জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭১/বিজন সাহা

রীবিনস্কের রাস্তায়

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭১

বিজন সাহা 

রীবিনস্ক   


রীবিনস্ক ভলগা তীরের আরোও একটি শহর যেখানে যাওয়ার প্ল্যান আমি দিলীপের সাথেই করেছিলাম। কিন্তু এর ভৌগলিক অবস্থানের কারণে করা হয়নি। সে সময় আমরা উগলিচ থেকে ১০৮ কিলোমিটার দূরে ইয়ারোস্লাভল চলে যাই। রীবিনস্ক যেতে হলে উগলিচ থেকে ৭৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে যেতে হত আর সেখান থেকে ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে ইয়ারোস্লাভলে পৌঁছুতে হত। এতে করে আমাদের ভোলগা ভ্রমণ আরও দীর্ঘ হত। সেসময় হাইওয়ে ছিল না, ফলে ভোলগা নিজের মত করে উগলিচ থেকে ইয়ারোস্লাভলে গেছে রীবিনস্ক হয়ে। এখনকার মত জিপিএস থাকলে ভোলগা নিশ্চয়ই এই বোকামি করত না। তা যে কারণেই হোক, সে সময় আমরা রীবিনস্ক যাইনি। এবার, মানে ২০২৪ সালের ২৮ এপ্রিল যখন একটা এক্সারশনের আয়োজন করা হল, চলে গেলাম সেখানে। আসলে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে আমরা অনেক দিনের। ২০০৬ সাল থেকেই আমি বিভিন্ন ফটো সাইটে ছবি আপলোড করা শুরু করি। এদের একটি ছিল ফটোলাইন। ওরা একবার এসব ফটোগ্রাফারদের ছবির একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে রীবিনস্কে। আমার একটি ছবিও সেখানে নির্বাচিত হয়েছিল। সে সময় বিভিন্ন কারণে যাওয়া হয়নি। তবে যাওয়ার ইচ্ছেটা তখনই গড়ে ওঠে। আর এ কারণেই দিলীপ ভোলগা ট্রিপের আয়োজন করলে আমি রীবিনস্ক রাখি। যাহোক, শেষ পর্যন্ত সেখানে যাওয়া হল। আজ সে গল্প শোনাব।

ভোলগার উপর সেতু

ইয়ারোস্লাভল প্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর রীবিনস্ক ভোলগা, শেক্সনা ও চেরিওমুখা নদী ত্রয়ের মিলন কেন্দ্রে অবস্থিত। ভোলগা ও চেরেওমুখা নদীর মিলন স্থলে ভোলগার দক্ষিণ তীরে রীবিনস্ক শহর গড়ে উঠেছে। ভোলগার বাম তীর যেখানে শেক্সনা নদী এসে মিলিত হয়েছে সেখানকার প্রাচীন জনপদ উস্ত-শেক্সনা রীবিনস্কের অন্তর্ভুক্ত হয় বিংশ শতকের শুরুতে ব্যাপক শিল্পায়ন কালে। শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে পাওয়া গেছে প্রস্তর যুগের জনবসতির নমুনা। ধারণা করা হয় যে রীবিনস্ক ভোলগার অন্য তীরে অবস্থিত প্রাচীন জনপদে উস্ত-শেক্সনার   উত্তরসূরি। উস্ত-শেক্সনার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৭১ সালের দিনপঞ্জিতে। সেই হিসেবে রীবিনস্ক এলাকার প্রাচীনতম পাঁচটি শহরের একটি। তবে রীবিনস্ক শহরের মর্যাদা পায় ১৭৭৭ সালে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনার আদেশক্রমে। অক্টোবর বিপ্লবের আগে রীবিনস্ক ছিল রাশিয়ার অন্যতম প্রধান শস্য বিক্রয় কেন্দ্র। সে সময় একে বলা হল গুণ টানা মানুষদের রাজধানী।  প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে জানা যায় উস্ত-শেক্সনার রাস্তাগুলি ছিল পরস্পরের সমান্তরাল, সেখানে লোকজন পেশায় ছিল কামার, কুমার, সূত্রধর, জেলে, শিকারী। এছাড়া হাড়ের উপরেও তারা কাজ করত। যখন ফিন-উগর জাতিগোষ্ঠীকে রোস্তভ এবং রোস্তভ-সুজদাল এসব প্রাচীন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তখন স্লাভিক রাজ্যের উত্তর সীমান্ত ফাঁড়ি হিসেবে উস্ত-শেক্সনা গড়ে ওঠে। এই শহরের ভৌগলিক অবস্থান উত্তরাঞ্চল, বালটিক ও কাস্পিয় এলাকার সাথে যোগাযোগের জলপথ ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১২৩৮ সালে তাতার-মঙ্গোলদের আক্রমণের সময় উস্ত-শেক্সনা প্রচণ্ড রকম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অগ্নিকান্ডে জনপদের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে উস্ত-শেক্সনা ইয়ারোস্লাভ রাজ্যের অংশ ছিল। ১৪৯৩ সালে এই শহর মস্কো রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৫০৪ সালের জার তৃতীয় ইভানের একটি নির্দেশনামায় রীবনায়া স্লবোদা বা মৎস্য জনপদ ও উস্ত-শেক্সনার উল্লেখ পাওয়া যায়।         

জার ইভান দ্য টেরিবল ১৫৫৩ সালে উগলিচ থেকে শেক্সনা ও রীবনা আসেন এবং সেখান থেকে ভোলগা পথে রমানভ ও ইয়ারোস্লাভল যান। জার পরিবার ষোড়শ শতকে অনেক বার রোস্তভ, ইয়ারোস্লাভল ও বেলোওজেরোর তীর্থ স্থান পরিভ্রমণ করেন শেক্সনা, রমানভ, রীবনাইয়া স্লবোদা, উগলিচ এসব নদীবন্দর হয়ে। এসব ভ্রমণ কালে জার বিভিন্ন উপঢৌকন নিয়ে আসেন। সপ্তদশ শতকে রীবনাইয়া স্লবোদায় প্রথম পাথরের বাড়ি তৈরি হয়। জনপদের কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন বাড়িঘর এমনকি চেরেওমুখা নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেসব বাড়িতে ছিল মূলত জেলেদের বসবাস। সেই আমলের স্থাপনার মধ্যে একমাত্র কাজানের ঈশ্বর মাতার উদ্দেশ্যে ১৬৯৭ তৈরি গির্জা এখনও টিকে আছে। এটাই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা।    

🍂

১৭১২ সালে প্রথম পিওতর রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী মস্কো থেকে সাঙ্কত পিতেরবুরগে স্থানান্তরিত করলে কাস্পীয় এলাকা ও সাইবেরিয়ার সাথে বাল্টিক এলাকার বাণিজ্য ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে রীবনায়া স্লবোদার গুরুত্ব বহুলাংশে বেড়ে যায়। ১৭৭৭ সালে রীবনায়া স্লবোদা ইয়ারোস্লাভল প্রদেশের কাউন্টি শহর হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর নামকরণ করা হয় রীবনা। তবে প্রায় সাথে সাথেই তা রীবিনস্ক নামে পরিচিতি পায়। ভীশনেভোলঝস্কি জলপথ আবিষ্কারের পরে রীবনায়া স্লবোদা দিয়ে চলাচলকারী মালবাহী জাহাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে এই শহর দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। গমের বেচাকেনা এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে রাশিয়া সেটা হিসেবে না রেখে পারে না। ১৮৬৩ সালে শেক্সনা নদী বরাবর রেলপথ তৈরি শুরু হয়। ১৮৭০ সালে রীবিনস্ক-বেলোগোয়ে রেলপথ তৈরি সম্পন্ন হয় যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তখন থেকে মালপত্র পরিবহণে রেলপথ ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। শহরে রেলওয়ে স্টেশন তৈরি হয়। রীবিনস্কের রেল স্টেশন রাশিয়ার অন্যতম সুন্দর স্টেশনগুলোর একটি। চেরেওমুখা নদীর উপর তৈরি হয় রেল সেতু। শহরে রেল মেরামত কারখানা  প্রতিষ্ঠিত হয়। রীবিনস্ক হয়ে সারা রাশিয়া এমনকি অন্যান্য দেশেও মালপত্র পরিবহণ করা হতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে বাড়ে জনসংখ্যা। আশেপাশের শহর থেকে লোকজন রীবিনস্ক আসে বসবাসের জন্য। বিংশ শতকের শুরুতে শীতকালে রীবিনস্কের জনসংখ্যা ছিল ২৫ হাজার আর নৌ চলাচল শুরু হলে সেটা প্রায় চারগুন বেড়ে যেত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাশিয়ায় সাধারণত মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নৌ চলাচল সম্ভব, বাকি সময়ে বরফের কারণে নৌ পথ ব্যবহারের অযোগ্য থাকে। ১৮৯৩ সালে নোবেল ভ্রাতৃদ্বয় রীবিনস্কে পেট্রোল রিজারভয়ার তৈরি করেন। ১৯০৭ সালে তাদের উদ্যোগে তৈরি হয় জাহাজ মেরামত কারখানা যা এখনও বিদ্যমান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় পশ্চিম অঞ্চল থেকে বিভিন্ন কল কারখানা স্থানান্তরিত করে রীবিনস্কে আনা হয় যা পরবর্তীতে শহরের শিল্পায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গড়ে ওঠে প্রিন্টিং শিল্প কারখানা পলিগ্রাফমাশ, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ভিম্পেল। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাশান রেনো পরে অটোমোবাইল কারখানায় পরিণত হয়।   

 যুদ্ধের শিশুদের প্রতি

১৭৮৪ সাল থেকে রীবিনস্ক একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে উঠেছে যার রচয়িতা ছিলেন স্থপতি লেভেনগাগেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু রাস্তা ছিল ভলগা তীরের সমান্তরাল আর বাকী রাস্তাগুলো সেগুলোর সাথে লম্ব ভাবে তৈরি। ফলে রাস্তার ক্রসিং হয় ক্রুশ আকৃতির আর মহল্লাগুলো বর্গাকার বা আয়তাকার। সেখানে দোতলা ও তিনতলা বাড়িঘর গড়ে উঠতে থাকে। শহরের এক বিরাট অংশ ছিল বনিক, শহরবাসী ছিল উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত, সম্পদশালী। ফলে জনসংখ্যা ও আয়তনে বেশি বড় না হলেও শহরে জিমনেশিয়াম, স্কুল কলেজ, লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। নদী তীর বাঁধানো হয়। তৈরি হয় বিভিন্ন উপাসনালয়। রুশ অর্থোডক্স গির্জার পাশাপাশি দেখা হয় স্তারোভের বা প্রাচীন পন্থীদের গির্জা, লুথারিয়ান গির্জা, ইহুদিদের সিনাগগ। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাষ্ট্রীয়, ভোলগা-কামা, রুশ-এশিয়ান ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬০ সালে তৈরি হয় টিপোগ্রাফ যা রীবিনস্ক প্রিন্ট হাউজ নামে আজও কাজ করছে। ১৮৬৪ সাল থেকে প্রকাশিত হতে থাকে সংবাদপত্র। ১৮৭৬ সালে নির্মিত হয় বালশই থিয়েটার যেখানে বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ায় প্রায় সমস্ত খ্যাতিমান শিল্পীরা পারফর্ম করেছেন। তবে ১৯২১ সালে অগ্নিকান্ডে থিয়েটার ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত রীবিনস্ক গম স্টক এক্সচেঞ্জ ছিল রাশিয়ায় এ ধরণের তৃতীয় প্রতিষ্ঠান। বিংশ শতকের শুরুতে রীবিনস্কে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৮৯৭ সালে শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় মেকানিক্যাল স্কুল যা ১৯১৯ সালে তেকনিকুম বা পলিটেকনিক কলেজে পরিণত করা হয়। ১৯৯১ সাল থেকে এটা রীবিনস্ক এভিয়েশন কলেজ। যদিও এখনও পর্যন্ত রীবিনস্ক কী জনসংখ্যায় কী আয়তনে খুব ছোট একটি শহর, কিন্তু ভোলগা তীরের এই শহর রাশিয়ার জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে প্রায় আড়াই শ বছর ধরে। রীবিনস্ক রিজারভয়ার ভোলগার শুরু থেকে তৈরি চতুর্থ রিজারভয়ার – ভেরখনেভলঝস্কি, দুবনার ইভানকভস্কি ও উগলিচের পরে। 

তুতায়েভের ভিডিও 

https://youtu.be/ZlUGmKeXnfY

ছবিতে তুতায়েভ 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=292


Post a Comment

1 Comments