একাদশ পর্ব
প্রসূন কাঞ্জিলাল
তক্ষক পুত্র 'অশ্বসেন'
অশ্বসেন, নাগরাজ তক্ষকের পুত্র। অশ্বসেন মহাভারতের খান্ডববন দহন ঘটনার মূল্ ভুক্তভুগি। এই ঘটনার শুরুটা, একেবারে শুরু থেকে বলা যাক ---
অগ্নিদেব আগেই যজ্ঞে শ্বেতকির হাতে টানা ১২ বছর ঘৃতাহুতি পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই নতুন করে আর ঘৃতাহুতি চাইছিলেন না তিনি। কিন্তু শিবের আজ্ঞা অমান্য করেন কী করে! দুর্বাসা শ্বেতকির হয়ে যজ্ঞ করলেন আর অগ্নিদেব অনিচ্ছা সত্ত্বেও ১০০ বছর ধরে ঘৃতাহুতি গ্রহণ করলেন। এতে অগ্নিদেবের প্রবল ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়, সেই সঙ্গে পেটে প্রবল ব্যথা।
পেটের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ভগবান ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন অগ্নিদেব। ব্রহ্মা অগ্নিদেবের এই পেটব্যথার কারণ জানতেন। উনি হেসে বললেন, ‘তোমার সমস্যার সমাধান আছে--- খাণ্ডব-দহন!’ বিষয়টা প্রথমে বুঝতে পারেননি অগ্নিদেব। ব্রহ্মা বললেন, ‘তোমাকে খাণ্ডব বন জ্বালাতে হবে। ওই বনের পশু-পাখির মেদ আর রক্ত খেলে তোমার ক্ষুধামান্দ্য দূর হবে।’পেটের ব্যথায় কাবু অগ্নিদেব ব্রহ্মার কথা মেনে খাণ্ডব বন পোড়াতে গেলেন। কিন্তু সাত বারের চেষ্টাতেও ব্যর্থ হলেন। এর কারণ, তক্ষক নামে এক বিষধর সাপ। তক্ষক সপরিবার ওই খাণ্ডব বনেই থাকত। বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রের সঙ্গে তার পুরোনো সখ্যতা । অগ্নিদেব যখনই বনে আগুন লাগানোর চেষ্টা করতেন, তখনই তক্ষক বন্ধু ইন্দ্রদেবকে ডেকে নিত। ইন্দ্রদেব বৃষ্টি নামিয়ে আগুন নিভিয়ে দিতেন। অষ্টম বার যখন অগ্নিদেব খাণ্ডবে পৌঁছলেন, তখনই শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের সঙ্গে তাঁর দেখা।অগ্নিদেবের কথা শুনে ইন্দ্রের উপর শ্রীকৃষ্ণের খুব রাগ হল। উনি অগ্নিদেবকে বললেন, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার একটা রথ আর কিছু অস্ত্র-শস্ত্র লাগবে। তার জোগাড় করে আপনি বন জ্বালাতে শুরু করুন। আমি কথা দিচ্ছি, এ বার ইন্দ্রদেব আগুন নেভাতে পারবেন না।’
🍂
আরও পড়ুন 👇
শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে অগ্নিদেবের মুখে প্রসন্নতার হাসি। উনি বরুণদেবকে বলে শ্রীকৃষ্ণকে সুদর্শন-চক্র আর অর্জুনকে গাণ্ডীব ধনুক দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন, সঙ্গে চার ঘোড়াওয়ালা একটা রথ। অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অর্জুন ও কৃষ্ণ খাণ্ডব বনের সীমানায় উপস্থিত হলেন। এ দিকে, অগ্নিদেব বনে আগুন লাগিয়ে দিলেন। ঘটনাচক্রে খান্ডববন অধিপতি তক্ষক বনে না থাকায় তার স্ত্রী, তার সন্তান অশ্বসেনকে গলাধকরণ করে পালাতে চেষ্টা করেন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন তার গলা কেটে দেন এবং তক্ষকের স্ত্রী মারা যান, কিন্তু অশ্বসেন প্রাণে বেঁচে যান ও পালিয়ে যান। আগুনের ভয়ে পশুপাখি জঙ্গল ছেড়ে পালাতে লাগল, কিন্তু কৃষ্ণ ও অর্জুন মিলে ওদের মেরে ফেললেন। অনেক পশুপাখি ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গেল।এর মধ্যে খাণ্ডব বনের ধোঁয়া এবং পশুপাখির চিৎকার দেবলোকে পৌঁছল।
দেবরাজ ইন্দ্র খাণ্ডবকে জ্বলতে দেখে মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু করলেন। পুরো বন ভস্মীভূত হওয়ার আগেই বৃষ্টিতে আগুনের তেজ কমে এল। অগ্নিদেব ভাবলেন, আর ক্ষুধামান্দ্য দূর হল না! তখন ত্রাতা হিসেবে হাজির অর্জুন। তিনি অসাধারণ ধনুর্বিদ্যা কাজে লাগিয়ে তীর ছুড়ে বনের উপর একটা ছাতার মতো আড়াল বানিয়ে দিলেন, ফলে বৃষ্টি আর মাটিতে পড়তে পারল না। অগ্নিদেব আবার খাণ্ডব-দহন শুরু করলেন।
এই ঘটনায় ইন্দ্রদেব ক্রুদ্ধ হন এবং ঐরাবতে চেপে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে খাণ্ডবে এসে উপস্থিত হন । দু’জনের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হল। ইন্দ্রদেবের কাছে দিব্যাস্ত্রের ভাণ্ডার থাকলেও অর্জুন কোনও সাধারণ যোদ্ধা নন। একদিকে যুদ্ধ চলছে, অন্যদিকে বন জ্বলছে। বন্য পশুপাখির মেদ ও রক্তে অগ্নিদেবের ক্ষুধামান্দ্য কমতে শুরু করল।
অনেকক্ষণ অবধি যুদ্ধের কোনও ফলাফল হল না। ঠিক তখনই ইন্দ্রের জন্য দৈববাণী, ‘হে ইন্দ্র! অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণ আদতে নর ও নারায়ণের অবতার এবং অজেয়। আপনি অর্জুনের কাছে জিততে পারবেন না। আপনি পরাজয় স্বীকার করে ফিরে যান।’ হতাশ ইন্দ্রদেবের কাছে আর কোনও বিকল্প ছিল না, ফিরে গেলেন দেবলোকে। ইন্দ্রের বিরুদ্ধে এই জয়ের স্মারক হিসেবে খাণ্ডবপ্রস্থের নাম বদলে হয়ে গেল ইন্দ্রপ্রস্থ।
অশ্বসেন পালিয়ে অন্য পৃথিবীতে লুকিয়ে থাকেন কিন্তু বুকের ভেতর জ্বলতে থাকে প্রতিশোধের আগুন।কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়ে মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে সর্পবাণ হয়ে তিনি কর্ণের তুণীরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে যথাসময়ে কর্ণ অর্জুনকে লক্ষ্য করে সেই দিব্যবাণটি চালালে কৃষ্ণ তাঁর পায়ের চাপে অর্জুনের রথটি মাটিতে একহাত বসিয়ে দিয়েছিলেন, ফলে অর্জুন সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। যদিও অশ্বসেনরূপী সর্পবাণের আঘাতে তাঁর মাথায় থাকা সোনার মুকুটটি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। এরপরে অশ্বসেন আবার কর্ণের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে পুনরায় সর্পবাণ হয়ে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলে, কর্ণ তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন যে— তিনি একই অস্ত্র দু’বার প্রয়োগ করেন না, এবং অন্য কারো সাহায্যে অর্জুনেরয বিরুদ্ধে জিততে চান না। ফলে অশ্বসেন হতাশ হয়ে নিজেই নিজের মাতৃহন্তাকে হত্যা করবার জন্য যুদ্ধে নামলেও শেষে অর্জুনের বাণেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তাঁর জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল।।
0 Comments