আটত্রিশতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনেই হয়তো এমন কিছু কিছু দ্বিধান্বিত মুহূর্ত আসে, কর্তব্য ঠিক করতে দিশাহারা বোধ হয়। এখনও মনে পড়ে,বিরজারও সে মুহূর্তে সেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাই হয়েছিল। নিয়মিত কাগজ পড়তেন, হেমন্ত বসুর হত্যা ও তৎসংলগ্ন তীব্র আন্দোলনের ঢেউ কিভাবে ধীরে ধীরে যুবসমাজে ছড়িয়ে পড়ছে,দেশে যে কি চলছে,তার মোটামুটি সব খবরাখবরই জানতেন। কখনও কখনও রাত্রে যখন খোকাকে এবং ঐ ছেলেটিকে খেতে দিতেন, তাদের সঙ্গে সেসব আলোচনাও করতেন।বড়ো দাদার মুখে শুনেছিলেন ছোট দাদা তার পরিবারকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওদের খিদিরপুরেও নাকি খুব গোলমাল চলছে। কয়েকদিন আগে,ছোট দাদার বড়ো ছেলেটি দেখা করতে এসেছিল।তার বয়ানে শুনেছিলেন, ওদের বাসস্থান অর্থাৎ,1/4হেমচন্দ্র স্ট্রীটের চৌধুরী এস্টেটের প্রাসাদোপম অট্টালিকা “নিউক্যাসল “-এর দেওয়াল জুড়ে নাকি বড় বড় কালো অক্ষরে “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”,”কমরেড মাও-সে-তুং লাল সেলাম” ইত্যাদি পোষ্টার পড়েছে।
ঐসব দেখে শুনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছেলেটিকে আর সেখানে রাখতে সাহস পায়নি ছাপোষা মধ্যবিত্ত ছোটদাদা।পড়া বন্ধ করে,মা ও ছোট ভাই দুটি সহ তারা দেশে ফিরেছে।দেশ ও সমাজ এক সংকটকালীন ক্রান্তিলগ্নের সাক্ষী।
কিন্তু তার ঢেউ যে এভাবে তাঁর একান্ত পরিসরেও এসে পড়েছে,তার হদিস তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। শুনেছিলেন, মেদিনীপুর নাকি বিপ্লবের আঁতুড়ঘর, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির,ক্ষুদিরাম বসু-বিমল দাসগুপ্তের জীবনপাঠ নেওয়া সেই বিখ্যাত কলিজিয়েট স্কুলটিও দেখেছেন। কিন্তু সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে বসে থাকা সুদূর বাঁকুড়া থেকে আসা ঐ ছেলেটার মনে মনে এই ছিল!ও কি এসবে যুক্ত! তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে তাঁদের এতো বড়ো বিপদে ফেলে যাওয়া কি তার ঠিক হলো?এখন কি করবেন তাঁরা!
খালি ঘরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কি যেন ভেবে নিলেন;পরের কর্তব্য কর্ম। তারপরেই দরজার সামনে এসে খোকাকে ডাকলেন চাপাস্বরে, খোকা এলে তাকে কাগজটি দেখালেন, এবং সংক্ষেপে সব বলে হাতের দলা পাকানো কাগজটি মুখে পুরে চিবিয়ে গিলে ফেললেন।
এখনও মনে পড়লে হাসি পায়, সব শুনে পরবর্তী সময়ে শহরের দুঁদে উকিলে পরিনত হওয়া সেই সদ্য তরুণের আর্ত প্রতিক্রিয়া,
-’এখন কি করবো পিসিমা?’
-’কিচ্ছু করতে হবেনা। তুই শুধু আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ আর না তে না বলবি।’
এখন ঘরে গিয়ে বলি চ’, আমার বাহ্য পেয়ে গিয়েছিল,তাই তুই দাঁড়াতে এসেছিলি।’
-’কিন্তু ওর কথা!’
-’কাউকেই কিছু বলার দরকার নেই। আমি আছি তো…’
তারপরে আবার খোকাকে বাইরে রেখে তিনি ছেলেটির ঘরে ঢুকেছিলেন, এলোমেলো যা কিছু ছিল, বইপত্র-জামাকাপড়…কিচ্ছু নেই!দেখে মনেই হবেনা, দুঘন্টা আগেও গত প্রায় একমাস ধরে থাকা একটা মানুষের অস্তিত্ব এখানে ছিল…
তবুও বিছানার চাদর খানিক ঝেড়ে অন্ধকারের ধনটিকে অন্ধকারেই রেখে মাতৃসমা ফিরেছিলেন আপন সংসার বৃত্তে।
🍂
এসে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বলেও ছিলেন সবাইকে যে ওর আজ তো চলে যাবার কথাই ছিল। তিনি জানতেন, বাকিরা কষ্ট পাবেন বলে বলেননি তিনি।
তারপরে অবশ্য এটাও যোগ করেন,
-’বাছা আমার এমন দিনটায় গেল! ঠিকঠাক পৌঁছতে পারলো কিনা কে জানে!’
দাদা জানতে চেয়েছিলেন,
-’কখন বেরিয়েছিল? কোথায় গেল?’
-’কলকাতায় গেল তো। আগামীকাল থেকে নাকি তার পরীক্ষা শুরু। গেছে তো ট্রেনে,ঐ ধরো তিনটে কি তিনটে পনেরো হবে। তোমরা ঘুমোচ্ছিলে বলে আর ডাকিনি’
বেড়াই মশাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,খোকা বললে,
-’তবে নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৌঁছে গেছে।ঐ সময়ে তো একটা এক্সপ্রেস ট্রেন আছে, হাওড়া যাওয়ার…’
রাত তখন প্রায় দশটা,সন্ধ্যার অসহ্য টেনশ্যন খানিক গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে শহরের।ধীরে ধীরে সবাই ঘুমোবার প্রস্তুতি নিলেন।বিরজা সে রাতে বৌমার পাশটিতেই শুলেন। দরজা সমান বড়ো বড়ো জানলার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশে তারার ঝিলমিল,বর্ষা ধোওয়া নির্মেঘ আকাশ জুড়ে অদৃশ্য জোৎস্না লোক, ভার শূন্য মনে কি যেন ভাবছিলেন সেদিকে তাকিয়ে, হঠাৎ বৌমার ফিসফিস স্বর,
-’পিসিমা! দাদা কি সত্যিই কলকাতা গেছে?নাকি…’
-’চুপ!চুপ কর মা!সব কথা সবসময়েই সবজায়গায় বলতে নেই। জীবন অনেক বড়ো, কিছু লুকিয়ে, কিছু গুছিয়েই বাঁচতে হয় মধ্যবিত্ত জীবনে।মায়ের এ কথাটা মনে রাখিস…’
অসুস্থ কন্যাসমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন আরও এমন সব অসংলগ্ন কথা,তাঁর নিজের মনেও অজানা আশঙ্কার দোলাচল;মনে মনে অবিরল প্রার্থনা করেছিলেন ঐকান্তিক শুভকামনায়,
-’ওকে ভালো রেখো গো ঠাকুর!ওকে ভালো রেখো।’
হঠাৎ হুঁস ফিরেছিল আবার বৌমার ডাকেই,
-’পিসিমা! তুমি যে দুপুরে পায়েস করেছিলে, দাদা তো খেতেও পেলনা গো!’
-’খেয়ে গেছে। আমি ওর জন্যই করেছিলাম।ওকে খাইয়েছি।’
অসংলগ্ন উত্তর ছিল তাঁর…
-’তুমি তার মানে জানতে!’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন বোনের,যা খানিক বিরক্ত করেছিল তাঁকে। অসন্তুষ্ট গলায় বলে উঠেছিলেন,
-’বললাম যে,মেয়েমানুষকে কিছু কাঁচিয়ে, কিছু উজিয়ে বাঁচতে হয়!’
গলায় বোধহয় ঝাঁঝ ছিল একটু।ভয়ে ভয়ে কাছে সরে এসে বলেছিল আসন্নপ্রসবা,
-’আর পায়েস নেই!একটু দেবে আমায়! শুধু মুড়ি খেয়ে খিদে মরেনি আমার!’
ঐ কথাতেই যেন কল্পজগৎ থেকে আবার ফিরেছিলেন ঘোরতর বাস্তবে।অভীজ্ঞ গৃহিণীর গলায় বলেছিলেন,
-’না মা।ও পায়েস আর খেতে হবেনা। আমি আবার করে খাওয়াবো তোমায়।’
-’কেন গো পিসিমা!আর একটুও নেই!কি সুন্দর গন্ধ উঠেছিল দুপুরে!দেবভোগ্য পরমান্ন।ভেবেছিলাম…’
- না।না।আছে। কিন্তু আঢাকা রয়ে গিয়েছিল ভুলে,বেড়াল টিকটিকি কি বসেছে কি জানি!ও আর খেতে হবেনা কাউকে…’
উঠে গিয়ে বিস্কুটের কৌটৌ আর জল এনে খাইয়েছিলেন তাকে।পরের সকালে উঠে সবাই যখন পায়েসের কথা জানতে চেয়েছিল,তাদেরও একই উত্তর দিয়েছিলেন, হাঁড়িশুদ্ধ ঢেলে দিয়েছিলেন শিউলি গাছতলায়,মাটি চাপা দিয়ে।
পুজো শেষে সবাই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল,যথাসময়ে মেদিনীপুরের রেডক্রসের নার্সিংহোমে তৃতীয় প্রজন্মের সুস্থ এবং সুখী আগমন হয়েছিল,খোকা-বৌমাও নিজেদের জীবনে ভালোই ছিল।
শুধু কেন কে জানে!আর মেদিনীপুরে থাকতে মন টিকতোনা তাঁর।কোন খবর আসেনি ছেলেটির,পায়েস করে খাওয়ানোও হয়নি আর বৌমাকে।আজ মনে হয়, ছাপোষা মধ্যবিত্ত গৃহিণী খাবারটি থাকতেও খেতে দেননি পূর্ণগর্ভিনীকে;ভয় পেয়েছিলেন কি! অযোনিসম্ভূত কোন অনিন্দ্য বিপ্লব-বীজ উচ্ছিষ্ট পরমান্নের সঙ্গে সঙ্গে যদি নবপ্রাণমুকুলে সঞ্চারিত হয়!কে জানে! কিছু প্রশ্ন তো জীবনভ’র দূর্জ্ঞেয়ই রয়ে যায়…(ক্রমশঃ)
0 Comments