জ্বলদর্চি

চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন পথ দেখাচ্ছে সিমবায়োসিস


চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন পথ দেখাচ্ছে সিমবায়োসিস

রুম্পা প্রতিহার

কৈশোরে বিজ্ঞান শব্দ ও তার বিষয়ের  সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর অবশ্য পাঠ্য ছিল 'বিজ্ঞান, অভিশাপ না আশীর্বাদ ' রচনা পাঠ। সেই পাঠ থেকে এই ধারণা জন্মায় যে,  বিজ্ঞান যখন সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে তখন তা অভিশাপ। আর যখন তা মানব কল্যাণে  ব্যবহৃত হয়েছে তখন তা  আশীর্বাদ হয়ে বর্ষিত হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে সেই আশীর্বাদের এক অনন্য রূপ হল টেস্টটিউব বেবি। মেদিনীপুর শহরে ড.কাঞ্চনকুমার ধাড়া ও ড. সন্ধ্যা মন্ডল- এর নেতৃত্বে সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টার নিঃসন্তান দম্পতিদের অত্যাধুনিক ও সাধারণ পদ্ধতিতে গর্ভধারণে সহযোগিতা করে  বৃহত্তর মানবকল্যাণে নিয়োজিত । 

   বর্তমানে সারা বিশ্বজুড়ে বন্ধ্যাত্বের ( ইনফার্টিলিটি) সমস্যা বেড়েই চলেছে। বন্ধ্যাত্ব  কি? খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে বন্ধ্যাত্ব হল শরীরের একটি প্রজননগত অসুখ। যার ফলে মানুষ তার প্রতিরূপ সৃষ্টিতে (সন্তান)ব্যর্থ হয়। এই প্রতিরূপ সৃষ্টি হল শারীরিক  বহু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক জটিল পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বহু কার্যকারণের সুস্থ সমন্বয় প্রয়োজন। যার মধ্যে আছে পুরুষের সুস্থ শুক্রাণু ও মহিলার সুস্থ ডিম্বাণু উৎপাদন ক্ষমতা (যাকে দেশীয় ভাষায় নারী ও পুরুষের উর্বরতা শক্তি বলা হয়), অবাধ ডিম্বনালী ও শুক্রনালী-- যার সাহায্যে শুক্রাণু ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছাতে পারে, মিলনের সময় শুক্রাণুর ডিম্বাণুকে প্রজননক্ষম করার ক্ষমতা, নিষিক্ত ডিম্বাণু গর্ভাশয়ে স্থাপিত হওয়ার ক্ষমতা ও সেটি ভ্রূণে পরিণত হওয়ার পূর্ণ  ক্ষমতা। সুতরাং বন্ধ্যাত্বে পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই ভূমিকা আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ পুরুষের ক্ষেত্রে তার শুক্রাণুর স্বল্পতা বা একদম না থাকা বা শুক্রাণুর গঠনে বিকৃতি অথবা ডিম্বানুর  কাছে পৌঁছানোর আগেই শুক্রাণুর মৃত্যু ইত্যাদি । মহিলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো তার ডিম্বস্ফোটনের সমস্যা। তা যদি না হয় তাহলে জরায়ুতে সমস্যা থাকলে কিংবা হরমোনাল সমস্যার কারণেও বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।

   এখানেই প্রশ্ন আসে বন্ধ্যাত্ব যদি নারী ও পুরুষ  দুজনের শারীরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল, তাহলে শুধু বন্ধ্যাত্বের তকমা নারীকে দেওয়া হয় কেন? এর জন্য আমাদের সমাজ মানসিকতা দায়ী, দায়ী অজ্ঞতা, সর্বোপরি দায়ী বিজ্ঞান মনস্কতার অভাব। বন্ধ্যাত্ব একটি অসুখ। সুতরাং অসুখ যখন আছে, তখন তার চিকিৎসাও আছে। আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে খুব সহজেই চিকিৎসার সাহায্যে এই অসুখ থেকে মুক্তির পথ পাওয়া যায়।

  সেই আশায় যখন কোন নিঃসন্তান দম্পতি সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টারে আসেন, তখন প্রথম তাঁদের বয়স, মেডিক্যাল ইতিহাস জানার প্রয়োজন হয়, এরপর জননগ্রন্থিতে কোনো অপারেশন হয়েছে কিনা, নিয়মিত ঋতুস্রাব হয় কিনা--- এগুলো জেনে মোটামুটি ধারণা করা যেতে পারে সমস্যাটি কোথায়। তার উপর ভিত্তি করে ডিম ঠিক মত ফুটছে কিনা তারও অনুসন্ধানের প্রয়োজন। নারীর ক্ষেত্রে কিছু হরমোনাল পরীক্ষা ও জরায়ুর কাঠামো ঠিক আছে কিনা তাও দেখা হয়। আর পুরুষের ক্ষেত্রে সিমেন আনালাইসিস করা হয়।

  যেসব দম্পতি বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা সন্তান চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় টেস্ট টিউব বেবি -পদ্ধতি  চান না। তাঁদের ধারণা সর্বশেষ আশা হল টেস্ট টিউব বেবি । কিন্তু ধারণাটি নিতান্তই ভুল। কারণ সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বয়স। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নারীর ডিমফোটা কমতে থাকে, তার মানও কমতে থাকে, জরায়ুর ধারণ ক্ষমতাও কমে যায়। অন্যদিকে পুরুষের ক্ষেত্রে সক্রিয় শুক্রাণুর সংখ্যা, তার ঘনত্ব, সংক্রমণের সমস্যা, রক্তে শর্করার পরিমাণ ইত্যাদিও জরুরি বিষয়। তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে  সন্তান না এলে অযথা দেরি না করে টেস্ট টিউব বেবি  নেওয়াই সঠিক পদ্ধতি।


 অনেকেরই টেস্ট টিউব বেবি  সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাদের ধারণা টেস্ট টিউব বেবি  মানে ফার্টিলাইজেশন থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশু বোধ হয় টেস্ট টিউবেই হয়। বিষয়টি তা নয়। টেস্ট টিউব বেবি  বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিরও বিভিন্ন কৌশল রয়েছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে I.V.F. বা ইন- ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে স্ত্রীকে ঋতুস্রাবের সময় থেকে কিছু ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। যাতে তার ডিমগুলো বড় ও পরিপক্ক হয়। তারপর আল্ট্রা সাউণ্ড সহ রক্ত পরীক্ষা করলে জানা যায় ডিমগুলো বড়ো হচ্ছে কিনা। যখন ডিমগুলো বড় ও পরিপক্ক হয় তখন ডিমগুলোকে বাইরে নিয়ে এসে স্বামীর শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিয়ে ল্যাবেরেটরিতে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। সেই ভ্রূণ স্ত্রীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। জরায়ুতে ভ্রূণ সংস্থাপন সম্পন্ন হওয়ার পরই তা চূড়ান্ত বিকাশ লাভ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ শিশু  হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। সূচনার এই সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়টাতে শিশু একদম স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার মতই মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে এবং সময়মত সেখান থেকেই নবজাতকের জন্ম হয়। কোনো টেস্ট টিউবে এই শিশু বড় হয় না।
  বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় সর্বজন স্বীকৃত আধুনিক এই টেস্ট টিউব বেবির সঙ্গে একজন স্বাভাবিক গর্ভধারিণী নারীর জরায়ুতে বেড়ে ওঠা শিশুর জীবন প্রণালীতে কোনো পার্থক্য নেই। শিশু মাতৃজঠরে থাকাকালীন সময়কার স্বর্গীয় অনুভবে দুই নারীই সমান অনুভূতিশীল। তাছাড়া টেস্ট টিউব বেবির জন্মদানের পুরো প্রক্রিয়াটিও স্বামী- স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।  অতএব অনেক নিঃসন্তান দম্পতির মুখে হাসি ফোটায় এই টেস্ট টিউব বেবি। শুধু ল্যাবরেটরিতে নিষেক কার্য সম্পন্ন হয় বলে, আর যেহেতু ল্যাবরেটরিতে প্রচুর টেস্ট টিউব থাকে, তাই এইরূপ নামকরণ।  আসুন আমরা বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদ যথাসময়ে গ্রহণ করে সুস্থ সবল ধীশক্তিসম্পন্ন শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাই।

  এই বিজ্ঞান চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে মেদিনীপুর শহরের সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টার মানব সেবায় নিয়োজিত। নিঃসন্তান দম্পতির মুখে হাসি ফোটাতে এই প্রতিষ্ঠান সাফল্য অর্জন করেছে। এই সাফল্যের কারণ জানালেন প্রতিষ্ঠানের দুই কর্ণধার ড. কাঞ্চন কুমার ধাড়া ও ড. সন্ধ্যা মণ্ডল।তাঁদের  বক্তব্য সিমবায়োসিস ফার্টিলিটি সেন্টারের সম্পূর্ণ টিম ও দম্পতিদের  পূর্ণ সহযোগিতায় এই বিরাট কর্মযজ্ঞ ঘটে চলেছে।

সিমবায়োসিসের এই সাফল্যে ডাঃ কাঞ্চন কুমার ধাড়া ও ডাঃ সন্ধ্যা মণ্ডল পেয়েছেন দেশ বিদেশের সম্মান। তবে তাঁদের কথায়, নিঃসন্তান বাবামায়ের মুখে হাসি ফোটানোর আনন্দই হল আমাদের চিকিৎসক-জীবনের সেরা পুরস্কার।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments