অম্বিকা কালনা...ইতিহাসের সাথে একটু চলা
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
এটিকে ভ্রমণকথা বলা উচিত হবে না, কারণ আলোচ্য স্থানটি আমার জন্মস্হান৷ তবে সে স্হান ঐতিহাসিক বলেই আমি মনে করি৷ পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমা শহর যা অম্বিকা কালনা নামেও পরিচিত, একটি পুণ্যস্হানও বটে৷
হাওড়া স্টেশন থেকে কাটোয়া লাইনের যে কোনো ট্রেনে অথবা বর্ধমান শহর থেকে বাস রাস্তায় অম্বিকা কালনায় পৌঁছানো যায়৷ হুগলী-নদীয়া দুই জেলার মিলন বিন্দুতে ভাগীরথী তীরে কালনা অবস্থিত যা অতি পূর্বে গঞ্জ বলে পরিচিত হলেও বর্তমানে আধুনিক শহর৷
পাঠান রাজত্বের মাঝামাঝি থেকে নানান রচনাতে 'অম্বিকা' 'অম্বুয়া' ইত্যাদি নামের উল্লেখ পাওয়া যায় তাই এই জনপদ বেশ প্রাচীন সন্দেহ নেই৷ 'কালনা' ছিল প্রাক মুসলিম যুগের বর্দ্ধিষ্ণু গঞ্জ৷ আবার অনেকে মনে করেন জৈন দেবী 'অম্বিকা'র নাম থেকে এই জনপদ 'অম্বিকা কালনা' হয়েছে৷ কালের নিয়মে জৈন দেবী হিন্দু দেবীতে পরিগণিত হয়ে বর্তমানে মা সিদ্ধেশ্বরী নামে পূজিত হন নিজ মন্দিরে, ভাগীরথী তীরে৷ ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান মন্দিরটি বর্ধমান রাজ চিত্রসেন নির্মান করেন৷ এর প্রবেশ দ্বারে একটি সিংহ দন্ডায়মান৷
পাঁচটি শিব মন্দিরও রয়েছে এই চত্ত্বরে৷ বাংলার নিজস্ব ঘরানায় পর পর দুটি দোচালা যুক্ত 'জোড় বাংলা' মন্দিরে দেবীর স্হান৷ এই দেবীকে শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে মনে করা হয় বলে নাগরিকদের কোনো শুভ অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো দেব দেবীর পুজো হলেও ওনার মন্দিরে পুজো পাঠানো প্রায় বাধ্যতামূলক৷
এ হেন শাক্ত কালনাই অসম্ভব ভাবে বৈষ্ণব৷ কারণ এই শহরের সাথে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যর যোগ৷ ধর্ম তখন মানব ধর্মমুখী৷ শ্রী চৈতন্য নৌকাযোগে ১৫০৮ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র বাইশ বছর বয়সে কালনায় আসেন৷ মহাপ্রভু পাড়ায় পর্ণকুটীরবাসী গৌরীদাস পন্ডিতের গৃহে হাজির অভেদাত্মা নিত্যানন্দকে নিয়ে৷ এই কুটীরেই না কি "কলিকালে হরিনামই সত্য" এই বাণী উচ্চারিত হল প্রথম৷ মুসলমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভক্তিবাদী আন্দোলনের জন্য গৌরাঙ্গ প্রভুর সাথে অনাসক্ত সাধক গৌরীদাসের এই মিলন ও আলোচনা তাই ঐতিহাসিক বই কি!
🍂
আরও পড়ুন 👇
পাথুরিয়া মহলের যে ঘাটে তাঁর আগমন ঘটেছিল সেই ঘাটে একটি স্মারক তোরণ আছে৷ মহাপ্রভু পাড়ার মন্দিরে আজও রক্ষিত আছে সেই নৌকার বৈঠা ও মহাপ্রভু লিখিত পুঁথি৷ মন্দিরটি মহাপ্রভুর জীবনকালে নির্মিত একমাত্র মন্দির৷ দারুমূর্তিতে 'নিতাই গৌর' প্রতিষ্ঠিত৷ 'ঝাঁকি দর্শন' দেন প্রভু৷ দুঃখের কথা মন্দিরের প্রাচীন অলংকরণ প্রায় বিলুপ্ত কিন্তু সংস্কার হয় নিয়মিত৷
ইতিহাস বলে প্রভু দ্বিতীয়বার কালনায় আসেন একত্রিশ বছর বয়সে দন্ড মহোৎসবে যোগ দিতে৷ সেই সময় যেই তেঁতুল গাছের নিচে তাঁর বিশ্রামের ব্যবস্হা হয়েছিল অর্ধ সহস্র বছর পরেও সেই গাছ আজও প্রভুর পায়ের চিহ্ন পাথরে আগলে বর্তমান৷
মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ
গৌরীদাসের বড় ভাই সূর্য্যদাস পন্ডিত নবাব হুসেন শাহর কর্মচারী ছিলেন৷ সূর্য্যদাসের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবার সাথে প্রভু নিত্যানন্দর বিবাহ হয় মহাপ্রভুর ইচ্ছানুসারে৷
সূর্যদাস পরবর্তীকালে শ্যামসুন্দর মন্দির স্হাপন করেন যা এখন মহাপ্রভু বাড়ির মতই দর্শনীয়৷
কালনার এই কৃষ্ণপ্রেমের অন্যতম দলিল লালজী মন্দির৷ ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত এই মন্দির বর্ধমান রাজ পরিবারের রানি ব্রজকিশোরী দেবী নির্মাণ করান৷ এর বিশালত্ব, নির্মাণশৈলী, টেরাকোটার কাজ অসংখ্য তীর্থযাত্রীকে নিত্য টেনে আনে৷ মন্দিরসংলগ্ন হয়ে আছে একটি নাট মন্দির ও গরুড় স্তম্ভ৷ আর আছে গিরি গোবর্দ্ধন পর্বতের আদলে একটি নির্মান যেখানে পুতুলের মাধ্যমে সজ্জিত আছে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা৷ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শোভাযাত্রা হয় এই পুতুলগুলি সহযোগে।আছেন লালজী অর্থাৎ রাধা কৃষ্ণর যুগল রূপ৷ কথিত আছে রানির 'রাই'এর সাথে এক সন্ন্যাসীর 'শ্যাম'এর বিবাহ হয়েছিল এখানে৷ তাই শ্যাম হলেন রানির জামাই 'লালজী'৷
'নীল দর্পন' রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্রর কাব্যে আছে
'এই স্হানে লালজীর সুখ অবস্হান৷
নির্মিত মন্দির বড় সুন্দর সোপান৷৷'
এই লালজী মন্দিরকে ঘিরে বলা যায় একটা মন্দির কমপ্লেক্স৷ কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির, বদ্রীনারায়ন মন্দির, রাধাবল্লভজীর মন্দির, বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির, পঞ্চশিব মন্দির, রূপেশ্বর শিব মন্দির, রাসমঞ্চ, লক্ষ্মীবাড়ি, প্রতাপেশ্বর মন্দির ইত্যাদি৷
এর মধ্যে প্রতাপেশ্বর মন্দিরের গঠনশৈলী আলাদা করে চোখ টানে৷ ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে মহারানি প্যারিকুমারী দেবীর স্বামী প্রতাপচাঁদের (জাল প্রতাপের কাহিনী অনেকেই শুনেছেন) নামানুসারে তৈরি এই মন্দিরটি উড়িশ্যার রেখদেউল পদ্ধতিতে নির্মিত৷ এর টেরাকোটা কাজ অনিন্দ্যসুন্দর৷
এর পর আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয় ১০৮ শিব মন্দিরের কথা৷ এটি 'নবকৈলাশ' বলেও প্রসিদ্ধ৷ বর্ধমান শহরেও মহারানি বিষণকুমারী প্রতিষ্ঠিত ১০৮ শিব মন্দির আছে তবে কালনারটির গঠনশৈলী আরও চমকপ্রদ৷ বাইরের বৃত্তে ৭৪ ও ভেতরের বৃত্তে ৩৪টি মন্দির নিয়ে বৃত্তাকারে অবস্হান এই মন্দিরটি ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ বাইরের বৃত্তের লিঙ্গগুলি সাদা ও কালো পর্যায় ক্রমে সজ্জিত৷ ভিতরের বৃত্তে সবকটিই সাদা লিঙ্গ৷ প্রতি লিঙ্গের গৌরীপট উত্তরমুখী৷ একেবারে কেন্দ্রে আছে একটি ইঁদারা যেখান থেকে তাকালে একসঙ্গে ৩৪টি শ্বেতলিঙ্গ দর্শন করা যায়৷ বর্ধমান রাজ তেজচন্দ্র বাহাদুর এটির নির্মান করান৷
প্রসঙ্গত লালজী মন্দির পঁচিশ চূড়া বিশিষ্ট৷ কালনার আরও দুটি মন্দির, গোপালজীউর মন্দির এবং কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির পঁচিশ চূড়া বিশিষ্ট৷ পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি এরূপ মন্দিরের তিনটিই কালনায়৷ এছাড়া বর্ধমান মহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুরের চিতাভস্মের ওপর স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয় গঙ্গাতীরে যা সমাজ বাড়ি (সমাধিবাড়ি) নামে পরিচিত৷ অবশ্য বর্তমানে তা সংরক্ষণের অভাবে ও দখলের ফলে বিলীন হবার পথে৷
রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচন্দ্রজী ও অন্যান্য মন্দির
অম্বিকা কালনায় জন্মেছিলেন শাক্তসাধক ও শ্যামা সঙ্গীত রচয়িতা কমলাকান্ত৷ তাঁর ভিটেও বর্তমান৷
গোপাল কালী শিব সব শক্তির উপাসনস্হল কালনা যেন এক মহামিলন ক্ষেত্র৷ মুসলিম ও খ্রীষ্টপ্রভাবও তার পরতে পরতে৷ দাঁতনকাটি তলার মসজিদ তার প্রমাণ৷ ১৪৯০ খ্রীষ্টাব্দে হাবসী সুলতান দ্বিতীয় নাসিরুদ্দন মাসুদ শাহের আমলে প্রথম মসজিদ তৈরী হয়৷ দ্বিতীয় নির্মান মসজিদ ই জামিয়া ১৫৩৩এ নির্মান করান হূসেন শার পৌত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ৷ একে মজলিশ সাহেবের মসজিদও বলা হয়৷ পরে আরও একটি মসজিদ নির্মিত হয় এই স্হানেই৷ তিনটির মধ্যে এখন দ্বিতীয়টির ভগ্নরূপ দেখা যায়৷
কালনার গঙ্গা
আবার খ্রীষ্ট উপাসনার প্রথম চার্চটি ১৮২৫এ এখানে নির্মিত হয়েছিল৷ এই প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চটি বর্ধমান জেলার দ্বিতীয় নির্মান৷
ইতিহাসে কালনা আরও কারণে স্হান করে নিয়েছে৷ পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র যে বিখ্যাত তারানাথ তর্কবাগীশকে আহ্বান করেছিলেন সংস্কৃত কলেজে পাঠদানের জন্য তিনি কালনারই ভূমিপুত্র আর সে কারণেই পদব্রজে বিদ্যাসাগরের কালনায় আসা। পথিমধ্যে কলেরা রোগীকে পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর সেই কাহিনী সকলেই জানি৷
নবদ্বীপ মায়াপুরের থেকে ঢিল ছোঁড়া থুড়ি স্বল্প দূরত্বের এই কালনা শহরে তাই চিরকালই ভক্ত সাধকদের আনাগোনা৷ ইদানিং পুরাতত্ত্ব বিভাগের বদান্যতায় ঝাঁ চকচকে ভাব এসেছে দর্শনীয় নানা স্হানে৷ সাধারণ ভ্রমণপিপাসুরাও একটা দুটো দিন কাটিয়ে আসতে পারেন এই শহর থেকে৷ সংগ্রহ করতে পারেন ইতিহাসের সাথে সাথে লোককাহিনীর নানা রসদ৷
ছবি ঋণ : সৌরভ দত্ত, প্রদীপ নন্দী
0 Comments