জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৭ /বিজন সাহা

কাজানস্কি ছেলেদের মনাস্তির

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৭ 

বিজন সাহা 

তামবভে এক রাত 


তামবভে এবারই আমার প্রথম আসা যদিও এই শহরের নাম শুনেছি অনেক। তামবভের নেকড়ে তোমার কমরেড নয় – এটা একটি বহুল প্রচলিত বাক্য। ধারণা করা হয় যে তামবভের কৃষকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান যা আন্তোনভ বিদ্রোহ নামে পরিচিত তখন থেকেই তামবভের নেকড়ে কথাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে এই প্রবাদের সাথে আরও অনেক ভার্সন জড়িত আছে। এদেশে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের আগে এই এলাকায় স্লাভিক ও ফিনো-উগর জাতির বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বসবাস করত। তারা আধা যাযাবর জীবন যাপন করলেও সংসারীও ছিল। ধারণা করা হয় যে স্থানীয় লোকজন ছিল মূর্তি পুজারী আর তাদের ঈশ্বরের বাহ্যিক রূপ ছিল নেকড়ের মত। হয়তো পাশের রাজ্যের জনগণের মনে এই এলাকার মানুষের ভাবমূর্তি ছিল নেকড়ের মত যা স্লাভিক পুরাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এভাবেই নেকড়ে এখানে লোককথার নায়কে পরিণত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে রামায়ণ মহাভারতেও অনেক জাতিই আর্যদের চোখে বানর, ভালুক ইত্যাদি রূপে প্রকাশ পেত। স্লাভিক লোককাহিনীতে নেকড়ে পরলোকের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করত, যার সাহায্য ছাড়া সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের পূর্বে নেকড়ে ছিল পজিটিভ হিরো – সাহস, প্রবৃত্তি ও সংকল্পের প্রতীক।     

১৬৩৬ সালে এখানে দুর্গ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যাযাবর ও দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তামবভকে পরিণত করা হয় মস্কো রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তের অন্যতম প্রধান ফাঁড়িতে। তখন এখানে বিভিন্ন ধরণের বন্দীদের পাঠানো হতে থাকে, কেননা ৬ মিটার উঁচু দেয়াল ডিঙিয়ে তাদের পক্ষে পালানো ছিল প্রায় অসম্ভব। সামন্তদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সপ্তদশ শতকের মধ্য ভাগে কৃষকেরাও এখানে পালিয়ে আসতে শুরু করে। এসব কৃষকেরা রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন মনত না, নিজের ইচ্ছে মত বসবাস করত, যা কিনা নেকড়ের আইন নামে পরিচিত। অনেকের ধারণা এখান থেকেই তামবভের নেকড়ে কথাটি প্রচলিত। ইভান অবসিয়াননিকভের মতে এই প্রবাদের জন্ম উনিশ শতকে। তমবভ ছিল কৃষি প্রধান অঞ্চল। প্রায়ই তামবভের কৃষকেরা কাজের খোঁজে আশেপাশের শহরে যেত ও তুলনামূলক কম বেতনে কাজ করত। এটা স্থানীয় লোকজনের কর্ম সংস্থানে সমস্যা সৃষ্টি করত। তখন তারা বলত আবার তামবভের নেকড়ে এসেছে কাজের খোঁজে। ১৯২০-১৯২১ সালে তামবভ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সোভিয়েত রাজের শাসনে অসন্তুষ্ট কৃষকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রায় সমস্ত এলাকার প্রশাসন নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। সরকারের দখলে ছিল শুধু শহরগুলো। গ্রাম এলাকায় পুরোপুরি বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়, সোভিয়েত রাজ সেখান থেকে উৎখাত করা হয়। পার্টিজানদের মধ্যে রেড আর্মির মতই শৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। সেখানে তাভারিশ বা কমরেড সম্বোধন চালু ছিল। যখন চেকিস্ট মানে কেজিবির লোক জেরা করার সময় ওদের কমরেড বলে সম্বোধন করত, ওরা বলত তামবভের নেকড়ে তোমার কমরেড নয়। 

কাজানস্কি মনাস্তিরের চ্যাপেল

মস্কো জারের সেনাপতি রোমান বাবোরিকিন ১৬৩৬ সালের ১৭ এপ্রিল (নতুন পঞ্জিকা অনুসারে ২৭ এপ্রিল) তামবভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। একটি জিনিস খেয়াল করবেন যে ১৬২৬ সালে জুলিয়ান ও গ্রেগরিয়ান দুই পঞ্জিকার মধ্যে ব্যবধান ছিল ১০ দিন। অক্টোবর বিপ্লব হয় ১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর বা নতুন পঞ্জিকা অনুযায়ী ০৭ নভেম্বর। এখানে ব্যবধান ১২ দিন। বর্তমানে সেটা ১৩ দিন। তার মানে জুলিয়ান ও প্রেগরিয়ান এই দুই পঞ্জিকার ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। যেখানে ৎসনা ও স্তুদেনৎসা নদী দুটো মিলিত হয়েছে সেখানে এই শহর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ছয় মিটার উঁচু দেয়াল তৈরি হয় ওক কাঠ দিয়ে। তামবভের এই দুর্গে ছিল ক্রেমলিন  আর সেনানিবাস। দক্ষিণ দিকে সে গভীর খাদ দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। এই খাদের দুই প্রান্ত ৎসনা ও স্তুদেনৎসা নদীর সাথে যুক্ত ছিল। সেখানে এক হাজারের বেশি সেনার গ্যারিসন ছিল। দুর্গের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্রিমিয়ার তাতার ও নগাইদের আক্রমণের হাত থেকে মস্কো রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত রক্ষা করা। যদিও শহর তৈরি ছিল ব্যায়বহুল ও কষ্ট সাপেক্ষ, কিন্তু সেটা তাতারদের অকস্মাৎ আক্রমণ পরতিহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধীরে ধীরে এখানে লোকজন এসে বসবাস করতে শুরু করে। কৃষকরা আসে উর্বর জমির লোভে এবং সামন্ত রাজাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য। কিন্তু কৃষকের পরে আসতে শুরু করে সামন্তরা। ফলে ১৬৭০ সালে শুরু হয় বিদ্রোহ। প্রায় তিন হাজার বিদ্রোহী তামবভ শহর অবরোধ করে। ১৬৭১ সালের বসন্তে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে তামবভ আজোভ অভিযানে অংশগ্রহণকারী রুশ সেনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে পরিণত হয়। কিন্তু সেই অভিযান ব্যর্থ হলে প্রথম পিওতর রুশ নৌ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেখানেও তামবভের কৃষকেরা অংশ নেয়। তামবভের কাঠ হয় প্রথম রুশ নৌবহরের ভিত্তি।        

🍂

১৭০৮ সালে দন নদীর তীরে বুলাভিন অভ্যুত্থানের ঢেউ তামবভে এসে পড়ে। এখানকার লোকজন প্রকাশ্যে অভ্যুত্থানের সমর্থন করে। ১৭০৮ সালের মার্চ মাসে ৩০০ লোকের এক দল শহর ত্যাগ করে বুলাভিন বিদ্রোহে  যোগদান করে। সে বছর এপ্রিল মাসে বুলাভিনের লোকেরা তামবভ অবরোধ করে। পুরানো দুর্গ অগ্নি কাণ্ডে ধ্বংস হয়ে গেলে ১৭৩৮ সালে নতুন দুর্গ নির্মাণ করা হয়। তখন থেকে তামবভের কৃষকেরা শহর রক্ষার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পায়। ১৭৭৫ সালে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনা ভূমি সংস্কার করেন যার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় তামবভ ভাইসরয়ালটি। এর কেন্দ্র হয় তামবভ। তামবভ ভাইসরয়ালটি আয়তনের দিক থেকে বর্তমান তামবভ প্রদেশের চেয়ে বড় ছিল। এখানে বর্তমান তামবভ ছাড়াও বর্তমান মরদভা, লিপেৎস্ক, ভরোনেঝ, পেনজা ও রিয়াজান প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৭৯৬ সালে প্রথম পাভেলের আদেশে তামবভ ভাইসরয়ালটি প্রদেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই তামবভ প্রদেশ রুশ সাম্রাজ্যের শস্য ভাণ্ডারে পরিণত হয়। ১৮১২ সালের প্রথম পিতৃভূমির যুদ্ধের সময় স্থানীয় লোকদের অর্থে ১২ হাজার সেনার এক গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়। এর নেতা নির্বাচিত হন অবসরপ্রাপ্ত এডমিরাল ফিওদর উশাকভ। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি শারীরিক ভাবে এর নেতৃত্ব দিতে পারেননি, যদিও ৫০০ রুবল তহবিলে দান করেন। যখন শত্রু মস্কোর কাছে চলে আসে মস্কো ও উপকণ্ঠের বিভিন্ন শহরের উদ্বাস্তুরা তামবভে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ১৮২৪ সালে এখানে প্রথম জিমনেশিয়াম ও ১৮৩৩ সালে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানা যায় যে ১৮৪০ সালে তামবভে ৪৫ টি রাস্তা ছিল, যার দুটো স্তুদেনৎসা ও ৎস্না নদীর তীর বরাবর। ২৩৩২ টি বাড়ির মধ্যে ৬৯ টি ছিল পাথরের তৈরি। সে সময় তামবভে ভজনেসেনস্কি মেয়েদের ও কাজানস্কি ছেলেদের মনাস্তির কাজ করত।  এছাড়াও ছিল স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি সাবর, ত্রইস্কি গির্জা, ইত্যাদি। ১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরে ৪ মার্চ মেনশেভিক ও এসেররা (বিপ্লবী পার্টি) কার্যকরী কমিটি গঠন করে, একই সাথে সেখানে কাজ করতে শুরু করে বলশেভিকদের সোভিয়েত। নভেম্বর বিপ্লবের পরে ক্ষমতা বলশেভিকদের হাতে চলে আসে। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ ফ্রন্টে যুদ্ধরত তামবভ বাসীরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নিজদের শহরে চলে আসে এবং বলশেভিকদের পক্ষে প্রায় ৬০০ সেনার এক বাহিনী গড়ে তোলে। ১৯১৮ সালে তামবভ হয়ে চেকস্লভাকিয়ার সেনারা মস্কোর দিকে ধাবিত হয়। এরা তখন গৃহযুদ্ধে সাদা বা বেলিদের পক্ষে বলশেভিক বা লাল ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। তামবভে তাদের নিরস্ত্র করে ভ্লাদিভোস্তকের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি রাতে সেখানে মেনশেভিক ও এসেরদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এভাবে তামবভ সম্পূর্ণ বলশেভিকদের হাতে চলে আসে। ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ সেখানে সোভিয়েতের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় শহর শ্রমিক সোভিয়েত। ১৭-১৯ জুন ১৯১৮ সালের মেনশেভিক ও এসেরদের নেতৃত্বে শহরে অভ্যুত্থান ঘটে। তারা তামবভের ব্যারাক দখল করে নেয়। তাদের দমন করার জন্য লাল ফৌজ ও লাটভিয়ার বাহিনী পাঠানো হয়। লাটভিয়ার বাহিনী মূলত লাটভিয়দের নিতে গঠিত এবং  হিংস্রতার জন্য তারা কুখ্যাত। ৪২ ঘন্টার মধ্যে অভ্যুত্থান দমন করা হয়। ১৯২০ – ১৯২১ সালে সমস্ত তামবভ প্রদেশ জুড়ে শুরু হয় সশস্ত্র অভ্যুত্থান, বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা বিভিন্ন এলাকার সোভিয়েত বিলুপ্ত করে, তাদের প্রতিনিধিদের হত্যা করে, সেনাবাহিনী কোন কোন জনপদে ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকেই তামবভে শিল্পায়নের সাথে সাথে শুরু হয় সংস্কৃতির বিকাশ। সেখানে পেশাদার থিয়েটার কাজ করতে শুরু করে যার প্রধান নিযুক্ত হন স্তানিস্লাভস্কির ছাত্র স্নিগেরেভ। ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি আন্তন লুনাচারস্কির উপস্থিতিতে প্রাদেশিক সোভিয়েতের কংগ্রেস কাজ শুরু করে। ১৯২৮ সালে রেলের বগি নির্মাণ ও মেরামতের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩০ সালে পেডাগজিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান। একে একে গড়ে ওঠে পাপেট থিয়েটার, ফিলারমনি। ১৯৬০ এর দশকে শুরু হয় শিল্পায়ন। ১৯৭০ – ১৯৮০ দশকে তামবভ তার উন্নতির শিখরে পৌঁছে। ১৯৮৬ সালের তামবভের লোকসংখ্যা ছিল তিন লাখ। এই সময় তামবভ পালন করে ৩৫০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।  

সূর্যমুখীর খোঁজে

আমাদের তামবভ অবস্থান ছিল স্বল্পস্থায়ী। আমরা যখন এসে পৌঁছুই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। তাই শুধু দোকানে গিয়ে রাতের খাবার কেনা ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। তাছাড়া বিশ দিনের দীর্ঘ ভ্রমণের পরে শরীর আর আগের মত তরতাজা ছিল না। বাড়ি ফেরার জন্য মন কেমন করছিল। সকালে খাবার খেয়ে আমরা বেরুলাম মস্কোর উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল কাজানস্কি ছেলেদের মনাস্তির। মাত্র মিনিট পাঁচেকের জন্য নেমে কয়েকটি ছবি নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম মস্কোর দিকে। সেদিক থেকে তামবভ আমার দেখাই হয়নি, যেমনটা হয়নি সামারা দেখা। তারপরেও এসব শহর স্মৃতির পাতায় থেকে যাবে। আবার কখনও ভোলগা ভ্রমণের গল্প করতে গিয়ে ভেসে উঠবে তামবভের শেষ রাতের কথা। হ্যাঁ, তামবভের রাত ছিল আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণের শেষ রাত।                   

তামবভ
https://www.youtube.com/watch?v=_98mTOMWNKk&t=22s

ছবিতে তামবভ 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=269



Post a Comment

0 Comments