এই বিষয় নিয়ে ভাবতে এবং কিছু করতে হবে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments